লাইফস্টাইল

অন্যের অবহেলায় ক্ষতিগ্রস্ত হলে কীভাবে ক্ষতিপূরণ পাবেন?

অন্যের অবহেলায় মাথার উপরে বিনামেঘে বজ্রপাতের মতো জিনিসপত্র পড়ে আহত, নিহত হওয়ার ব্যাপারটা আমাদের গা-সওয়া হয়ে গেছে। নির্মাণ কাজের সময় কর্তৃপক্ষের পথচারীর প্রতি যত্নবান হওয়ার সংস্কৃতি এদেশে বিরল। ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষ আর্থিক ক্ষতিপূরণ দাবি করে মামলা করেছেন- এমনটাও খুব একটা দেখা যায় না।  অথচ দেশে টর্ট আইনের অধীনে ক্ষতিপূরণ দাবি করা যায়। যদিও অধিকাংশ মানুষ এ সম্পর্কে অবহিত নন।

টর্ট মানে কী? ল্যাটিন শব্দ Tortum থেকে ইংরেজি Tort শব্দটি এসেছে। যার অর্থ বাঁকা, অর্থাৎ সোজা পথে না চলে বাঁকা পথে চলা। সাধারণভাবে টর্ট বলতে বুঝায়, এমন কোনো দেওয়ানি অন্যায় কিংবা অবহেলামূলক কাজ যার ফলে অন্য ব্যক্তির আইনগত অধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে এবং যার আইনগত প্রতিকার হচ্ছে অনির্ধারিত আর্থিক ক্ষতিপূরণ। অন্যের অবহেলার ফলে কীভাবে টর্ট ও ক্ষতিপূরণের দাবি সৃষ্টি হতে পারে সেটি জানতে টর্ট আইনের জন্মভূমি ইংল্যান্ডের ১৮৬৫ সালের Scott vs London and St Katherine’s Docks  নামে একটি মামলার উল্লেখ করা যেতে পারে। ঘটনাটি ছিল এমন- বাদী বিবাদীর চিনির গোডাউনের পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় হঠাৎ উপর থেকে একটি চিনির বস্তা বাদীর মাথায় এসে পড়ে এবং বাদী আহত হন। ক্ষতিপূরণ চেয়ে মামলা করলে বিবাদী যুক্তি দেখায়, বাদীর সঙ্গে তাঁর কোনো শত্রুতা ছিল না; চিনির বস্তা আপনাআপনি বাদীর মাথায় এসে পড়েছে এবং এতে তাঁর কোনো দায় নাই। কিন্তু আদালত টর্ট আইনের বিখ্যাত The fact speaks itsel নীতি অনুসরণ করে রায় দেন, আসমান থেকে বৃষ্টি, কুয়াশা, তুষার পড়তে পারে কিন্তু চিনির বস্তা পড়তে পারে না। যেহেতু চিনির বস্তা পড়েছে তাই সহজেই বোধগম্য চিনির গোডাউনের মালিকের অবহেলাই এজন্য দায়ী!

বাংলাদেশের দণ্ডবিধি, ১৮৬০ এর অধীনে অন্যের অবহেলাপ্রসূত ক্ষতির ক্ষেত্রে শাস্তির পরিমাণ অত্যন্ত কম। উদাহরণস্বরূপ দণ্ডবিধির ২৭৯ ধারা মতে বেপরোয়া গাড়ি চালিয়ে কারো শারীরিক ক্ষতি ঘটালে সেটির শাস্তি সর্বোচ্চ ৩ বছরের কারাদণ্ড অথবা সঙ্গে জরিমানা হতে পারে মাত্র ১ হাজার টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৫ হাজার টাকা! অথচ টর্ট আইনের অধীনে মামলা করে বাদী কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ আদায় করতে পারেন। যেহেতু টর্ট বলতে দেওয়ানি প্রকৃতির অন্যায়কে বুঝায় তাই টর্টের মামলা দেওয়ানি আদালত বা সিভিল কোর্টে দায়ের করতে হয়।

