জাতীয়

শ্রাবণ রাতের প্রেমিক

তাঁর জীবনটাই দুঃখে ভরা ছিল। নির্বাক ছিলেন প্রায় ৩৪ বছর। সৃষ্টিশীল ছিলেন মাত্র ২১ বছর। জীবনবাদী সুপুরুষ মানুষটি তাঁর সৃষ্টি দিয়ে নিজস্ব ভৌগলিক সীমানা পেরিয়ে পৌঁছেছিলেন বিশ্ব ভূগোলে। একাডেমিক শিক্ষার গণ্ডি পেরুতে পারেননি, সম্ভব হয়নি কারণ দারিদ্র্য বাসা বেঁধে ছিল জন্মঘরেই। সেই ছোট্ট বেলাতেই কাজ নিতে হয়েছিল রুটির দোকানে। গানের দলে যোগ দিয়েছেন। নামটি ছিল তখন ‘দুখু মিয়া’। এই দুখু মিয়ার জন্ম ১৮৯৯ সালে। পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামের কাজী পরিবারে। তাঁর আসল নাম নজরুল। কাজী নজরুল ইসলাম। যিনি তাঁর লেখনি দিয়ে, তাঁর উচ্চারণ দিয়ে, কণ্ঠস্বর দিয়ে, চেতনা দিয়ে, প্রেম-ভালোবাসা দিয়ে জয় করে গেছেন বাংলা ও বিশ্বকে। ‘মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরি, আর হাতে রণ তুর্য’-এই উচ্চারণ দিয়েই তিনি নিজেকে জানান দিয়েছিলেন, প্রেম এবং দ্রোহ একইসঙ্গে হাঁটছে তাঁর ভিতরে। দুটো চেতনাকে প্রস্ফূটিত করেছেন তাঁর লেখায়। কবিতা, গান, প্রবন্ধ, নাটক, গল্প, উপন্যাস, শিশুসাহিত্য, চলচ্চিত্রের কাহিনি রচনায়, বক্তৃতা ইত্যাদির পরতে পরতে তাঁর প্রেম ও দ্রোহ খুঁজে পাওয়া যায়। একদিকে জন্ম দুঃখী, অন্যদিকে পরাধীনতা-এই দুই শৃঙ্খলা থেকে মুক্তির সংগ্রামে তিনি লিপ্ত ছিলেন জীবনভর। পাশাপাশি প্রেমিক তিনি। একইসঙ্গে লিখেছেন ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ এবং ‘মনে রাখার দিন গিয়েছে, এবার ভোলার বেলা’। নজরুল ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। তিনি ছিলেন একাধারে কবি, গল্পকার, উপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক, কাহিনীকার, চলচ্চিত্রকার, অভিনেতা, গীতিকার, সুরকার, কণ্ঠশিল্পী, বংশীবাদক, বক্তা, সৈনিক, সাংবাদিক, সম্পাদক,  ভ্রমণপিয়াসী, দ্রোহী এবং অবশ্যই একজন প্রেমিক পুরুষ। সাহিত্যের সব শাখাতে বিচরণ করলেও কবিতা ও গানের মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যে এবং বাঙালির মননে চিরস্থায়ী আসন লাভ করেছেন। তাই বার বার, বহুবার, এমনকি প্রতিদিনই তাঁকে মনে করতে হবে, কারণ রবীন্দ্রনাথের পাশাপাশি নজরুল বাঙালির জাগরণে এবং বাংলা সাহিত্যের মূল সুরকে বাজানোর ক্ষেত্রে প্রধান বংশীবাদকের কাজটি করেছেন। বিশেষ করে বাঙালি মুসলমানের জাগরণের ক্ষেত্রে নজরুল অসাধারণ ভূমিকা পালন করেছেন। চুরুলিয়া