আইন ও অপরাধ

২১ বছরেও শেষ হয়নি বিচার

মামুন খান : ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। ওই দিন সকালে খুনিদের ছোড়া কামানের গোলায় মোহাম্মদপুরের শেরশাহ সুরী রোডে ১৩ জন নিহত হন। ওই ঘটনার দীর্ঘদিন পর ১৯৯৬ সালে ২৯ নভেম্বর মোহাম্মাদপুর থানায় মামলা দায়ের করা হয়। তবে মামলার বিচার ২১ বছরেও শেষ হয়নি। মূলত সাক্ষী না আসায় মামলার বিচারকাজ অনেকটা থমকে আছে। ওই ঘটনায় দায়ের করা মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে প্রায় ১২ বছর আগে চার্জগঠন করে বিচার শুরু করেন আদালত। তবে এতদিনেও মামলার বিচার কাজ শেষ হয়নি। ঢাকার চতুর্থ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে মামলাটি এখন সাক্ষ্য গ্রহণের পর্যায়ে আছে । সর্বশেষ গত ৯ আগষ্ট তারিখ মামলাটি সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য ধার্য ছিল। কিন্তু ওইদিন কোন সাক্ষী না আসায় আগামি ৪ অক্টোবর সাক্ষ্য গ্রহণের পরবর্তী তারিখ ঠিক করেছেন ওই আদালতের বিচারক নূরুল আমীন বিপ্লব। এদিকে এখন পর্যন্ত কোনো প্রকার সহায়তা পাননি নিহতদের স্বজন হতদরিদ্র পরিবারগুলো। মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তি ক্ষমতায় থাকায় সরকারের কাছে স্বজনরা ওই হত্যাকান্ডের দ্রুত বিচারের পাশাপাশি পুনর্বাসনের দাবি জানিয়েছেন। মামলার বাদী মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলী বলেন, আমি তখন ২৪ বছরের যুবক। মোহাম্মদপুরের শেরশাহ সুরী রোডের ৮ নম্বর বাড়িটি ছিল আমার। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে হত্যার দিন ভোর সাড়ে ৫টায় বাসার ওপর কামানের গোলা এসে পড়ে। সেখানে বাসার ভাড়াটিয়া ও আমার গ্রামের লোকজন অবস্থান করছিল। কামানের গোলায় আমার দূর সম্পর্কের আত্মীয় রিজিয়া বেগমসহ ১৩ জন সেখানে মারা যান। প্রায় ৪০ জন আহত হন। ওই ঘটনায় মামলা করতে গেলে পুলিশ দেশের অস্থিতিশীল পরিস্থিতির অযুহাতে মামলা না নিয়ে আমাকে ফিরিয়ে দেন। আর কামানের গোলায় নিহত লাশগুলোকে কবর দিয়ে দিতে বলেন। তিনি বলেন, ‘একপর্যায়ে ১৫ আগস্ট যা কিছু হয়েছে এ ব্যাপারে কোনো মামলা করা যাবে নাÑ এ সংক্রান্ত আইন পাস হয়। ফলে চেষ্টা করেও ওই সময় আর মামলা করা সম্ভব হয়নি। পরে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তি ক্ষমতায় এলে ওই আইন বাতিল হয়। এরপর ১৯৯৬ সালে স্বশরীরে মোহাম্মদপুর থানায় গিয়ে কামানের গোলায় ১৩ জনকে হত্যার মামলা দায়ের করি। তিনি আরো বলেন, গুরুত্বপূর্ণ এ মামলা দীর্ঘ দিনেও শেষ না হওয়া অত্যন্ত দুঃখজনক। পলাতক আসামিদের দেশে ফিরিয়ে এনে তাদেরও শাস্তি নিশ্চিত করার দাবি জানান তিনি। দু:খ প্রকাশ করে বলেন, ঘটনার পর থেকে এখন পর্যন্ত কেউ হতদরিদ্র ওই পরিবারগুলোর খবর নিতে আসেনি। কোনো প্রকার আর্থিক সহায়তাও করেনি। বর্তমানে হতদরিদ্র ওই পরিবারগুলোর পুনর্বাসনের জন্য  প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তিনি। আদালত সূত্রে জানা গেছে, ২০০৭ সালে ১৯ মার্চ  মামলার বাদীর প্রথম সাক্ষ্য গ্রহণ হয়। এরপর দীর্ঘদিন বাদীর পূর্ণাঙ্গ সাক্ষ্য গ্রহণ হয়নি। রাষ্ট্রপক্ষের ১৫তম সাক্ষী