আইন ও অপরাধ

কিশোর প্রেমের বলি রনক

স্বামী মারা যাওয়ার পর একমাত্র ছেলে রনককে নিয়েই যত স্বপ্ন ছিল হেনা বেগমের। সব স্বপ্নই নিমিষে বিলীন হয়ে যায় অপ্রাপ্ত বয়সের অবুঝ প্রেমের কারণে।

মাত্র ১৮ বছর বয়সেই প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে বন্ধুদের সাথে বিবাদে জড়ান তার ছেলে রনক। যার মাশুল দিতে হয়েছে জীবনের বিনিময়ে। হেনা বেগম ছেলের জন্য আহাজারি করে বলেন, ‘বাবাটা বেঁচে থাকলে এখন ২০ বছর পূর্ণ হত। কিন্তু সে তো আর বেঁচে নেই। আমি কি নিয়ে বাঁচবো?’

জানা যায়, রাজধানীর হাজারীবাগে মায়ের সাথে থাকতো রনক। আজিমপুর কবরস্থান সংলগ্ন নিউ পল্টন লাইন স্কুল অ্যান্ড কলেজে দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়তো। কলেজে আসা-যাওয়ার পথেই সম্পর্ক গড়ে ওঠে পলি আক্তার ওরফে তুহুর সাথে। তবে সেই প্রেম বেশিদিন টিকেনি। সেই সম্পর্ক ভুলতে রনক আবার নতুন করে লিজা আক্তার ওরফে মাইসা আলমের সাথে সম্পর্কে জড়ান। কিন্তু তুহুকে ভুলতে পারেননি রনক। এ নিয়ে তুহু এবং তার নতুন প্রেমিক ইয়াছিন আহম্মেদ ওরফে ইমনের সাথে বিরোধে জড়ায় সে। সেই সূত্র ধরে ইমন তার দলবল নিয়ে রনককে খুন করে। পুরান ঢাকায় হোলি উৎসব থেকে ডেকে নিয়ে সংঘটিত হয় এই হত্যাকাণ্ড।

রনক হত্যার ঘটনায় তার মায়ের দায়ের করা মামলার বিচার দুই বছরেও শেষ হয়নি। কবে শেষ হবে তা বলতে পারছেন না সংশ্লিষ্টরা। মামলাটি ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারক কাজী আবদুল হান্নানের আদালতে বিচারাধীন। সর্বশেষ গত ৫ জানুয়ারি মামলাটি পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের জন্য তারিখ ধার্য ছিল। আদালত আগামী ১৬ জানুয়ারী পরবর্তী শুনানির তারিখ ধার্য করেন।

মামলা সম্পর্কে রনকের মা হেনা বেগম বলেন, ‘দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার। রনকের অর্থনীতি পরীক্ষা ছিল। সে আমাকে বলে পরীক্ষার পর কোচিং আছে। কোচিং না হলে চলে আসবো। আমার কাছে ২০০ টাকা চায়। আমি বলি, বাবা আমার কাছে ১২০ টাকা আছে নিয়ে যাও। রনক বলে, মা আমার এ কয় টাকায় তো হবে না। তাকে বলি, বাবা একটু কষ্ট করে চালিয়ে নাও। পরে তোমাকে আবার দিব। যাওয়ার আগে আমাকে জড়িয়ে ধরে, কপালে চুমো খায়। এটাই ছিল ওর সাথে আমার শেষ দেখা। মাইশা নামের একটা মেয়ে ডেকে নেয়। পরে তারা রনককে খুন করে।’

তিনি বলেন, ‘আমি ধানমন্ডি ৩২ নম্বর ছিলাম। সেখান থেকে বাসে করে আজিমপুর নামি। তখন আমার বড় বোন ফোন দেয় রনকের অবস্থা ভালো না। তুই তাড়াতাড়ি হাসপাতালে আয়। আমি বিশ্বাস করিনি। আমি বলি, সুস্থ ছেলে রেখে আসলাম ওর আবার কি হবে। একথা শুনে আমার মাথা ঠিক ছিল না। যা হোক তাড়াতাড়ি করে হাসপাতালে গেলাম। আমাকে তিন ঘন্টা জানানো হয়নি যে আমার ছেলে আর নেই।’

হেনা বেগম বলেন, ‘দুই বছর আগে রনকের বাবা মারা যায়। মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। মা-ছেলে থাকতাম। আশা ছিল, ছেলে পড়ালেখা শেষ করে ভালো একটা চাকরি করবে। মা-ছেলে মিলে ভালো থাকবো। ছেলেটাকেও ওরা মেরে ফেললো। যারা আমার ছেলেকে খুন করেছে তাদের দৃষ্টান্তমূলক সাজা চাই। ন্যায্য বিচার চাই। কিন্তু সেই বিচার কবে পাবো জানি না। বিচার কেন পাই না?’