থেকে ঢাকা এই ভৌগলিক পরিসীমায় এবং ১৮৯৯ থেকে ১৯৭৬ এই সময় পরিসরে নজরুল জীবনাচরণ ও সৃজনাচরণ মূর্ত করে গেছেন বলিষ্ঠ কণ্ঠে এবং অসম্ভব প্রতিভা গুণে। ব্যক্তিগত দারিদ্র্য ও নিঃসীম দুঃখ জয় করে নজরুল মাত্র ৪২ বছরের মুক্তবাক ও সরব জীবন নিয়ে যে সৃষ্টির পৃথিবী নির্মাণ করে গেছেন তা বাংলা ভাষা-ভাষী জন-মানুষের জন্য তো বটেই, অন্য ভাষার সাহিত্যের ক্ষেত্রেও ঈর্ষণীয় বিষয়। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও নজরুলকে মূল্যায়ন করেছেন। ব্রিটিশ-প্রশাসনের আওতায় কারাগারে অবরুদ্ধ নজরুলকে অনশন ভাঙার অনুরোধ করেছেন, নাটক উৎসর্গ করেছেন, বিশেষ করে তিরিশের পঞ্চপাণ্ডবদের স্ফূরণের আগেই তিনি নজরুলের প্রতিভা স্বীকার করে নিয়েছেন। নজরুল ছিলেন মানবতার কবি, মানুষের কবি, সাম্যের কবি, সমতার কবি, অসাম্প্রদায়িক চেতনার কবি, সমাজ-ভাবনার কবি এবং সর্বোপরি বাংলাদেশের জাতীয় কবির শিরোপা পেয়েছেন তিনি। দেশ-মাতৃকার ভাবনা ও চেতনা আমৃত্যু লালন করেছেন। এ দেশ, মাটি ও মানুষের কথা তাঁর সাহিত্যে ফুটে উঠেছে। আমরা তাঁকে ‘বিদ্রোহী কবি’ আখ্যা দিয়েছি। কারণ তাঁর মননে বিদ্রোহের রেখা জ্বলজ্বল করেছে। সব শৃঙ্খল থেকে বেরিয়ে আসার বিদ্রোহ তিনি করেছেন। পরাধীন বাঙালির মুক্তির ভাবনা তাঁকে কুড়ে কুড়ে খেয়েছে। এ জন্য তিনি কলমকে হাতিয়ার করেছেন। তাঁর জীবনের ওপর একটু আলো ফেললে দেখা যাবে-শৈশবের দারিদ্র্য তুচ্ছ-জ্ঞান করার প্রয়াশে রুটির দোকানে কাজ করেছেন আবার মক্তবে পড়াশোনা এমনকি লেটোর দলে তুখোড় তুর্কি হয়েছেন। আসানসোলের ছোট্ট দুখু মিয়া এভাবেই জীবন শুরু করেছিলেন। বাংলাদেশের দারোগা কাজী সাহেবের হাত ধরে ময়মনসিংহের ত্রিশালে আসেন ছোট্ট নজরুল। এখানেও পড়াশোনা তেমন হয়নি, দুরন্তপনাই হয়েছে। সুখের বিষয় যে, তাঁকে স্মরণে রাখার নিমিত্তে এখানে তাঁর নামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলা হয়েছে। এবং প্রতি বছর সরকারের উদ্যোগে এখানে নজরুল জন্মদিবস পালন করা হয়। ঢাকায় জাতীয়ভাবে এবং কুমিল্লা, মানিকগঞ্জ, চট্টগ্রাম ও রাজশাহীসহ পালন করা হয় সারা বাংলাদেশেই। নজরুলের গান, নজরুলের কবিতার আবৃত্তি, নজরুলের সাহিত্যের আলোচনাসহ নানা দিক মূল্যায়ণ করার প্রয়াস ঘটে। এই প্রয়াস অত্যন্ত জরুরি, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের বাঙালিদের জন্য। কেননা স্বাধীনতাত্তোর একটি বিশাল জনগোষ্ঠী বাংলাদেশে