আইন ও অপরাধ

বর্ষবরণে যৌন হয়রানি: সাক্ষী না আসায় থমকে আছে বিচার

বাঙালীর সংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সঙ্গে অঙ্গাঅঙ্গীভাবে জড়িত বৈশাখী উৎসব। অঞ্চলভেদে ভিন্ন ভিন্ন আয়োজনে উদযাপিত হয় দিনটি। 

তার ধারাবাহিকতায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসটি ঘিরে তারুণ্যের মেলায় উচ্ছ্বাসের বন্যা বয়ে যায়। সব শ্রেণি পেশার মানুষের অংশগ্রহণে মুখরিত থাকে পুরো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। এ যেন বাঙালী চেতনার মিলনমেলা। বর্ষবরণের সুন্দর এই উৎসবেও কলঙ্কের দাগ লেগেছে ২০১৫ সালে। পহেলা বৈশাখে বর্ষবরণের অনুষ্ঠানে টিএসসিতে ঘটে যৌন হয়রানি।

ঘটনার পর নিন্দা ও প্রতিবাদে কেঁপে ওঠে পুরো দেশ। জাতির প্রত্যাশা ছিল ঘটনার তদন্ত ও দ্রুত বিচার সম্পন্ন হবে। কিন্তু দেখতে দেখতে পাঁচ বছর কেটে গেলেও শেষ হয়নি মামলার বিচার।  ৮ জন আসামির মধ্যে সাতজনকে এখনো গ্রেপ্তারই করা সম্ভব হয়নি। মো. কামাল নামের এক আসামিকে নিয়েই মামলার বিচারকাজ অত্যন্ত ধীর গতিতে চলছে। মামলাটিতে শুধু তারিখ আসে আর তারিখ যায় এভাবেই চলছে। সাক্ষী না আসায় থমকে আছে মামলার বিচার। মামলাটির বিচার কবে শেষ হবে বলতে পারছে না সংশ্লিষ্টরা।

মামলাটি ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৮ এর বিচারক বেগম মাফরোজা পারভীনের আদালতে মামলাটি বিচারাধীন। ২০১৭ সালের ১৯ জুন মামলাটিতে একমাত্র আসামি কামালের বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করা হয়। কিন্তু প্রায় চার বছর একজন সাক্ষীও আদালতে সাক্ষী দিতে আসেননি। এজন্য আদালত চার্জশিটভূক্ত ১ থেকে ৫ নম্বর সাক্ষীর প্রতি অজামিনযোগ্য গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন। সর্বশেষ গত ৫ এপ্রিল মামলাটি সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য ধার্য ছিল। কিন্তু করোনাভাইরাসের প্রার্দুভাবরোধে সরকার দেশে লকডাউন ঘোষণা করে। এজন্য আদালতও সাধারণ ছুটিতে যায়। যার ফলে ওইদিনও সাক্ষ্যগ্রহণ হয়নি। লকডাউন শেষে সাধারণ ছুটি শেষে মামলাটির শুনানি হবে বলে জানা গেছে।

সংশ্লিষ্ট ট্রাইব্যুনালের রাষ্ট্রপক্ষের স্পেশাল পাবলিক প্রসিকিউটর মোহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, ‘মামলাটি প্রথমে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৩, এরপর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৫ এ বিচারাধীন ছিল। পরবর্তীতে মামলাটি এ আদালতে বিচারের জন্য বদলি করা হয়েছে। রাষ্ট্রপক্ষ থেকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে মামলাটি পরিচালনা করা হচ্ছে। আর এ মামলার বাদী পুলিশ। আবার অধিকাংশ সাক্ষীই পুলিশ। তারা অনেকে শাহবাগ থানায় কর্মরত ছিলেন। এখন অনেকে অনেক জায়গায় বদলি হয়ে গেছেন। সাক্ষীদের আদালতে আনার দায়িত্বও কিন্তু পুলিশের। আমরা আদালত থেকে সাক্ষীদের হাজির করতে সমন পাঠাচ্ছি। সেই সমন তার পান বা না পান এটা আমরা জানি না। কারণ সমন না পেলে সেটা আবার ফিরেও আসে না।’

মোহাম্মদ রেজাউল করিম আরও  বলেন, ‘আমরা সাক্ষীদের আনার চেষ্টা করছি। মাঝে লকডাউনের কারণে আদালত ছুটিতে ছিল। আবার লকডাউন শুরু হয়েছে। আদালতের কার্যক্রম শুরু হলে সাক্ষী হাজিরের চেষ্টা করবো। এখন মামলাটির তারিখও পড়ছে প্রতি মাসে। সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো সাক্ষী হাজির করে মামলাটির বিচার দ্রুত শেষ করতে।’