সংশ্লিষ্ট ট্রাইব্যুনালের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর বিবি ফাতেমা মুন্নি বলেন, ‘মামলাটিতে ১১ আসামির বিরুদ্ধে আদালত চার্জশিট গ্রহণ করেছেন। আসামিদের মধ্যে এক আসামি শুরু থেকে পলাতক। মামলাটি বর্তমানে তার বিরুদ্ধে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের জন্য আছে। বিজ্ঞপ্তির প্রতিবেদন এসে গেলে মামলাটির চার্জগঠন করে সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হবে। সাক্ষীদের হাজির করে যত দ্রুত সম্ভব মামলাটির বিচারকাজ শেষ করতে রাষ্ট্রপক্ষ সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে।’

আসামিপক্ষের আইনজীবী আমিনুল হক, শহিদ উদ্দিন, মুহাম্মদ কামাল হোসেন জানালেন, মামলাটিতে এখনো চার্জগঠন হয়নি। আসামিদের বিরুদ্ধে যদি চার্জগঠন হয় তাহলে সাক্ষ্য প্রমাণের মাধ্যমে নির্দোষ প্রমাণ করতে সচেষ্ট হবো।

২০১৮ সালের ১ মার্চ দুপুর ১২টার দিকে ইমন রনকের প্রেমিকা মাইসার মাধ্যমে শাখারী বাজারে হোলি খেলা দেখার নাম করে তাকে ডেকে আনে। হোলি উৎসবের মধ্যে রনককে ছুরিকাঘাত করা হয়। এরপর তারা তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।

রনক নিহত হওয়ার ঘটনায় তার মা মোসা. হেনা বেগম কোতয়ালী থানায় মামলা দায়ের করেন। মামলাটি তদন্ত করে ২০১৮ সালের ২৬ অক্টোবর ১৪ জনকে অভিযুক্ত করে চার্জশিট দাখিল করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কোতয়ালী থানার ইন্সপেক্টর জানে আলম মুনশী।

চার্জশিটভূক্ত আসামিরা হলেন- ইয়াছিন আহম্মেদ ইমন (১৭), লিজা আক্তার ওরফে মাইসা আলম (১৬),  রিয়াজ আলম ফারহান (১৯), আব্দুল ওয়াহিদ (১৩), ওমর ফারুক (১৬), ফাহিম আহম্মেদ অ্যাফ্রো (১৭), আল আমিন ওরফে ফারাবি খান (১৪), বোরহান উদ্দিন রাব্বানী ওরফে জিসান (১৬), তাহসীন হোসেন বিজয় (১৫), ইয়াছিন ইমন (২০), সজিব মাহমুদ (১৭), আবেদুর রহমান উৎসব (১২), ইয়াছিন আলী (১৭) ও আসিফ (১৯)। ফারহান, ইমন ও আসিফ বাদে ১১ জনই কিশোর। প্রাপ্তবয়স্ক ওই তিন জনের মামলা অন্য আদালতে চলছে। কিশোর ১১ জনের মামলা ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-১ এ চলছে। আসামিদের মধ্যে ওমর ফারুক শুরু থেকে পলাতক রয়েছেন।

চার্জশিটে তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, ‘হত্যাকান্ডটি প্রেমঘটিত। ঘটনার প্রায় এক বছর পূর্বে রনকের সাথে মামলার সাক্ষী পলি আক্তার ওরফে তুহুর প্রেমের সম্পর্ক ছিল। রনক-তুহুর সম্পর্ক তাদের অভিভাবকরা জেনে গেলে রনকের মা তুহুকে রনকের সাথে সম্পর্ক না রাখার জন্য চাপ প্রয়োগ করেন। দুই পক্ষের অভিভাবকদের মধ্যে রনক ও তুহুর সম্পর্ক না রাখার বিষয়ে সালিশও হয়। এরপর তুহুর সাথে ইয়াছিন আহম্মেদ ওরফে ইমনের পরিচয় হয় ও প্রেমের সম্পর্ক হয়। এই প্রেমের সম্পর্ক রনক জানার পর ইমন ও রনকের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে তুহুকে নিয়ে ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ ও মোবাইল ফোনে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রকম কথা চালাচালি এবং পরস্পরকে ভয়ভীতি-হুমকি প্রদর্শন ও গালি-গালাজ করতো। তাদের সম্পর্কের চরম অবনতি ঘটে। এ সময় ইমন রনককে হত্যার পরিকল্পনায় লিপ্ত হয়।’

তদন্ত কর্মকর্তা উল্লেখ করেন, ১ মার্চ ইমন রনকের আরেক প্রেমিকা মাইসার মাধ্যমে তাকে শাখারী বাজারে হোলি খেলা দেখার নাম করে ডেকে আনে। পরে পূর্বপরিকল্পনার অংশ হিসেবে আসামিরা রনককে গালি-গালাজ, কিল-ঘুষি ও ছুরিকাঘাত করে মারাত্মক আহত ও রক্তাক্ত করে। পরে হাসপাতালে নেওয়ার পথে রনক মারা যায়।

 

ঢাকা/মামুন খান/টিপু