আইন ও অপরাধ

আবরার হত্যা: আদালতে যা বললো আসামি জিয়ন ও রাসেল

বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যার মামলার দুই আসামি ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৪০(৩) ধারায় নিজেদের পক্ষে সাফাই সাক্ষ্য দিয়েছেন।

রোববার (২২ আগস্ট) ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারক আবু জাফর মো. কামরুজ্জামানের আদালতে আসামি মেফতাহুল ইসলাম জিয়ন এবং বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান রাসেল সাফাই সাক্ষ্য দেন। আগামীকাল সোমবারও এ মামলায় সাফাই সাক্ষ্যের দিন ধার্য আছে।

মেফতাহুল ইসলাম জিয়ন আদালতে দাবি করে, আবরার হত‌্যা মামলার অন্য কোনো আসামির সঙ্গে তার যোগসাজশ ছিল না। আবরারকে পেটানোর সময় সে বুয়েটের শেরেবাংলা হলের মেস ম্যানেজারের দায়িত্বে ছিল। ২০১৯ সালের ৭ অক্টোবর রাতে সে তার কক্ষে যাওয়ার সময় বুয়েটের কয়েকজন ছাত্র, কয়েকজন পোশাকধারী ও সাদা পোশাকের পুলিশ সদস‌্যকে দেখতে পায় সে। ছাত্রদের মধ্য থেকে একজন তাকে দেখিয়ে পুলিশকে ইঙ্গিত করে। একজন পুলিশ অফিসার তাকে জিজ্ঞাসা করেন, সে ছাত্রলীগ করে কি না? উত্তরে জিয়ন জানায়, সে ছাত্রলীগের কর্মী। তখন পুলিশ তাকে তাদের সঙ্গে যেতে বলে। তাকে ডিবি কার্যালয়ের একটি সেলে আটকে রাখা হয়। 

জিয়ন আরও দাবি করে, এরপর জামিল নামের একজন অফিসার তার কাছে আবরারের মৃত্যুর ঘটনা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেন। সে পুলিশকে জানায়, আবরার নামে কাউকে সে চেনে না এবং কোনোদিন দেখেনি। তখন জামিল রেগে গিয়ে তার পায়ে আঘাত করে, কিল-ঘুষি ও চড় থাপ্পড় মারতে থাকে। তখন সে খুব অসুস্থ বোধ করে। এর পরদিন তাকে আদালতে নেওয়া হয়। আদালত পাঁচ দিনের রিমান্ডের আদেশ দেন। এর পর ২০১৯ সালের ৮ অক্টোবর রাজিব নামের এক পুলিশ কর্মকর্তার রুমে তাকে নেওয়া হয়। তিনিও জিয়নকে আবরারের বিষয়ে জিজ্ঞাসা করেন। জিয়ন একই উত্তর দিলে রাজিব তাকে কিল-ঘুষি দিয়ে গলা চেপে ধরে দেয়ালের দিকে ছুঁড়ে মারেন। এতে জিয়ন পড়ে যায়। এরপর আবার পরদিন তাকে রাজিবের কক্ষে নেওয়া হয়। সেখানে তাকে প্রচুর মারপিট ও শারীরিক নির্যাতন করা হয়।

