আইন ও অপরাধ

‘গ্রাহকের দায় নিয়ে ব্যবসা শুরু করে ইভ্যালি’ 

ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ইভ্যালি প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে লোকসানি কোম্পানি। তারা কোনো ব্যবসায়িক লাভ করতে পারেনি। গ্রাহকের অর্থ দিয়েই যাবতীয় ব্যয় ও খরচ নির্বাহ করা হতো।  দিন দিন প্রতিষ্ঠানটি গ্রাহকদের কাছে দেনা বৃদ্ধি পেতে থাকে বলে র‌্যাবের প্রাথমিক তদন্তে বেরিয়ে এসেছে।

আরও পড়ুন: ইভ্যালিকে দেউলিয়া ঘোষণার পরিকল্পনা ছিল রাসেলের: র‌্যাব

শুক্রবার (১৭ সেপ্টেম্বর) সকালে র‌্যাব সদর দপ্তরে সংবাদ সম্মেলনে  সংস্থাটির মুখপাত্র কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, ইভ্যালির কারসাজির মাধ্যমে লাখ লাখ গ্রাহকের অর্থ হাতিয়ে নিয়ে পণ্য ডেলিভারি না দেওয়ার বিষয়টি দেশব্যাপী ব্যাপক চাঞ্চলের সৃষ্টি হয়।  প্রতারিত হয় সাধারণ মানুষ।  বিভিন্ন লোভনীয় অফার দেখিয়ে প্রলুব্ধ করে সাধারণ জনগণের কষ্টার্জিত অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে।

র‌্যাব জানায়, রাসেল ২০০৭ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স সম্পন্ন করেন এবং পরবর্তী সময়ে তিনি ২০১৩ সালে এমবিএ সম্পন্ন করেন। ২০০৯ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত একটি কোচিং সেন্টারে শিক্ষকতা করেন। ২০১১ সালে তিনি ব্যাংকে চাকরি শুরু করেন।  প্রায় ৬ বছর ব্যাংকে চাকরি করেন।  ২০১৭ সালে ব্যাংকের চাকরি ছেড়ে ব্যবসা শুরু করেন। এক বছর শিশুদের ব্যবহার্য একটি আইটেম নিয়ে ব্যবসা করেন এবং অতঃপর তিনি ওই ব্যবসা বিক্রি করে দেন।  ২০১৮ সালে পূর্বের ব্যবসালব্ধ অর্জিত অর্থ দিয়ে ইভ্যালি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন।  ২০১৮ সালের ডিসেম্বর মাসে ইভ্যালি কার্যক্রম শুরু হয়। এরপর থেকেই রাসেল ও তার স্ত্রী শামীমার শুরু হয় বিলাসী জীবনযাপন।  গ্রাহকদের কাছে কোম্পানির ব্যানারে শুরু করেন চমকপ্রদ সব অফার।  এভাবে প্রায় ৪৪ লাখ গ্রাহকের কাছ থেকে  প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেন।

আরও পড়ুন: ইভ্যালির রাসেল ও তার স্ত্রী ৩ দিনের রিমান্ডে

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ইভ্যালি ছাড়াও রাসেলের আরও কয়েকটি ব্যবসায়িক প্ল্যাটফর্ম রয়েছে। এর মধ্যে ই-ফুড, ই-খাতা, ই-বাজার ইত্যাদি। ইভ্যালির ব্যবসায়িক কাঠামো শুরু হয়েছিল নিজস্ব বিনিয়োগ দিয়ে।  তার ব্যবসায়িক স্ট্যাটিজি ছিল তৈরিকারক ও গ্রাহক চেইন বা নেটওয়ার্ক থেকে বিপুল অর্থ তুলে নেওয়া।  বিশাল অফার, ছাড়ের ছড়াছড়ি আর ক্যাশব্যাকের অফার দিয়ে সাধারণ জনগণকে প্রলুব্ধ করতেন। দ্রুততম সময়ে ক্রেতা বৃদ্ধি করে।

র‌্যাব জানায়, ইভ্যালির অফারগুলো হলো- সাইক্লোন অফার (বাজার মূল্যের অর্ধেক মূল্যে পণ্য বিক্রয়); ক্যাশব্যাক অফার (মূল্যের ৫০-১৫০% ক্যাশব্যাক অফার); আর্থকুয়েক অফার, প্রায়োরিটি স্টোর, ক্যাশ অন ডেলিভারি। এছাড়া বিভিন্ন উৎসবেও ছিল জমজমাট অফার; যেমন-বৈশাখী, ঈদ অফার ইত্যাদি।

