লাইফস্টাইল

করোনা টিকার প্রথম ডোজ নাকি দ্বিতীয় ডোজে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বেশি?

বাংলাদেশ ও অন্যান্য দেশের নাগরিকরা করোনাভাইরাসের ভয়ংকর ভ্যারিয়েন্ট থেকে সুরক্ষা পেতে টিকা নিচ্ছেন। অনেকেই প্রথম ডোজের পর দ্বিতীয় ডোজও গ্রহণ করেছেন। এটা সত্য যে, টিকা নিলে কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে। সাধারণত মৃদু থেকে মধ্যম মাত্রার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয়ে থাকে। তবে কেউ কেউ তীব্র পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় ভুগে থাকেন।

বিশেষজ্ঞরা জানান, করোনার টিকায় ফ্লু সংক্রমণ জনিত উপসর্গের মতো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে (যেমন- জ্বর, মাথাব্যথা, শরীর ব্যথা ও অসুস্থতাবোধ বা দুর্বলতা)। টিকার স্থানে যে ব্যথা হবে এটা সহজেই অনুমান করা যায়। কিন্তু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া এখানেই সীমাবদ্ধ নয়। ব্যক্তিভেদে বিপজ্জনক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বা অ্যালার্জিক রিয়্যাকশনও হতে পারে। আবার এমনও অনেকেই আছেন, যারা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ভুগেননি।

দেখা গেছে, যারা টিকার প্রথম ডোজে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় ভুগেননি তাদের অনেকেরই দ্বিতীয় ডোজে ভয়াবহ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয়েছে। এটা কি বিপরীতভাবেও সত্য? অর্থাৎ প্রথম ডোজে যাদের তীব্র পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয়েছে তারা দ্বিতীয় ডোজ নিলে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হবে না? বা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হলেও তা কি মৃদু হবে?

* কিসে টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার প্রকৃতি নির্ধারিত হয়?

আমাদের শরীরের ইমিউন সিস্টেম টিকার উপকরণকে শত্রু ভেবে নিয়ে সংক্রমণ প্রতিরোধী কোষগুলোকে সক্রিয় করতে বার্তা পাঠিয়ে থাকে। কোষগুলো শত্রুকে শনাক্ত ও ধ্বংস করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। একারণে আমরা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় ভুগে থাকি। টিকা গ্রহণের পর ইমিউন সিস্টেম যত বেশি ক্রিয়াশীল হবে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার মাত্রা তত বেশি হতে পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হলে বুঝতে হবে টিকাটি কাজ করছে। কিন্তু টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াকে বিপজ্জনক মনে হলে চিকিৎসা নিতে দেরি করা উচিত হবে না, বিশেষ করে অ্যালার্জিক রিয়্যাকশনের লক্ষণ প্রকাশ পেলে।

কিভাবে টিকা তৈরি করা হয়েছে তার ভিত্তিতে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার প্রকৃতি ভিন্ন হতে পারে। অর্থাৎ টিকার ধরন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার প্রকৃতি নির্ধারণ করতে পারে। যে টিকা উচ্চসংখ্যক অ্যান্টিবডি সৃষ্টি করতে পারে তা গ্রহণ করলে শক্তিশালী পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে। অন্যদিকে কোনো টিকা উল্লেখযোগ্য ইমিউনিটি দিতে না পারলে মৃদু প্রকৃতির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয়ে থাকে। ধীরে ক্রিয়াশীল টিকা গ্রহণেও মৃদু বা মধ্যম মাত্রার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে। বয়স, শারীরিক রোগ, মানসিক দুর্দশা ও জীবনযাপনও টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াকে প্রভাবিত করতে পারে। এছাড়া কিছু লোকের শরীর টিকার প্রতি সংবেদনশীল- এরা তীব্র পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় ভুগতে পারেন।

* প্রথম ডোজে তীব্র পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয়েছে, দ্বিতীয় ডোজের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কেমন হবে?

এখনো পর্যন্ত এটা নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয় যে- প্রথম ডোজে ভয়ানক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হলে, দ্বিতীয় ডোজে মৃদু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হবে অথবা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াই হবে না। তেমনি প্রথম ডোজে হালকা থেকে মধ্যম মাত্রার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হলেও এটা নিশ্চিতভাবে বলা সম্ভব নয় যে, দ্বিতীয় ডোজে উদ্বেগজনক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হবে।

আবার এটাও নিশ্চিত করে বলা যায় না যে, প্রথম ডোজে হালকা বা মধ্যম মাত্রার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হলে দ্বিতীয় ডোজেও একইরকম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হবে। কিংবা প্রথম ডোজে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া না হলে দ্বিতীয় ডোজেও হবে না। এমনকি প্রথম ডোজে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া না হলে দ্বিতীয় ডোজে গুরুতর প্রতিক্রিয়া হবে কিনা সেটাও বলা সম্ভব নয়।

