মুজিববর্ষ

দুর্নীতি উত্খাতে দৃঢ়চেতা ছিলেন বঙ্গবন্ধু

১৯৭৫ সালের ১১ জানুয়ারি।  কুমিল্লা সেনানিবাস।  বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমি প্রাঙ্গণে তরুণ সেনাদের একটি ব্যাচ পাসিং আউট প্যারেডের প্রধান অতিথি ইতিহাসের মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কঠোর সেই বক্তব্যে বঙ্গবন্ধু বললেন, এত রক্ত দেওয়ার পরে যে স্বাধীনতা এনেছি, চরিত্রের পরিবর্তন অনেকের হয় নাই।  এখনো ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ, চোরকারবারি, মুনাফাখোর বাংলার দুঃখী মানুষের জীবনকে অতিষ্ঠ করে দিয়েছে।  দীর্ঘ তিন বছর পর্যন্ত আমি এদের অনুরোধ করেছি, আবেদন করেছি, হুমকি দিয়েছি, চোরা নাহি শোনে ধর্মের কাহিনী।  কিন্তু আর না।

‘বিদেশ থেকে ভিক্ষা করে আমাকে আনতে হয়, আর এই চোরের দল আমার দুঃখী মানুষের সর্বনাশ করে এভাবে লুটতরাজ করে খায়।  আমি শুধু ইমার্জেন্সি দেই নাই, এবারে প্রতিজ্ঞা করেছি, যদি ২৫ বছর এ পাকিস্তানি জালেমদের বিরুদ্ধে বুকের পাটা টান করে সংগ্রাম করে থাকতে পারি, আর আমার ৩০ লক্ষ লোকের জীবন দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করতে পারি, তাহলে পারব না? নিশ্চয়ই ইনশাআল্লাহ পারব।

তিনি বলেছিলেন, কয়েকটি চোরাকারবারি, মুনাফাখোর, ঘুষখোর দেশের সম্পদ বাইরে বাইর করে দিয়ে আসে, মানুষকে না খাইয়ে মারে।  উত্খাত করতে হবে বাংলার বুকের থেকে এদের।  দেখি কত দূর তারা টিকতে পারে।  চোরের শক্তি বেশি না ঈমানদারের শক্তি বেশি, সেটাই আজ প্রমাণ হয়ে যাবে।

বঙ্গবন্ধু ঠিকই বুকের রক্ত দিয়ে ঈমানের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে গেছেন।  দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা ছিল রাজনীতির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত।  দুর্নীতির বিরুদ্ধে তার এমন অবস্থানের নিদর্শন পাওয়া যায় ১৯৫৬ সালের একটি ভাষণে।

১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগসহ কয়েকটি দল নিয়ে গঠিত যুক্তফ্রন্টের কোয়ালিশন সরকার।  ১৯৫৬ সালে মন্ত্রিত্ব পেয়েছিলেন আমাদের বঙ্গবন্ধু।  দায়িত্ব ছিল শিল্প, বাণিজ্য, শ্রম, দুর্নীতি দমন ও ভিলেজ এইড দপ্তর।  সেই তরুণ বয়সেই দুর্নীতির বিরুদ্ধে স্পষ্ট অবস্থান ছিল বাঙালির এই অবিসংবাদিত নেতার।

পিরোজপুর শহরের গোপালকৃষ্ণ টাউন ক্লাব মাঠে পিরোজপুর মহকুমা আওয়ামী লীগ আয়োজিত এক জনসভায় বঙ্গবন্ধু বলেন, কোনো অফিস-আদালতে দুর্নীতি হলে এবং আপনাদের নিকট কেউ ঘুষ চাইলে সঙ্গে সঙ্গে তিন পয়সার একটি পোস্ট-কার্ডে লিখে আমাকে জানাবেন।  আমি দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করব, যাতে দুর্নীতি চিরদিনের জন্য বন্ধ হয়ে যায়।

১৯৭৫ সালের ২৬ মার্চের স্বাধীনতা দিবসের পঞ্চম বার্ষিকীর এক অনুষ্ঠানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে লাখো জনতার সামনে সবুজ চত্বরে দাঁড়িয়ে দুর্নীতিবাজদের প্রতি কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু।  ভাষণে দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে নতুন সংগ্রামের ডাক দিয়ে জনগণের সহায়তা চান তিনি।

বঙ্গবন্ধু বলেন, সরকারি আইন করে কোনো দিন দুর্নীতিবাজদের দূর করা সম্ভব নয়, জনগণের সমর্থন ছাড়া।  আজকে আমার একটিমাত্র অনুরোধ আছে আপনাদের কাছে।  আমি বলেছিলাম, ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো, জেহাদ করতে হবে, যুদ্ধ করতে হবে শত্রুর বিরুদ্ধে।

আজকে আমি বলব বাংলার জনগণকে- এক নম্বর কাজ হবে দুর্নীতিবাজদের বাংলার মাটি থেকে উৎখাত করা।  আমি আপনাদের সাহায্য চাই।  গণআন্দোলন করতে হবে।  আমি গ্রামে গ্রামে নামব।  এমন আন্দোলন করতে হবে যে, ঘুষখোর, যে দুর্নীতিবাজ, যে মুনাফাখোর, যে আমার জিনিস বিদেশে চোরাচালান দেয় তাদের সামাজিকভাবে বয়কট করতে হবে।  এ কথা মনে রাখতে হবে। গ্রামে গ্রামে মিটিং করে দেখতে হবে, কোথায় আছে, ওই চোর, ওই ঘুষখোর।  ভয় নাই, আমি আছি।  ইনশাল্লাহ, আপনাদের ওপর অত্যাচার করতে দেব না।

