আইন ও অপরাধ

মোহাম্মদপুরে ১৩ হত্যাকাণ্ড: সাক্ষী আসে না, ঝুলে আছে বিচার

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাঙালি জাতি জীবনে একটি কালো অধ্যায়।  ওইদিন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার ঘটনায় দায়ের করা মামলার বিচার শেষ হলেও একইদিন খুনিদের দিকবেদিক ছোঁড়া কামানের গোলায় মোহাম্মদপুরে শেরশাহ সুরী রোডে ১৩ জন নিহতের মামলার বিচার এখনো শেষ হয়নি। সাক্ষী না আসায় থমকে আছে বিচার। তবে সাক্ষী হাজির করে মামলার বিচার দ্রুত শেষ করার কথা জানিয়েছে রাষ্ট্রপক্ষ।

ওই ঘটনায় দায়ের করা মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে প্রায় ১৫ বছর আগে চার্জগঠন করে বিচার শুরু করেন আদালত। তবে এতদিনেও মামলার বিচার কাজ শেষ হয়নি।  ঢাকার চতুর্থ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে মামলাটি এখন সাক্ষ্য গ্রহণের পর্যায়ে আছে। আগামী ২৫ আগস্ট মামলা সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য ধার্য রয়েছে।

মামলা সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট আদালতের রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলী সাইফুল ইসলাম হেলাল বলেন, করোনাসহ বিভিন্ন কারণে গত দেড় বছর ধরে আদালতে কোনো সাক্ষ্য হয়নি। আমরা সাক্ষীদের একাধিকবার সমন পাঠিয়েছি।  আইজিপি, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিবের মাধ্যমে সমন দেওয়া হলেও কোনো সাক্ষী আসে নাই।  এই মামলায় একটু ডিফেক্ট আছে বলা যায়।  বঙ্গবন্ধু হত্যার মামলার যারা আসামি ছিলেন তাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে।  বঙ্গবন্ধুর হত্যার সাথে যারা জড়িত তারা সবাই এই মামলার আসামি।  পলাতক ১২ জন আসামির মধ্যে ৬ জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।  এই ৬ জনের মৃত্যুদণ্ডের গেজেট দিতে হয়, সেটা এখনো সরকার থেকে দেওয়া হয়নি।  এই গেজেট মন্ত্রণালয় থেকে একাধিকবার চেয়েও পাওয়া যায়নি। মামলায় রায়ের সময় যাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে সেই স্টেটমেন্ট লাগবে মামলার নথিতে। কিন্তু এখন পর্যন্ত দেয়নি।  মামলা রায় দিতে এগুলো উল্লেখ করতে হবে।

তিনি বলেন, একদিকে লকডাউন আবার কিছুদিন বিচারক ছুটিতে থাকায় মামলার বিচারকাজ কিছুটা বিলম্বিত হয়েছে। আবারও নতুন বিচারক এসেছে।  করোনার জন্য দেড় বছর ধরে মামলার বিচারকার্য থমকে ছিলো।  বিচারিক কার্যক্রম আবারও শুরু হয়েছে।  আশা করি, দ্রুত মামলার বিচারকার্য শেষ করতে পারবেন আদালত।

পলাতক আসামিদের পক্ষে রাষ্ট্র থেকে নিযুক্ত আইনজীবী মাহফুজুর রহমান চৌধুরী বলেন, আদালত আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেছে।  সাক্ষীও হয়েছে।  তবে ওখানে কোনো প্রত্যক্ষ সাক্ষী নেই।  এই মামলার ফৌজদারি কার্যবিধি আইনের ১৬৪ ধারায় কোনো জবানবন্দি নেই। কোন কিছুই নেই।  মামলা অনেক সেনসেটিভ।  আশা করি, মামলার রায়ে আসামিরা ন্যায় বিচার পাবে।