কারো কারো ক্ষেত্রে এমন ঘটনা ঘটেছে- প্রথম ডোজে মৃদু, কিন্তু দ্বিতীয় ডোজে তীব্র পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয়েছে/প্রথম ডোজে তীব্র, কিন্তু দ্বিতীয় ডোজে মৃদু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয়েছে/প্রথম ডোজে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয়েছে, কিন্তু দ্বিতীয় ডোজে হয়নি/প্রথম ডোজে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয়নি, কিন্তু দ্বিতীয় ডোজে হয়েছে। কিন্তু এসব ঘটনা বিবেচনা করে এখনি চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেননি বিশেষজ্ঞরা।

বিশেষজ্ঞদের মতে, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হবে কি হবে না বা কোন মাত্রার হবে তা কেবলমাত্র টিকার ধরনের ওপর নির্ভর করে না। ব্যক্তিগত বিষয়ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াকে প্রভাবিত করতে পারে, যেমন- বয়স্কতা বা শরীরে সুপ্ত রোগ। কিছু বিশেষজ্ঞ ধারণা করছেন যে, টিকার প্রথম ডোজে তীব্র পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হলে দ্বিতীয় ডোজে ভয়ানক প্রতিক্রিয়ার ঝুঁকি কম, কারণ শরীর প্রস্তুত হয়ে গেছে অথবা সয়ে নেওয়ার ক্ষমতা অর্জন করেছে। অন্যদিকে প্রথম ডোজের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া মৃদু হলে বা না হলে দ্বিতীয় ডোজে তীব্র পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার আশঙ্কা আছে, কারণ শরীর এখনো প্রস্তুত হয়নি বা সয়ে নেওয়ার ক্ষমতা অর্জন করেনি। এছাড়া প্রথম ডোজে এক ধরনের টিকা নিয়ে দ্বিতীয় ডোজে অন্যরকম টিকা গ্রহণ করলে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কেমন হবে তা পূর্বানুমান করা সহজ নয়।

* পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার মাত্রা ও সুরক্ষার মাত্রা পরস্পর সম্পর্কযুক্ত?

টিকা গ্রহণের পর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া অনুভব করলে ধরে নিতে পারেন যে শরীরে সংক্রমণ প্রতিরোধী প্রতিক্রিয়া চলছে। এই প্রতিক্রিয়া বেশি হলে সুরক্ষাও বেশি পাওয়া যাবে? না, এখনো পর্যন্ত বিশেষজ্ঞরা এটা চূড়ান্ত করেননি যে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার মাত্রা ও সুরক্ষার মাত্রা পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। অর্থাৎ করোনার টিকা গ্রহণের পর তীব্র পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় ভুগলে এটা নিশ্চিন্ত হওয়া যাবে না যে কোভিড-১৯ থেকে বেশি সুরক্ষিত, তেমনি হালকা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখেও নিশ্চিতভাবে বলা সম্ভব নয় যে, কোভিড-১৯ থেকে কম সুরক্ষিত। তার মানে হলো, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার মাত্রা দেখে টিকার কার্যকারিতা/সুরক্ষার মাত্রা মূল্যায়ন করা যাবে না। একেক ধরনের টিকা একেকভাবে কাজ করে শরীরে ইমিউনিটি আনে।

শুধু টিকার ধরন নয়, ব্যক্তিগত বিষয় বা জীবনযাপনও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার মাত্রা বাড়াতে পারে। বিশেষজ্ঞরা টিকা গ্রহণের আগে ও পরে কিছু বিষয়ে সচেতনতার ওপর জোর দিয়েছেন, অন্যথায় পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া গুরুতর পর্যায়ে চলে যেতে পারে। টিকা গ্রহণের পূর্বে প্রচুর বিশ্রাম নিতে হবে, কারণ ঘুমের ঘাটতি ও মানসিক অস্থিরতায় ইমিউন সিস্টেমের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এর ফলে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া মৃদুর পরিবর্তে তীব্র হতে পারে। টিকা গ্রহণের দিন থেকে পুষ্টিকর খাবারও খেতে হবে, তাহলে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়ন্ত্রণে রাখা সহজ হবে। এসময় শ্রমসাধ্য কাজ না করাই ভালো, ভারী শরীরচর্চা থেকেও বিরত থাকুন। দুশ্চিন্তা করবেন না, মনকে প্রফুল্ল রাখে এমনকিছুতে যুক্ত হতে পারেন।

কিছু বিশেষজ্ঞ জানান যে, দুই ডোজের মাঝে করোনায় সংক্রমিত হলে দ্বিতীয় ডোজের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া তীব্র হতে পারে। এর অন্যতম কারণ হতে পারে, সংক্রমণের কারণে দ্বিতীয় ডোজ নির্ধারিত সময়ে নেওয়া হয়নি। আরেকটি কারণ হলো- শরীরের টি সেলস এবং মেমোরি বি সেলস (সংক্রমণে অর্জিত ইমিউনিটি) একই সময়ে কাজ করতে শুরু করে, যার ফলে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার মাত্রা বেড়ে যায়। বয়স্কতা বা শারীরিক রোগও তীব্র পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার প্রভাবক হতে পারে।