জিয়ন জানায়, তাকে খাবার-দাবার, এমনকি পানি পর্যন্ত দেওয়া হয়নি। এতটাই মারপিট করা হয় যে, জিয়ন সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি এবং হাত-পায়ের যন্ত্রণায় রাতে ঘুমাতে পারেনি। এরপর তার চোখ এবং হাত-পা বেঁধে সেল থেকে বের করে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে নিয়ে তার বুকের ওপর চাপ দিয়ে মাথায় একটি নল ঠেকিয়ে বলা হয়, সে যদি কথামতো কাজ না করে, তাহলে তাকে ক্রসফায়ারে দেওয়া হবে। আজকেই হবে জিয়নের জীবনের শেষ দিন। আর যদি জিয়ন কথামতো কাজ করে তাহলে আর টর্চার করা হবে না। তখন জিয়ন জীবন বাঁচাতে তাদের কথায় রাজি হয়। এরপর তার হাতের ও পায়ের বাঁধন খুলে অন্য এক জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে নিয়ে তার চোখের বাঁধন খুলে দিলে সে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ওয়াহিদুজ্জামানকে দেখতে পায়। তদন্ত কর্মকর্তা কিছু কাগজে জিয়নকে স্বাক্ষর করতে বলেন। সে ভয়ে স্বাক্ষর করে। এরপর তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, কাল যেখানে নিয়ে যাব, সেখানে গিয়ে একই কথা বলতে এবং একই কাজ করতে। ম্যাজিস্ট্রেটকে যদি বলে যে, আবরার হত্যার বিষয়ে জানে না, তাহলে তাকে আবার রিমান্ডে নিয়ে ক্রসফায়ারে দেওয়া হবে। চার-পাঁচ দিন এভাবে রাখার পর তাকে ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে নেওয়া হয়। সেখানে এনে তদন্ত কর্মকর্তার প্রিন্ট করা একটি কাগজ দেখে ম্যাজিস্ট্রেট আবার প্রিন্ট করেন। তারপর তাকে স্বাক্ষর করতে বলা হয়। জিয়ন ভয়ে ইচ্ছের বিরুদ্ধে স্বাক্ষর করে।

জিয়ন পুনরায় দাবি করে, আবরার হত‌্যাকাণ্ডের সঙ্গে সে জড়িত নয়।

মেহেদী হাসান রাসেল তার সাক্ষ্যে বলে, ঘটনার দিন সে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের অনুষ্ঠানে গিয়েছিল। এ ঘটনা সম্পর্কে কিছুই জানে না সে। রাতে সে নিজের কক্ষে ঘুমিয়ে ছিল। রাত ৩টা ২০ মিনিটে একজন ছাত্র এসে জানায়, একটি ছেলেকে কারা যেন পিটিয়েছে, খুব সমস্যা হয়েছে। সে তাৎক্ষণিক সেখানে ছুটে যায়। গিয়ে দেখে একটি নিথর দেহ পড়ে আছে, পাশে ডাক্তার দাঁড়িয়ে আছে।

রাসেল আরও জানায়, পরদিন সকাল ৭টার দিকে সে চকবাজার থানায় যায়। পুলিশ তাকে আটক করে। পরদিন তাকে ডিবি অফিসে নেওয়া হয়। সেখান থেকে আদালতে আনা হয়। আদালত পাঁচ দিনের রিমান্ড দেন। তাকে কিছুই জিজ্ঞাসাবাদ না করে ৪-৫ দিন পরে তাকে আবার আদালতে আনা হয়। আদালত তাকে কেরানীগঞ্জের কারাগারে পাঠিয়ে দেয়।

রাসেল দাবি করে, সে আবরার হত‌্যাকাণ্ডের আদ্যোপান্ত কিছুই জানে না। ঘটনার রাতে ৩টা ২০ মিনিটের আগে তার কোনো ভিডিও ফুটেজ কোথাও পাওয়া যাবে না। এরপর প্রমাণ হিসেবে ওবায়দুল কাদেরের সভাস্থলে থাকার ছবি আদালতে জমা দেন মেহেদী হাসান রাসেলের আইনজীবী আজিজুর রহমান দুলু।

উল্লেখ্য, ২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর রাতে বুয়েটের শেরেবাংলা হলে আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যা করে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এ ঘটনায় ১৯ জনকে আসামি করে পরের দিন ৭ অক্টোবর চকবাজার থানায় একটি হত্যা মামলা করেন আবরার ফাহাদের বাবা বরকত উল্লাহ। ওই বছরের ১৩ নভেম্বর ২৫ জনকে অভিযুক্ত করে চার্জশিট দাখিল করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ঢাকা মহানগর (দক্ষিণ) ডিবির পরিদর্শক ওয়াহেদুজ্জামান। গত বছরের ১৫ সেপ্টেম্বর ২৫ আসামির বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করে বিচার শুরু করেন আদালত। মামলাটিতে ৬০ জন সাক্ষীর মধ্যে ৪৬ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করেন আদালত। গত ১৪ মার্চ এ মামলায় কারাগারে থাকা ২২ আসামি আদালতে নিজেদের নির্দোষ দাবি করে। অপর তিন আসামি পলাতক থাকায় আত্মপক্ষ শুনানি করতে পারেনি।