আইন ও অপরাধ

উকিলের চেম্বারে আশ্রয় নিয়েও শেষ রক্ষা হয়নি রনকের

মামুন খান : ‘মারাত্মক জখম অবস্থায় দৌড়ে একজন উকিলের চেম্বারে আশ্রয় নেয় রনক। সেখানে গিয়েও তার শেষ রক্ষা হয়নি। সেখান থেকে তাকে বের করে একটি চায়ের দোকানের ওপর ফেলে দেয় দুর্বৃত্তরা। এরপর বন্ধুরা রনককে হাসপাতালে নিলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।’ প্রেমঘটিত বিরোধের জেরে পুরান ঢাকায় হোলি উৎসব থেকে ডেকে নিয়ে কলেজছাত্র রওনককে হত্যার মামলায় ১৪ জনের বিরুদ্ধে দেওয়া চার্জশিটে এমন তথ্য উল্লেখ করেছেন তদন্ত কর্মকর্তা কোতয়ালী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) জানে আলম মুনশী। চার্জশিটে ১৪ জনকে আসামি করা হয়েছে। তাদের মধ্যে ১১ জনই কিশোর। চার্জশিটভূক্ত আসামিরা হলেন- ইয়াছিন আহম্মেদ ইমন (১৭), লিজা আক্তার ওরফে মাইসা আলম (১৬),  রিয়াজ আলম ফারহান (১৯), আব্দুল ওয়াহিদ (১৩), ওমর ফারুক (১৬), ফাহিম আহম্মেদ অ্যাফ্রো (১৭), আল আমিন ওরফে ফারাবি খান (১৪), বোরহান উদ্দিন রাব্বানী ওরফে জিসান (১৬), তাহসীন হোসেন বিজয় (১৫), ইয়াছিন ইমন (২০), সজিব মাহমুদ (১৭), আবেদুর রহমান উৎসব (১২), ইয়াছিন আলী (১৭) ও আসিফ। ওমর ফারুক পলাতক রয়েছে। তদন্ত কর্মকর্তা তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানার জারি আবেদন করেছেন। চার্জশিটে তদন্ত কর্মকর্তা উল্লেখ করেন, আসামিরা পরস্পরের বন্ধু। এরা একে অপরের সাথে ফেসবুকের মাধ্যমে পরিচিত হয়। একেকজন একেক পেশার। কেউ ছাত্র, কেউ গ্যারেজ মেকানিক, আবার কেউ দোকানের কর্মচারী। এদের মধ্যে অপ্রাপ্তবয়স্ক যেমন আছে, তেমনই প্রাপ্তবয়স্কও আছে। তিনি বলেন, হত্যাকাণ্ডটি প্রেমঘটিত। ঘটনার প্রায় এক বছর পূর্বে ভিকটিম রনকের সাথে মামলার সাক্ষী পলি আক্তার ওরফে তুহু নামের এক মেয়ের প্রেমের সম্পর্ক ছিল। রনক-তুহুর সম্পর্ক তাদের অভিভাবকরা জেনে গেলে রনকের মা তুহুকে রনকের সাথে সম্পর্ক না রাখার জন্য চাপ প্রয়োগ করেন। দুই পক্ষের অভিভাবকদের মধ্যে রনক ও তুহুর সম্পর্ক না রাখার বিষয়ে সালিশও হয়। এরপর তুহুর সাথে ইয়াছিন আহম্মেদ ওরফে ইমনের পরিচয় হয় ও প্রেমের সম্পর্ক হয়। এই প্রেমের সম্পর্ক রনক জানার পর ইমন ও রনকের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে তুহুকে নিয়ে ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ ও মোবাইল ফোনে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রকম কথা চালাচালি এবং পরস্পরকে ভয়ভীতি-হুমকি প্রদর্শন ও