আসামিপক্ষের আইনজীবী আনিসুর রহমান বলেন, ‘মামলার এজাহারে কামালের নাম ছিল না। পুন:তদন্তে চার্জশিটে তার নাম এসেছে। তিনি একজন ডায়াবেটিস রোগী। লালবাগের খাজী দেওয়ানে তিনি ফুটপাতে সবজির ব্যবসা করতেন। যেহেতু তিনি ডায়াবেটিস রোগী, এজন্য ওইদিন তিনি বের হয়েছিলেন হাঁটাহাটি করার জন্য। ওই ঘটনা ঘটার পরে জায়গাটা ফাঁকা হয়ে যায়। এরপর কামাল সেখানে হাঁটাহাটি করতে যায়। সেখানে যে কোনো ঘটনা ঘটছে, সে বিষয়ে কামাল কোনো কিছু জানতেন না। তিনি হেঁটে এসেছিলেন আর তার ছবি ওই ভিডিও ফুটেজে এসেছে। এরপর তদন্ত কর্মকর্তা তাকে গ্রেপ্তার করেছে। ভিডিও ফুটেজে এমন কিছু আসেনি যে, তিনি কাউকে ধরছেন, টানছে বা শ্লীলতাহানি করছে। ভিডিও ফুটেজে তার ছবি আসার কারণে তাকে মামলায় জড়ানো হয়েছে। তিনি অপরাধ সম্পর্কে কিছুই জানেন না।’

এই আইনজীবী বলেন, ‘ওই ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত প্রকৃত আসামিদের পুলিশ গ্রেপ্তার করতে ব্যর্থ হয়েছে। যেনতেনভাবে চার্জশিট দিয়ে নিরাপরাধ ব্যক্তিকে মামলায় সম্পৃক্ত করেছে। মামলাটি সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য আছে। অথচ চার বছরে কোনো সাক্ষী সাক্ষ্য দিতে আসছেন না। আসামির নিয়মিত আদালতে হাজিরা দিতে হচ্ছে। তিনি ভোগান্তির শিকার।  ন্যায় বিচার সকলের প্রত্যাশা। প্রকৃত আসামিদের গ্রেপ্তার না করে অযথা, ভুলভাবে তাকে মামলায় গ্রেপ্তার করেছে। আমরা ন্যায় বিচার আশা করছি। আর ন্যায় বিচারে আসামি খালাস পাবেন।’

উল্লেখ‌্য, ২০১৫ সালের পহেলা বৈশাখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসটি এলাকায় কয়েকজন নারীকে যৌন হয়রানি করা হয়। ওই ঘটনায় ভিকটিমদের পক্ষ থেকে কেউ মামলা না করায় শাহবাগ থানার উপ-পরিদর্শক আবুল কালাম আজাদ বাদী হয়ে যৌন হয়রানির অভিযোগে অজ্ঞাতদের আসামি করে মামলা দায়ের করেন। শাহবাগ থানার পুলিশ মামলাটি কয়েকদিন তদন্তের পরই তদন্তভার ডিবি পুলিশকে দেওয়া হয়।

মামলার একমাস পর ১৭ মে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরার ভিডিও থেকে আটজন যৌন হয়রানিকারীকে শনাক্ত ও তাদের ছবি পাওয়ার কথা জানান তৎকালীন পুলিশ প্রধান একেএম শহীদুল হক। শনাক্তদের ধরিয়ে দিতে এক লাখ টাকা করে পুরস্কার ঘোষণা করে পুলিশ। কিন্তু তাদের নাম-ঠিকানা না পাওয়ার অজুহাতে ২০১৫ সালের ৯ ডিসেম্বর মামলার তদন্ত কর্মকর্তা গোয়েন্দা পুলিশের এসআই দীপক কুমার দাস আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। ওই চূড়ান্ত প্রতিবেদনও গ্রহণ করেন ট্রাইব্যুনাল। পরে শনাক্ত আসামিদের মধ্যে মো. কামাল (৩৫) গ্রেপ্তার হলে তাকে প্রথমে ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে মামলাটি পুনঃতদন্তের আবেদন করা হয়।

২০১৬ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকার তিন নম্বর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল মামলাটি পুনঃতদন্তের আদেশ দেন। পুনঃতদন্ত শেষে ২০১৬ সালের ১৫ ডিসেম্বর পিবিআইয়ের পরিদর্শক আব্দুর রাজ্জাক একমাত্র আসামি কামালকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন। ২০১৭ সালের ১৯ জুন ঢাকার তিন নম্বর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক জয়শ্রী সমাদ্দার ওই আসামির বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করেন। এরপর সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য প্রায় ১৪টি ধার্য তারিখ পার হলেও কোনো সাক্ষী আদালতে সাক্ষ্য দিতে আসেননি। এজন্য আদালত তাদের বিরুদ্ধে অজামিনযোগ্য গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন।

এদিকে, মামলার একমাত্র আসামি কামাল জামিনে আছেন। হাইকোর্ট থেকে তিনি জামিন পেয়েছেন।