আইন ও অপরাধ

‘সাজানো-গোছানো রুমে নেই শুধু অরিত্রী’

‘সেই গিটার। টেবিলের ওপর সাজানো বই। গোছানো বিছানা। সবকিছুই যেন ঠিক আগের মতই আছে। তবুও রঙ্গিন ঘরটি অন্ধকারে আচ্ছন্ন। এই ঘরটির আলো ছিলো অরিত্রী। আজ সে নেই। কিন্তু তার রেখে যাওয়া স্মৃতি বুকে আঁকড়ে বেঁচে আছি আমরা।’

অরিত্রীকে হারানোর দিনে তার কথা স্মরণ করে কথাগুলো বলেন অরিত্রী অধিকারীর বাবা দিলীপ অধিকারী।  ২০১৮ সালের এই দিনে (৩ ডিসেম্বর) স্কুল থেকে ছাড়পত্র (টিসি) দেওয়ায় এবং শিক্ষার্থীর সামনে বাবা-মাকে অপমান করায় ভিকারুননিসা নূন স্কুলের প্রধান শাখার ছাত্রী অরিত্রী অধিকারীর (১৫) আত্মহত্যা করেন।

এ ঘটনায় তার বাবা রাজধানীর পল্টন থানায় মামলা করেন। মামলাটি তদন্ত করে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ নাজনীন ফেরদৌস ও শাখাপ্রধান জিনাত আক্তারকে অভিযুক্ত করে চার্জশিট দাখিল করে ডিবি পুলিশ।   গত বছর ১০ জুলাই আসামিদের বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন ঢাকার তৃতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ রবিউল আলম। চার্জ গঠনের ১৭ মাস পার হলেও মামলাটিতে এখন পর্যন্ত মাত্র তিন জনের সাক্ষ্যগ্রহণ করেছেন আদালত। আগামী ৯ ডিসেম্বর মামলাটির পরবর্তী সাক্ষ্যগ্রহণের তারিখ ধার্য করেন আদালত।

অরিত্রীর বাবা বলেন, ‘মেয়েকে হারিয়েছি দুই বছর হয়ে গেলো। আমাদের অপমান সহ্য করতে না পেরে মেয়েটা চলে গেলো। সে তো মরে গিয়ে বেঁচে গেছে। কিন্তু আমরা তো তাকে ছাড়া মোটেই ভালো থাকতে পাচ্ছি না। শিক্ষকরা এমন দুর্ব্যবহার করেন জানা ছিল না। সেদিন যদি তারা আমাদের আলাদা ডেকে নিয়ে কথাগুলো বলতেন তাহলে আর মেয়েকে হারাতে হতো না।’

মেয়েকে তো আর ফিরে পাওয়া যাবে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘তার সঙ্গে যারা খারাপ ব্যবহার করেছে, যাদের জন্য ওকে পৃথিবী ছেড়ে অকালে চলে যেতে হয়েছে তাদের যেন দৃষ্টান্তমূলক সাজা হয়, সে জন্য লড়ে যাবো। যেন আর কোনো মা-বাবাকে এ অবস্থা দেখতে না হয়।’

স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, ‘প্রতিটা জায়গায় অরিত্রীর স্মৃতি। ও যে রুমে ছিলো সে রুমটা এখনো সে রকমই রয়েছে। সাজানো গোছানো। সেই রুমে শুধু অরিত্রী নেই। ওই রুমে ডুকলেই নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। সইতে পারিনা। এ থেকে মুক্তি চাই। মেয়েটা চলে গেছে, কিছুই করতে পারিনি। ভাবছি এই বাসাটা ছেড়ে দিবো। যদি ক্ষণিকের জন্য তার স্মৃতি ভুলে থাকা যায়।’

স্বল্প সময়ের মধ্যে অরিত্রীর মামলার বিচার শেষ হবে এমন আশা ব‌্যক্ত করে তিনি বলেন, ‘যারা অন্যায় করছে, সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে লড়ে যাচ্ছি। আদালত আশ্বস্ত করেছে, ন্যায়বিচার পাবো। আদালতের ওপর ভরসা রাখছি। হাল ছাড়বো না। ন্যায়বিচার নিশ্চিতে সর্বোচ্চ লড়ে যাবো।’

অরিত্রীর মা বিউটি অধিকারী বলেন, ‘দুই বছর হলো মেয়েটা নেই। ওকে ছাড়া ভীষণ কষ্টে দিন কাটছে। হাঁটতে, চলতে ওর কথা মনে পড়ে। রান্নাঘর বা বারান্দায় যখন দাঁড়িয়ে থাকি, তখন যদি কোনো শিক্ষার্থীকে দেখি স্কুল ড্রেস পড়ে যাচ্ছে, তখন মনের ভেতর হাহাকার করে। তখন আর নিজেকে স্থির রাখতে পারি না।’

রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী সাবিনা আক্তার (দিপা) বলেন, ‘এটি একটি আলোচিত মামলা। অপমান সইতে না পেরে অরিত্রীকে পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হয়েছে। অরিত্রীর বাবা-মা মেয়েকে হারিয়েছে। মামলাটির বিচারকাজ শেষ করতে আমরা তৎপর আছি। মামলাটিতে তিন জনের সাক্ষ্য শেষ হয়েছে। পর্যায়ক্রমে সাক্ষী এনে মামলাটির বিচারকাজ দ্রুত এগিয়ে নেব। মামলাটির বিচার যেন দ্রুত শেষ হয় এবং ভূক্তভোগীরা যেন ন্যায় বিচার পান এজন্য আমরা চেষ্টা করে যাবো।’

অরিত্রীর আত্মহত্যায় ঘটনায় রাজধানীর পল্টন থানায় তার বাবা দিলীপ অধিকারী বাদী হয়ে গত ৪ ডিসেম্বর মামলা দায়ের করেন। 

মামলায় তিনজনকে আসামি করা হয়। মামলা দায়েরের পর ৫  ডিসেম্বর শ্রেণি শিক্ষক হাসনা হেনাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরের দিন আদালত জামিন নামঞ্জুর করে তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। পরে ৯ ডিসেম্বর জামিন পান হাসনা হেনা। ১৪ জানুয়ারি মামলার দুই আসামি নাজনীন ফেরদৌস ও জিনাত আক্তার আত্মসমর্পণ করে জামিন নেন।