মিডিয়া

করোনা কেড়ে নিল সাংবাদিক স্বপনের স্বপ্ন

করোনায় থামিয়ে দিল ফটো সাংবাদিক আব্দুল হাই স্বপনের বেঁচে থাকার স্বপ্ন।

কিডনি সমস্যা নিয়ে অনেকদিন যুদ্ধ করে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখেছিলেন। কিন্তু হেরে গেলেন করোনার কাছে।

মানবজমিন পত্রিকায় দীর্ঘ ৬ বছর কাজ করেছি। তখন আমাদের নিউজ এডিটর ছিলেন শহীদুল আজম। তিনি জানালেন স্বপন আর নেই। স্বপন ছিলেন আমাদের ফটো সাংবাদিক।  অত্যন্ত সাহসী একজন ফটোগ্রাফার।

আমার সাংবাদিক জীবনের সবচেয়ে মধুর সময় কেটেছে মানবজমিনের বন্ধুদের সঙ্গে। অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে। মানবজমিনের সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরীর সঙ্গে আমার রাজনৈতিক মতাদর্শগত ব্যবধান ছিল। কিন্তু পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে এ নিয়ে কোনও দিন কোনও সমস্যায় পড়তে হয়নি। একজন পরিপূর্ণ নিউজম্যান বলতে যা বোঝায় মতি ভাইয়ের ক্ষেত্রে সেটাই প্রযোজ্য। তার কাছ থেকে অনেক কিছু শিখেছি। বিশেষ করে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা তিনি হাতে-কলমে শিখিয়েছেন।  একটা ঘটনা বলতেই এত কথা বলার প্রয়োজন হলো।

মতি ভাইয়ের দেওয়া অনেকগুলো অনুসন্ধানী প্রতিবেদন আমাকে করতে হয়েছে। তার মধ্যে ‘ওয়াসার পানিতে চুলক্ষয়’—এমন একটা প্রতিবেদন আমাকে করতে হয়েছিল। সে সময় ওয়াসার যিনি ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন তার নামটা মনে নাই। তবে ভীষণ প্রভাবশালী ছিলেন। কাউকে তেমন পাত্তা দিতেন না। তার অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাওয়া তো দূরের কথা ফোনেও কমেন্টস দিতেন না।

অনেক খেটে বিভিন্ন জনের সঙ্গে কথা বলে প্রতিবেদন দাঁড় করালাম। ছবি তোলার দায়িত্ব পড়েছিল স্বপনের ওপর। কিন্তু সে কথা বেমালুম ভুলে গিয়েছিলেন স্বপন। মতি ভাইয়ের নির্দেশনা ছিল সদ্য টাক পড়ছে এমন কারো ছবি দিতে হবে।

মানবজমিনে নিয়ম ছিল যেদিন বিশেষ প্রতিবেদন ছাপা হবে, তার দুইদিন আগে লেখা জমা দিতে হবে। অর্থাৎ লেখা জমা দেওয়ার ডেটলাইন দিয়ে দেওয়া হতো। লেখা জমা হয়েছে। চিফ রিপোর্টার জাহিদ চৌধুরীর হাত ঘুরে নিউজ এডিটর হয়ে লেখা সম্পাদকের টেবিলে।

শীতের সন্ধ্যা। ৭টার সময় মতি ভাই অফিসে ঢুকে তার টেবিলে প্রতিবেদনের সঙ্গে ছবি না পেয়ে ক্ষেপে যান। পরের দিন সেটা লিড নিউজ হবে। নিউজ আছে, ছবি নেই। স্বপন ততক্ষণে বাসায় চলে গেছেন কে যেন অসুস্থ ছিল। চিফ ফটোগ্রাফার বোরহান ভাইকে ডাকা হলো। তার ওপর দিয়ে একচোট গেল। অবশেষে স্বপনকে বাসা থেকে ডাকার দায়িত্ব আমার ওপর পড়লো।

স্বপনের বাসায় গিয়ে ছবির কথা মনে করিয়ে দিতেই সে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন। এরপর উঠে ভাবিকে বললেন, ফ্রিজে কবুতরের গোশত আছে রান্না করা আর ছিট পিঠা ভাজা। কিসমত ভাইকে খাওয়ানোর জন্য এনেছিলাম (একদিন কথা প্রসঙ্গে সে বলেছিলেন, আপনার ভাবি খুব ভালো ছিট পিঠা বানাতে পারে। আপনাকে একদিন খাওয়াবো)। আমিতো তার কথায় আকাশ থেকে পরার অবস্থা। কোথায় সে ছবির বিষয়ে কথা বলবে আর কোথায় আমার জন্য কবুতরের মাংস-ছিট পিঠা খাওয়ানোর আয়োজন করছে।

সারাদিন খুবই ব্যস্ত থাকায় সেদিন খুব উস্কোখুস্কো ছিলাম। স্বপন আমার হাতে লুঙ্গি-গামছা ধরিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকিয়ে দিলেন। আমি কিছু বোঝার আগেই তার হাতে দেখলাম ক্যামেরা। আমি তাকে বললাম এখন আপনি কোথায় যাচ্ছেন ছবি তোলার জন্য। স্বপন মুচকি হেসে বললেন, ‘ভাই আমাকে বাঁচান, আজ আপনি আমার মডেল’! আমিতো হতভম্ব, কি বলেন? আমিও মন্ত্রমুগ্ধের মতো লুঙ্গি পড়ে ওয়াশরুমে ঢুকলাম। পেছন থেকে স্বপন বলছেন আর আমি সেভাবে মাথা নাড়াচ্ছি।

তখন আমার কেবলই চুল পড়া শুরু হয়েছে। মাথার মাঝখানে সামান্য খালি। প্রচণ্ড শীতের মধ্যে আধা ঘণ্টা শাওয়ারের নিচে। গোছল সেরে বের হতেই ইস্ত্রি করা একটি শাল আমার গায়ে জড়িয়ে দেয় স্বপন। এদিকে কবুতরের মাংস আর ছিটা পিঠা তৈরি। উদরপূর্তী করে দুজনে অফিসে ফিরলাম।

মতিভাই ছবি দেখে ‘অপূর্ব’ বলে বাহবা দিলেন। তখনো অফিসে কেউ জানতো না ছবিটা কার।

পরের দিন ছাপা হওয়াার পর সবাই স্বপনের ক্যারিশমা সম্পর্কে জানতে পারে। এই সেই প্রিয় সহকর্মী স্বপন যুক্তরাষ্ট্রে চিকিৎসাধীন মারা গেছেন। তিনি দীর্ঘদিন ধরেই অসুস্থ ছিলেন। স্বপনের আত্মার শান্তি কামনা করছি। হাসনাত/সাইফ/নাসিম