গড়ে উঠেছে, যাদের সামনে নজরুল-রবীন্দ্রনাথ-লালন ও বঙ্গবন্ধুসহ বাঙালির কীর্তিমানদের তুলে ধরতে হবে। তুলে ধরতে হবে বাঙালি সংস্কৃতি ও হাজার বছরের সাহিত্য, যে সাহিত্যে নজরুল একজন উজ্জ্বল পুরুষ। ‘গাহি সাম্যের গান’ এই যাঁর মহান উচ্চারণ, তাঁকে আমাদের অবশ্যই মূল্যায়ণ করতে হবে। কারণ নজরুল মানুষে মানুষে সমতার কথা বলেছেন। তাঁর প্রত্যাশিত সমাজ ছিল সুসম সমাজ। সম-বণ্টনে তিনি বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি নারী-পুরুষের পার্থক্যে বিশ্বাসী ছিলেন না। ‘নারী’ কবিতা লিখে তাঁর প্রমাণ রেখে গেছেন। বলেছেন :          ‘এই বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি, চির কল্যাণকর           অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর’। কবিতার ব্যাখ্যায় না গিয়েও বলা যায়, এখানেই নজরুলের স্বার্থকতা, কারণ এখানেই যেন মানবতার চিরন্তন সুর তিনি উচ্চারণ করেছেন। পাশাপাশি তিনি যা বিশ্বাস করতেন সেখানেই নিজেকে বিলিয়ে দিতেন। তিনি মানুষের মঙ্গলার্থে, সমাজের কল্যাণে এবং দেশের ভালোবাসায় নিবেদিত ছিলেন। ক্ষুরধার কলমে তিনি লিখেছেন জীবনের জয়গান। ‘জয়’ শব্দটি নজরুলেরই ব্যবহৃত ও উচ্চারিত শব্দ। এই জয় থেকে ‘জয়বাংলা’ শব্দ বাঙালিরা তাঁদের বিজয়ের রণধ্বনি হিসেবে ব্যবহার করেছেন। বিশেষ করে ১৯৭১ সালে জয়বাংলা শব্দটি ছিল বাঙালির প্রধানতম চেতনার শব্দ। এই একাত্তরেই বাঙালিকে সাহস, শক্তি, উদ্দীপনা ও অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন নজরুল। তাঁর গান, কবিতা ও জাগরণি সাহিত্য মুক্তিযোদ্ধা তথা আপামোর যুদ্ধরত মুক্তিকামী সাড়ে সাত কোটি বাঙালিকে যুদ্ধজয়ে উদ্বুদ্ধ করেছে। মোটকথা নজরুল বাঙালির চেতনায় আলো ফেলতে পেরেছিলেন।    নজরুলের পুরো জীবনটাই ছিল সংগ্রামের। পড়াশোনায় এগুতে না পারলেও নানা কাজে বেঁচে থাকার লড়াই করেছেন। সৈনিক কিংবা সাংবাদিকতা কোথাও স্থির থাকেননি। ছিলেন কিছুটা বহেমিয়ান। বহেমিয়ান তো বটেই। তা না হলে নজরুলকে আমরা নানা মাত্রিক হিসেবে পেতাম না। সাহিত্যের কাজে কিংবা পালিয়ে বেড়াবার তাগিদে নয়, তিনি বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশের নানা অঞ্চলে ঘুরে বেড়িয়েছেন মনের তৃষ্ণায়। তাঁর অনেক লেখায় এর প্রতিফলন ঘটেছে। পদ্মা-যমুনা বিধৌত পলি-মাটির শ্যামল বাংলাদেশেই শেষ পর্যন্ত তাঁর চির-নিবাস হয়েছে। আগেই উচ্চারণ করে গেছেন, ‘মসজিদের