মূলত মার্চে ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দীতেই শেষ ভাষণ জাতির জনকের।  কারণ এরপরে এতো দীর্ঘ ও গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দেওয়ার সময় দেয়নি হায়েনারা।  এর চার মাস পরেই রক্তের হোলিখেলায় মেতে উঠেছিল খুনিরা।  এই ভাষণটির অনুলিখন ১৯৭৯ সালের ১৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ থেকে প্রকাশিত স্মরণিকায় প্রকাশ করা হয়েছিল।

বঙ্গবন্ধু প্রায় প্রতিটি ভাষণেই দুনীতির বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি করেছেন।  এমনকি স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের আবেগী মুহূর্তেও তার কণ্ঠে ঘুষখোর ও দুর্নীতিবাজদের প্রতি কঠোর মেসেজ ছিল।

স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিনেও আবেগাপ্লুত জাতির জনক বলেন, আজ থেকে আমার অনুরোধ, আজ থেকে আমার আদেশ, আজ থেকে আমার হুকুম ভাই হিসেবে, নেতা হিসেবে নয়, প্রেসিডেন্ট হিসেবে নয়, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নয়, আমি তোমাদের ভাই, তোমরা আমার ভাই, এই স্বাধীনতা ব্যর্থ হয়ে যাবে যদি আমার বাংলার মানুষ পেট ভরে ভাত না পায়।  এই স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না যদি আমার বাংলার মা-বোনেরা কাপড় না পায়।  এ স্বাধীনতা আমার পূর্ণতা হবে না যদি এ দেশের মানুষ, যারা আমার যুবক শ্রেণি আছে তারা চাকরি না পায় বা কাজ না পায়।  দেশের উন্নয়নের জন্য ডাক দিলেন এভাবে- যথেষ্ট কাজ পড়ে রয়েছে। আপনারা জানেন, আমি সমস্ত জনগণকে চাই, যেখানে রাস্তা ভেঙে গেছে, নিজেরা রাস্তা করতে শুরু করে দেও।  আমি চাই জমিতে যাও, ধান বোনাও, কর্মচারীদের বলে দেবার চাই, একজনও ঘুষ খাবেন না, ঘুষখোরদের আমি ক্ষমা করব না।

দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা ছিল ১৯৭৪ সালের ১৮ জানুয়ারির ভাষণে।  দুর্নীতিবাজ, ঘুষখোর, চোরাচালানি, মজুদদারি, কালোবাজারি এবং মুনাফাখোরদের সমাজ ও রাষ্ট্রের শত্রু বলে আখ্যায়িত করে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, এদের শায়েস্তা করে জাতীয় জীবনকে কলুষমুক্ত করতে না পারলে আওয়ামী লীগের দুই যুগের ত্যাগ-তিতিক্ষা এবং স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতৃত্বদানের গৌরবও ম্লান হয়ে যেতে পারে।

বঙ্গবন্ধুর দুর্নীতির বিরুদ্ধে সেই যুদ্ধ এখনো শেষ হয়নি।  বরং সোনার বাংলা গড়তে যুদ্ধের কৌশল ও ব্যাপকতা বেড়েছে বহুগুণ। সমাজে বিশালায়তনের যে দুর্নীতি হয়, তাকে সুরক্ষা দিয়ে, নিচ কাঠামোর ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অঙ্কের দুর্নীতি রোধ করে খুব বেশি লাভ হয় না বলেই বারবার প্রমাণিত হয়েছে।  জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও সম্ভবত বেশ ভালোভাবেই উপলব্ধি করেছিলেন। তাই ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে বিষয়টি শক্তভাবেই উপস্থাপন করেছিলেন।

বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, আজকে করাপশনের কথা বলতে হয়।  এ বাংলার মাটি থেকে করাপশন উৎখাত করতে হবে।  করাপশন আমার বাংলার কৃষকরা করে না।  করাপশন আমার বাংলার মজদুর করে না।  করাপশন করি আমরা শিক্ষিত সমাজ।  যারা আজকে ওদের টাকা দিয়ে লেখাপড়া করেছি।  আজ যেখানে যাবেন, করাপশন দেখবেন- আমাদের রাস্তা খুঁড়তে যান- করাপশন।  খাদ্য কিনতে যান- করাপশন।  জিনিস কিনতে যান- করাপশন।  বিদেশ গেলে টাকার ওপর করাপশন।  তারা কারা? আমরা যে ৫ শতাংশ শিক্ষিত সমাজ, আমরা হলাম দুনিয়ার সবচেয়ে করাপট পিপল, আর আমরাই করি বক্তৃতা।  আমরা লিখি খবরের কাগজে, আমরাই বড়াই করি।  এই দুঃখী মানুষ যে রক্ত দিয়েছে, স্বাধীনতা এনেছে, তাদের রক্তে বিদেশ থেকে খাবার আনবো সেই খাবার চুরি করে খাবে, অর্থ আনবো চুরি করে খাবে, টাকা আনবো তা বিদেশে চালান দেবে।  বাংলার মাটি থেকে এদের উৎখাত করতে হবে।

দুর্নীতিবাজদের উৎখাতের সেই কাজ এখনও অসমাপ্ত থেকে গেছে।  এমনকি তার কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিরার নেতৃত্বে থাকা বর্তমান সরকারও দুর্নীতিবাজ, ঘুষখোর, চোরাচালানি, মজুদদারি, কালোবাজারি ও মুনাফাখোরদের বিরুদ্ধে লড়াই অব্যাহত রেখেছে।

 

ঢাকা/এম এ রহমান/এসএম