শুক্রবার (১৭ সেপ্টেম্বর) সকালে উত্তরা র‌্যাব সদর দপ্তরের র‌্যাবের সংবাদ সম্মেলন

রাসেল বিক্রি বাড়াতে গ্রাহকদের প্রতিনিয়ত চাহিদা তৈরি হয় এ ধরনের পণ্যকে বেছে নেওয়া হয়।  ব্যবসায়িক অপকৌশল ছিল নতুন গ্রাহকের ওপর দায় চাপিয়ে দিয়ে পুরনো গ্রাহক ও সরবরাহকারির দায় আংশিক পরিশোধ করা। অর্থাৎ ‘দায় ট্রান্সফার’ এর মাধ্যমে দূরভিসন্ধিমূলক অপকৌশল চালিয়ে যাচ্ছিল ইভ্যালি।  প্রতিষ্ঠানটির নেওয়ার্কে যত গ্রাহক তৈরি হত, দায় তত বৃদ্ধি পেত।  রাসেল জেনেশুনে এ নেতিবাচক স্ট্যাটিজি গ্রহণ করেন। একটি বিদেশি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের লোভনীয় অফার এর আলোকে ইভ্যালির ব্যবসায়িক স্ট্যাটিজি তৈরি করেন রাসেল।  প্রথমত একটি ব্র্যান্ড ভ্যালু তৈরির পরিকল্পনা করা হয়। অতঃপর দায়সহ কোন প্রতিষ্ঠিত আন্তর্জাতিক কোম্পানির কাছে বিক্রি করে লভ্যাংশ নিয়ে নেওয়া। এ উদ্দেশ্যে তারা বিভিন্ন দেশও ভ্রমণ করেছেন। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠিত কোম্পানির কাছে কোম্পানি শেয়ারের অফার দিয়ে প্রলুব্ধ করে দায় চাপিয়ে দেওয়া।  এছাড়া তিন বছর পূর্ণ হলে শেয়ার মার্কেটে অন্তর্ভুক্ত হয়ে দায় চাপানোর পরিকল্পনা নেন।  রাসেল দায় মেটাতে বিভিন্ন অজুহাতে সময় বৃদ্ধি করার আবেদনও করেন। যা ছিল তার একটি অপকৌশল।

সংবাদ সম্মেলনে আরও জানানো হয়, ইভ্যালি পরিকল্পিতভাবে একটি পরিবার নিয়ন্ত্রিত ব্যবসায়িক গঠনতন্ত্র। একক সিদ্ধান্ত গ্রহণে স্বেচ্ছাচারিতা করার অবকাশ রয়েছে। ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ঘাটতি রয়েছে।  ফলে ক্রমান্বয়ে প্রতিষ্ঠানের দায় বৃদ্ধি হতে হতে বর্তমানে প্রায় অচলাবস্তায় উপনীত হয়েছে। এই অচলাবস্তা থেকে উত্তরণে দিশেহারা গ্রেপ্তারকৃতরা। বিভিন্ন সরবরাহকারি প্রতিষ্ঠানের কাছে দায়; গ্রাহকদের কাছে দায় নিয়ে বিচলিত প্রতিষ্ঠানটি। ইভ্যালির নেতিবাচক ব্যবসায়িক স্ট্যাটিজি উন্মোচিত হওয়ায় অনেক সরবরাহকারি প্রতিষ্ঠান ও অর্থ ট্রানসিশন গেটওয়ে ইভ্যালি থেকে সরে এসেছে।

আরও পড়ুন: ইভ্যালির চেয়ারম্যান-সিইও’র বিরুদ্ধে প্রতিবেদন ২১ অক্টোবর

র‌্যাবের কাছে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে রাসেল স্বীকার করেছেন, ভাড়াকৃত স্পেসে ধানমন্ডিতে প্রধান কার্যালয় এবং কাষ্টমার কেয়ার স্থাপিত হয়।  একইভাবে ভাড়াকৃত স্পেসে আমিন বাজার ও সাভারে ২টি ওয়ার হাউজ চালু করা হয়।  কোম্পানিতে একপর্যায়ে প্রায় ২০০০ ব্যবস্থাপনা স্টাফ ও ১৭০০ অস্থায়ী কর্মচারী নিয়োগ ছিল।  যা ব্যবসায়িক অবনতিতে বর্তমানে যথাক্রমে স্টাফ ১৩০০ জনে এবং অস্থায়ী পদে প্রায় ৫০০ জন কর্মচারীতে এসে দাঁড়িয়েছে। কর্মচারীদের একপর্যায়ে মোট মাসিক বেতন বাবদ দেওয়া হতো প্রায় ৫ কোটি টাকা; যা বর্তমানে ১.৫ কোটিতে দাঁড়িয়েছে।  জুন থেকে অনেকের বেতন বকেয়া রয়েছে।  তিনি ও তার স্ত্রী পদাধিকারবলে নিজেরা মাসিক ৫ লাখ টাকা করে বেতন নিতেন।  কোম্পানির অর্থে ব্যক্তিগত ২টি দামি গাড়ি (রেঞ্চ রোভার ও অডি) ব্যবহার করেন। এছাড়া কোম্পানির প্রায় ২৫-৩০টি যানবাহন রয়েছে।  ব্যক্তি পর্যায়ে সাভারে গ্রেপ্তারকৃত রাসেলের কয়েক কোটি টাকা মূল্যের জায়গা-জমিসহ অন্যান্য সম্পদ রয়েছে।  ইভ্যালির বিভিন্ন ব্যাংক অ্যাকাউন্টে বর্তমানে প্রায় ৩০ লাখ টাকা রয়েছে।

গ্রেপ্তারকৃত মোহাম্মদ রাসেল ও শামীমা নাসরিন

র‌্যাব আরও জানায়, এছাড়া কয়েকটি গেটওয়েতে ৩০-৩৫ কোটি গ্রাহকের টাকা আটক হয়ে আছে।  ২০২১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দেনা দাঁড়ায় ৪০৩ কোটি টাকা; চলতি সম্পদ ছিল ৬৫ কোটি টাকা, বিভিন্ন পণ্য বাবদ গ্রাহকদের কাছ থেকে অগ্রিম নেওয়া ২১৪ কোটি টাকা এবং বিভিন্ন গ্রাহক ও কোম্পানির কাছে বকেয়া প্রায় ১৯০ কোটি টাকা।

আরও পড়ুন: ইভ্যালির চেয়ারম্যান ও সিইও’র বিরুদ্ধে মামলা

প্রসঙ্গত, বৃহস্পতিবার (১৬ সেপ্টেম্বর) রাসেল ও শামীমা নাসরিনের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে গুলশান থানায় একটি মামলা হয়। আরিফ বাকের নামে ইভ্যালির এক গ্রাহক মামলাটি দায়ের করেন। এই মামলা হওয়ার পর বিকেলেই রাসেল ও তার স্ত্রী শামীমাকে আটক করে র‌্যাব।