মো. রমিজ উদ্দিন ২০১৪ সালের ২৪ এপ্রিল আদালতে সাক্ষ্য দেন। এছাড়া ২০১৫ সালের ৭ মে আদালতে এ মামলায় বাদী অবশিষ্ট সাক্ষ্য দেন। আর বাদীর ওই পূর্ণাঙ্গ সাক্ষ্য দেওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত আর কোনো সাক্ষী আদালতে হাজির করতে পারেনি পুলিশ। ফলে রাষ্ট্রপক্ষ বার বার সময় আবেদন করছেন। আর আদালত তা মঞ্জুর করে সাক্ষ্য গ্রহণের পরবর্তী দিন ধার্য করে চলেছেন। বাদীসহ ১৫ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হলেও মামলার দুই তদন্ত কর্মকর্তাসহ ৪৩ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ এখনও হয়নি। ঢাকার চতুর্থ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতের কৌঁসুলী সাইফুল ইসলাম হেলাল  বলেন, আদালত মামলাটিতে সাক্ষী হাজিরের ক্ষেত্রে সব সময়ই যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করে চলেছেন । রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। সাক্ষীদের হাজিরের জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট সব স্থানে দফায় দফায় চিঠি দেয়া হয়েছে। বার বার সমন পাঠানোর পরও মামলার গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী দুই তদন্তকারী কর্মকর্তা এখনও সাক্ষ্য দিতে আদালতে আসেননি। পুলিশ এসব সাক্ষীদের আদালতে হাজির করতে পারেনি। পলাতক আসামিদের পক্ষে রাষ্ট্র নিয়োজিত স্টেট ডিফেন্স আইনজীবী মোহাম্মদ মোহাম্মদ মাহফুজুর রহমান চৌধুরী  বলেন, আদালত ও প্রসিকিউশন একাধিকবার সাক্ষী হাজির করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিলেও সাক্ষী না আসায় মামলা নিষ্পত্তিতে গতি আসছে না। দীর্ঘদিনের এ পুরাতন মামলার বিচার কাজ যত দ্রুত সম্ভব শেষ হওয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি। নথিপত্র সূত্রে জানা যায়, গত ৯ আগস্ট ধার্য তারিখে আদালতে সাক্ষী হাজির হয়নি। আদালত মামলার পরবর্তী সাক্ষ্যগ্রহনের দিন ধার্য করেন। আদালত আদেশে বলেন, চার্জশিটভুক্ত ৫১ নম্বর সাক্ষী পুলিশ পরিদর্শক মো. নুরুল আমিন (সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, মোহাম্মদপুর থানা), ৫২ নম্বর সাক্ষী ডা. এজাজ আহম্মদ, ৫৩ নম্বর সাক্ষী ডা. আব্দুল সামাদ, ৫৪ নম্বর সাক্ষী ডা. এফএম হাসান, ৫৫ নম্বর সাক্ষী অতিরিক্ত মুখ্য মহানগর হাকিম মো. হাবিবুর রহমান, ৫৬ নম্বর সাক্ষী মেট্রোপলিন ম্যাজিস্ট্রেট এম. আফজালুর রহমান, ৫৮ নম্বর সাক্ষী সহকারী পুলিশ সুপার মুন্সি আতিকুর রহমান ও মোহাম্মদপুর থানার তৎকালীন প্রথম তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই মো. তোফাজ্জল হোসেনকে উপস্থিত করতে অজামিনযোগ্য গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ইস্যু করা হল। তা তামিল করে সাক্ষীদের আদালতে উপস্থিত করতে ঢাকার পুলিশ সুপার ও উপ-পুলিশ কমিশনারকে নির্দেশ দেয়া হলো।  