পাশে আমার কবর দিও ভাই’। তাঁর এ ইচ্ছাকে আমরা মর্যাদা দিয়েছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদের পাশে তাঁকে সমাহিত করা হয়েছে এবং তিনি জাতীয় কবির মর্যাদায় চির নিদ্রায় শায়িত আছেন। নজরুলকে নিয়ে আমাদের সবচে’ ট্র্যাজেডি হলো দ্বিতীয় মহাযুদ্ধোত্তর কালে এবং রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণের পর পরই এমনকি প্রায় দুইশ বছরের শাসন উঠিয়ে নিয়ে যখন ব্রিটিশরা ফিরে যাবার উপক্রম ঠিক তখনই তিনি বাকরুদ্ধ হয়ে যান। বিস্ময়করভাবে থেমে যায় তাঁর কলম, তাঁর সৃজনশীল ক্ষমতা। সময় স্বল্প হলেও মেধা ও প্রতিভার গুণে তিনি এর মধ্যেই সৃষ্টি করে গেছেন অসাধারণ কিছু সাহিত্য নিদর্শন। ব্যক্তিগত অভিমত নিয়ে বলছি, বাংলা সাহিত্যের অন্যান্য শাখা যদি প্রতারণাও করে, তাঁর গান তাকে বাঁচিয়ে রাখবে বহু বহু বছর। একটি গানে তিনি বলেছেন, ‘মনে রাখার দিন গিয়েছে, এখন ভোলার বেলা’ এই যে প্রেমিক-মনের একটি বিরহী সুর, তা বলা যায় নজরুল মনের চিরন্তন সুর। তাঁর বিখ্যাত একটি কবিতা ‘বাতায়ন পাশে গুবাক তরুর সারি’। এই কবিতায় নজরুলের প্রেম এবং প্রেম থেকে উত্থিত অভিমান ও বিরহের উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন, যার কয়েকটি চরণ এ রকম :

          ‘তোমাদের পানে চাহিয়া বন্ধু আর আমি জাগিব না           কোলাহল করি সারাদিনমান কারো ধ্যান ভাঙিব না                      নিশ্চল নিশ্চুপ             আপনার মনে পুড়িব একাকি গন্ধ বিধুর ধূপ।’ নজরুলের এই যে প্রেম এবং প্রকৃতির স্ফূরণ আমরা লক্ষ করলাম, সেটিই তাঁর মূল সুর। ১৯২২ সালে প্রকশিত ‘অগ্নিবীণা’ কাব্যগ্রন্থভুক্ত তাঁর একশ একচল্লিশ চরণের দীর্ঘ ‘বিদ্রোহ’ কবিতাটিকে সামনে রাখি যেটির কারণেই মূলত তাঁকে বিদ্রোহী কবি বলতে পারি। সেখানেই আছে, ‘মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরি/আর হাতে রণতুর্য’। অর্থাৎ তিনি কখনো প্রেমিক আবার কখনো বিদ্রোহী। তাঁর প্রেমের নিদর্শন দোলন চাঁপা, ছায়ানট, পুবের হাওয়া, চক্রবাক প্রভৃতি কাব্যে প্রতিফলন ঘটেছে। অপরদিকে অগ্নিবীণা, বিষের বাঁশি, ভাঙার গান কাব্যগ্রন্থে বিদ্রোহের সুর ধ্বনিত হয়েছে। তাই তাঁকে আমরা প্রেম-দ্রোহের কবি বলে ভূষিত করেছি।             