গালি-গালাজ করতো। তাদের সম্পর্কের চরম অবনতি ঘটে। এ সময় ইমন রনককে হত্যার পরিকল্পনায় লিপ্ত হয়। তদন্ত কর্মকর্তা উল্লেখ করেন, গত ১ মার্চ ইমন রনকের আরেক প্রেমিকা মাইসার মাধ্যমে তাকে শাখারী বাজারে হোলি খেলা দেখার নাম করে ডেকে আনে। পরে পূর্বপরিকল্পনার অংশ হিসেবে আসামিরা রনককে গালি-গালাজ, কিল-ঘুষি ও ছুরিকাঘাত করে মারাত্মক আহত ও রক্তাক্ত করে। পরে হাসপাতালে নেওয়ার পথে রনক মারা যায়। তিনি বলেন, ঘটনার মূল নায়ক ও পরিকল্পনাকারী ইয়াছিন আহম্মেদ ওরফে ইমন। সে মাইসার মাধ্যমে রনককে ডেকে আনে ও ওয়াহিদের মাধ্যমে অন্যান্য বন্ধু-বান্ধব ও ছুরি সংগ্রহ করে। ঘটনার দিন সকাল ১০টার সময় সূত্রাপুর থানাধীন লক্ষ্মীবাজার কেএফসির সামনে একত্রিত হয়ে হত্যার পরিকল্পনা করে। কার কী কাজ সে বিষয়ে ব্রিফ করে ওমর ফারুক। ছুরি সরবরাহ করে আব্দুল ওয়াহিদ, ছুরি বহন করে ওয়াহিদ, ওমর ফারুক, ফারহান ও জিসান। অ্যাফ্রো, আল আমিন, ইয়াছিন, উৎসব, সজিব, বিজয় এবং আসিফ উপস্থিত থেকে কেএফসির সামনে পরামর্শ করে। তারপর একে একে শাখারী বাজার শনি মন্দিরের সামনে আসে। মাইসার মাধ্যমে নিশ্চিত হয় রনক হোলিতে আসছে। মন্দিরের সামনে ইমনের সাথে রনকের দেখা হলে ইমন তার সাথে কোলাকুলি করে। এরপর ফারহান অ্যাফ্রো রনককে ঘাড় ধরে একপাশে ডেকে আনে। আল আমিন বলে, এটাই কি রনক? ওয়াহিদ বলে, শালারে মারস না কেন? তাহসীন বলে, হাত থাকতে মুখ দিয়া কী? তখন পরিকল্পনাকারী ইমন বলে, তুই বলছিলি না আমার মতো ১০/১২টা ইমন ডেইলি পয়দা করস। এরপর শুরু হয় মারপিট। প্রথমে অ্যাফ্রো একটা চড় মারে। তারপর উৎসব, সজিব, আসিফ, জিসান একে একে সবাই চড়-থাপ্পড়, কিল-ঘুষি মারা শুরু করে। ফারহান প্রথমে চাকু দিয়ে রনককে কোপ দেয়। ওমরও চাকু দিয়ে কোপ দেয়। ওমরের কোপ লাগে অ্যাফ্রোর পায়ে। জিসান, ওয়াহিদও চাকু দিয়ে কোপ দেয় কিন্তু রনকের গায়ে লাগে না। এরপর রনক মারাত্মক জখম অবস্থায় দৌড়ে একজন উকিলের চেম্বারে আশ্রয় নেয়। সেখান থেকে তাকে তারা বের করে একটি চায়ের দোকানের ওপর ফেলে দেয়। চায়ের দোকান তখন বন্ধ ছিল। দোকানটি ভেঙে যায়। এরপর তারা পালিয়ে গেলে রনকের বন্ধু ফাহিম ও মাসুম রনককে প্রথমে ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ও পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক রনকতে মৃত ঘোষণা করেন। উল্লেখ্য, রওনক নিউ পল্টন লাইন স্কুল অ্যান্ড কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিল। রাইজিংবিডি/ঢাকা/১ নভেম্বর ২০১৮/মামুন খান/রফিক