টর্ট আইনের মুখ্য উদ্দেশ্য হচ্ছে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে আর্থিক ক্ষতিপূরণ প্রদান করা। এই আর্থিক ক্ষতিপূরণ আবার অনির্দিষ্ট। অর্থাৎ ক্ষতির প্রকৃতিভেদে পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি ও যুক্তিসঙ্গত কারণসমূহ বিবেচনায় নিয়ে আদালত প্রতিটি মামলায় ক্ষতিপূরণের পরিমাণ নির্ধারণ করেন। টর্ট আইনে মামলা করতে চাইলে প্রথমেই প্রমাণ করতে হবে, অন্যের কোনো অন্যায় কাজের ফলে বাদীর আইনগত অধিকার ক্ষুণ্ণ হয়েছে, অর্থাৎ ‘আইনগত ক্ষতি’র জন্যই ক্ষতিপূরণ দাবি করা যেতে পারে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে বাংলাদেশে টর্ট আইনের প্রয়োগের উদাহরণ খুব কম। আইনের এই গুরুত্বপূর্ণ শাখাটি আইন অঙ্গনে প্রায় উপেক্ষিত এবং এই আইনের অধীনে প্রাপ্য ক্ষতিপূরণ সম্বন্ধেও অধিকাংশ সাধারণ মানুষ অবহিত নন। অন্যের ক্ষতি বা বিরক্তি উৎপাদন করে জোরে গান বাজানো থেকে থেকে শুরু করে বাড়ির সামনে কেউ ময়লা আবর্জনা ফেলে রাখলেও আইনগত অধিকার ভঙ্গের প্রতিকার চেয়ে টর্ট আইনে ক্ষতিপূরণ মামলা দায়ের করা যায়।  

বর্তমানে ধীরে হলেও টর্ট আইনের প্রতি আগ্রহ বাড়ছে এবং ক্ষতিপূরণ দাবির মামলাও অনেকে করছেন। ক্ষতিপূরণ দাবির মামলার প্রতি উচ্চ আদালতের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি এর গুরুত্বপূর্ণ অনুঘটক। সম্প্রতি একটি মামলায় বাংলাদেশ বেভারেজ ইন্ডাস্ট্রিয়াল লিমিটেডের নিজস্ব গাড়ির ধাক্কায় নিহত সাংবাদিক মোজাম্মেল হোসেন মন্টুর পরিবারকে তিন কোটি ৫২ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার রায় বহাল রেখেছেন বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। এর আগে সড়ক দুর্ঘটনায় চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদের মৃত্যুর ঘটনায় তাঁর স্ত্রী ২০১২ সালে মোটরযান অধ্যাদেশ-১৯৮৩ এর ১২৮ ধারানুযায়ী গঠিত ক্লেইমস ট্রাইব্যুনাল এ আর্থিক ক্ষতিপূরণ চেয়ে একটি মামলা করেছিলেন। পরবর্তীতে মামলাটি হাইকোর্টে স্থানান্তরিত হয়। হাইকোর্ট সেই মামলায় এক যুগান্তকারী রায়ে তারেক মাসুদের পরিবারকে ৪ কোটি ৬১ লাখ ৭৫ হাজার ৪৫২ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে নির্দেশ দিয়েছেন। ক্ষতিপূরণের এই অর্থ পাবেন তারেক মাসুদের স্ত্রী ক্যাথরিন মাসুদ, তাদের ছেলে নিষাদ মাসুদ এবং তারেকের মা নুরুন নাহার।

এই রায়গুলো বিধিবদ্ধ টর্টের প্রয়োগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জন্য একটি মাইলফলক। এই রায়ের ফলে এখন প্রমাণিত যে, অন্যের অবহেলায় কারো ক্ষতিসাধন হলে আর্থিক ক্ষতিপূরণ পাওয়া সম্ভব। সিভিল ল’ইয়ার বা প্রথাগত ক্রিমিনাল ল’ইয়ার হওয়ার ইঁদুর দৌড় থেকে বেরিয়ে এসে তরুণ আইনজীবীরা নিজেদের এখন থেকে Compensation Lawyer বা টর্ট আইনজীবী হিসেবে প্রস্তুত করতে পারেন। সবাই সচেতন হলে, বাংলাদেশে অধিকার প্রতিষ্ঠার ‘টর্ট মামলা’ বৃদ্ধি পাবে। টর্ট আইনের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্বের প্রতি দৃষ্টি রেখে এই আইনটির ব্যাপক প্রচার-প্রসার ঘটানো এবং ক্ষতিপূরণ মামলা সম্পর্কে জনসাধারণকে সচেতন করার জন্য আরো পদক্ষেপ নিতে হবে।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়