তার স্ত্রী শাহনাজ আক্তার মেরিনা বলেন, মোহাম্মদ আলী শারীরিক ও মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। অসুস্থ হয়ে বর্তমানে তিনি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন আছেন। চিকিৎসায় অনেক টাকার প্রয়োজন। কিন্তু আমাদের সামর্থ নেই তার চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করা। তিনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। দীর্ঘদিন তিনি মোহাম্মদপুর থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের রাজনীতি করেছেন।  এ মামলা নিয়ে তিনি বহু লড়েছেন।  কিন্তু বিনিময়ে তিনিসহ ভুক্তভোগী পরিবারগুলো কিছুই পাননি। প্রধানমন্ত্রী চাইলেই এ পরিবারগুলো মানবেতর জীবনের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে পারে। ওই ঘটনায় নিহত ও আহত হতদরিদ্র পরিবারগুলোর পুনর্বাসনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর সদয় দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তিনি।’

প্রসঙ্গত, ৪৩ বছর আগের ওই হত্যার ঘটনায় মামলা হয় ১৯৯৬ সালে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোর সাড়ে ৫টার দিকে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাড়ি আক্রমণের সময় সেনা সদস্যরা কামানের গোলা ছুঁড়লে তা গিয়ে মোহাম্মদপুরের শেরশাহ সুরী রোডর ৮ ও ৯ এবং ১৯৬ ও ১৯৭ নম্বর বাড়ির (টিনশেড বস্তি) ওপর পড়ে।  লেফট্যানেন্ট কর্নেল মুহিউদ্দিন আহমেদের (আর্টিলারি) ছোড়া কামানের গোলার বিকট শব্দে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে গোটা এলাকা। মুহূর্তে ধুলায় মিশে যায় ওই বস্তি। ওই ঘটনায় নারী ও শিশুসহ ১৩ জন মারা যায়।  প্রায় ৪০ জন আহতের মধ্যে কয়েকজন পুরুষ সারাজীবনের জন্য পঙ্গুত্ব বরণ করে।  নিহতরা হলো রিজিয়া বেগম ও তার ছয় মাসের মেয়ে নাসিমা, কাশেদা বেগম, ছাবেরা বেগম, সাফিয়া খাতুন, আনোয়ারা বেগম (প্রথম), ময়ফুল বিবি, আনোয়ারা বেগম (দ্বিতীয়), হাবিবুর রহমান, আবদুল্লাহ, রফিজল, সাহাব উদ্দিন আহম্মেদ ও আমিন উদ্দিন আহম্মেদ।

ওই ঘটনায় ৮ নম্বর বাড়ির মালিক মোহাম্মদ আলী বাদী হয়ে ১৯৯৬ সালের ২৯ নভেম্বর মোহাম্মদপুর থানায় এ মামলা দায়ের করেন। ২০০১ সালের এপ্রিলে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে।  এরপর ২০০৬ সালের ১ নভেম্বর এ মামলায় ১৭ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন আদালত।

১৭ আসামির মধ্যে ২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত ৫ জনের ফাঁসি কার্যকর করা হয়।  এরা হলেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) সৈয়দ ফারুক রহমান, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব্যাহতিপ্রাপ্ত) সুলতান শাহরিয়ার রশিদ, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) মুহিউদ্দিন আহমেদ, মেজর (অব.) বজলুল হুদা ও মেজর (অব্যাহতিপ্রাপ্ত) একেএম মহিউদ্দিন আহমেদ। ওই পাঁচজন ছাড়া এ মামলায় প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী তাহের উদ্দিন ঠাকুরকে (প্রয়াত) গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছিল।  গত ১২ এপ্রিল ক্যাপ্টেন (অব.) আবদুল মাজেদেরও ফাঁসি কার্যকর হয়।

এখনো পলাতক রয়েছেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব্যাহতিপ্রাপ্ত) শরিফুল হক ডালিম, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (বরখাস্ত) খন্দকার আবদুর রশিদ, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অবসরপ্রাপ্ত) এসএইচএমবি নূর চৌধুরী ইবি, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) এএম রাশেদ চৌধুরী, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব্যাহতিপ্রাপ্ত) আহমদ শরিফুল হোসেন ওরফে শরিফুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন (অব্যাহতিপ্রাপ্ত) মো. কিসমত হাসেম, ক্যাপ্টেন (অব.) নাজমুল হোসেন আনসার, রিসালদার (অবসরপ্রাপ্ত) মোসলেম উদ্দিন ওরফে মোসলেহ উদ্দিন, দফাদার মারফত আলী ও এলভি মো. আলী হোসেন মৃধা।