এদিকে গত ১৩ আগস্ট এ আদেশের অনুলিপি আদালত থেকে অবগতি ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব, আইন মন্ত্রণালয়ের সচিব, জন প্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিব, পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার ও সহকারী পুলিশ কমিশনার বরাবর পাঠানো হয়েছে। প্রসঙ্গত, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোর সাড়ে ৫টার দিকে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাড়ি আক্রমণের সময় সেনা সদস্যরা কামানের গোলা ছুঁড়লে তা গিয়ে মোহাম্মদপুরের শেরশাহ সুরী রোডর ৮ ও ৯ এবং ১৯৬ ও ১৯৭ নম্বর বাড়ির (টিনশেড বস্তি) ওপর পড়ে। লে. কর্নেল মুহিউদ্দিন আহমেদের (আর্টিলারি) ছোড়া কামানের গোলার বিকট শব্দে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে গোটা এলাকা। মুহূর্তে ধুলায় মিশে যায় ওই বস্তি। ওই ঘটনায় নারী ও শিশুসহ ১৩ জন মারা যায়। প্রায় ৪০ জন আহতের মধ্যে কয়েকজন পুরুষ সারাজীবনের জন্য পঙ্গুত্ব বরণ করে। নিহতরা হলো- রিজিয়া বেগম ও তার ছয় মাসের মেয়ে নাসিমা, কাশেদা বেগম, ছাবেরা বেগম, সাফিয়া খাতুন, আনোয়ারা বেগম (প্রথম), ময়ফুল বিবি, আনোয়ারা বেগম (দ্বিতীয়), হাবিবুর রহমান, আবদুল্লাহ, রফিজল, সাহাব উদ্দিন আহম্মেদ ও আমিন উদ্দিন আহম্মেদ। ওই ঘটনায় ৮ নম্বর বাড়ির মালিক মোহাম্মদ আলী বাদি হয়ে ১৯৯৬ সালের ২৯ নভেম্বর মোহাম্মদপুর থানায় এ মামলা দায়ের করেন। ২০০১ সালের এপ্রিলে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে। এরপর ২০০৬ সালের ১ নভেম্বর এ মামলায় ১৭ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন আদালত। ১৭ আসামির মধ্যে ২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় মৃত্যুদ-প্রাপ্ত পাঁচ জনের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। এরা হলেন- লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) সৈয়দ ফারুক রহমান, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব্যাহতিপ্রাপ্ত) সুলতান শাহরিয়ার রশিদ, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) মুহিউদ্দিন আহমেদ, মেজর (অব.) বজলুল হুদা ও মেজর (অব্যাহতিপ্রাপ্ত) একেএম মহিউদ্দিন আহমেদ। ওই পাঁচজন ছাড়া এ মামলায় প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী তাহের উদ্দিন ঠাকুরকে (প্রয়াত) গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছিল। এছাড়া মামলার অপর ১১ আসামি পলাতক রয়েছে। পলাতকরা হলেন- লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব্যাহতিপ্রাপ্ত) শরিফুল হক ডালিম, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (বরখাস্ত) খন্দকার আবদুর রশিদ, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অবসরপ্রাপ্ত) এসএইচএমবি নূর চৌধুরী ইবি, ক্যাপ্টেন (অব.) আবদুল মাজেদ, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) এএম রাশেদ চৌধুরী, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব্যাহতিপ্রাপ্ত) আহমদ শরিফুল হোসেন ওরফে শরিফুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন (অব্যাহতিপ্রাপ্ত) মো. কিসমত হাসেম, ক্যাপ্টেন (অব.) নাজমুল হোসেন আনসার, রিসালদার (অবসরপ্রাপ্ত) মোসলেম উদ্দিন ওরফে মোসলেহ উদ্দিন, দফাদার মারফত আলী ও এলভি মো. আলী হোসেন মৃধা।

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৫ আগস্ট ২০১৮/মামুন খান/এনএ