নজরুল একই সঙ্গে কবিতা, শিশুতোষ রচনা, গান, গল্প, উপন্যাস, নাটক, সম্পাদনা, সভা-সমিতিতে বক্তৃতা, মনের অবাধ সাঁতারে ঘুরে বেড়ানো- এই যে বহুমাত্রিকতা তা তাঁর পক্ষেই সম্ভব হয়েছে। তাঁর এই পথ চলা জীবনে এনেছে নতুন সম্ভার। তিনি পথে পথে খুঁজে ফিরেছেন সুর ও শব্দালঙ্কার। সেই কুড়ানো সুর ও শব্দলঙ্কারে সাজিয়েছেন কাব্য-লক্ষ্মীর অবয়ব। তাই কাব্য-গানে ভিন্ন মাত্রা প্রকাশ পেয়েছে। নজরুল ভাষা-জ্ঞানী ছিলেন। মাতৃভাষা বাংলা ছাড়াও আরবি, ফার্সি, উর্দু তাঁর দখলে ছিল। শৈশবে তিনি বাবার কাছে বাল্যশিক্ষা গ্রহণ করেন। বাবার মৃত্যুর পর চাচা কাজী বজলে করিমের কাছে পেয়েছিলেন আরবি ও ফার্সি ভাষা শিক্ষার সুযোগ। স্কুল জীবনে পেলেন একজন সুপণ্ডিত শিক্ষক মৌলভী নূরুন্নবী সাহেবকে। আর স্কুল থেকে পালিয়ে ১৯১৭ সালে ৪৯ নম্বর বাঙালি পল্টনে যোগদান করে চলে গেলেন করাচীতে। এই পথ চলার মাঝেই সুদূর করাচী সেনা নিবাসে জনৈক কোনো এক মৌলভী সাহেবের কাছে আরবি ও ফারসি ভাষায় পারদর্শী হয়ে ওঠেন। এখানেই তিনি হাফিজের রুবাই অনুবাদ শুরু করেন। যা বাংলা সাহিত্যে অসাধারণ একটি কাব্যানুবাদ। তিনি শুধু একজন কবি হিসেবেই নন একজন অনুবাদক হিসেবেও মর্যাদার আসন পেয়েছেন। কবি নজরুল ছিলেন হিন্দু-মুসলিম মিলনের ঐক্যদূত। একই সঙ্গে তিনি লিখেছেন ইসলামী সংগীত আবার শ্যামা সংগীতও। বুলবুল ও রাঙাজবা তাঁর উল্লেখযোগ্য সংগীত সংকলন। প্রায় সাড়ে তিন হাজারের মত গান তিনি রচনা করেছেন যা বাংলা গানের এক অমূল্য সম্পদ। কেউ কেউ বলতে পারেন, নজরুল অস্থির, এলোমেলো, বহেমিয়ান ও ছন্নছাড়া, অগোছালো জীবন যাপন করেছেন। কিন্তু খেয়াল করতে হবে, যে জীবন শুরুই হয়েছিল অনিশ্চয়তার মধ্যে বিশেষ করে বাবা কাজী ফকির আহমেদের কষ্টের জীবন ও অকাল মৃত্যু নয় বছরের নজরুলকে চরম আঘাত দিয়েছে। স্বাভাবিক ও স্বচ্ছল জীবন তিনি পাননি। যে বয়সে পড়াশোনা করে জীবনমুখী হওয়ার কথা, সেময় তাঁকে বেঁচে থাকার সংগ্রামে লিপ্ত হতে হয়েছে। একদিকে ব্রিটিশদের অধীনতা, অন্যদিকে ব্যক্তিগত সংগ্রাম-এই দুই শত্রুকে তাড়া করে নজরুল এগিয়ে গেছেন যুদ্ধজয়ী অশ্বারোহীর মতো। এই অশ্বারোহীর প্রবল বেগ ছিল এবং প্রচণ্ড আবেগ ছিল। এই দুই গুণেই তিনি স্বপ্ন পূরণের পথে হেঁটেছেন। নজরুল বাংলা সাহিত্যের এক পুরোধা-পুরুষ। বিশ্বে যতদিন অনাচার অবিচার সংগ্রাম বিদ্রোহ বিপ্লব সংঘটিত হবে, ততদিন নজরুলের গান কবিতা ভাষণ অভিভাষণ আমাদের প্রেরণা যোগাবে। যেমনিভাবে মহান মুক্তিযুদ্ধে আমাদের রণক্ষেত্রে শক্তি-সাহস উদ্দীপনা যুগিয়েছিল। নজরুল যুদ্ধারোহী অশ্বারোহীর মত আমাদের আজীবন তেজোদীপ্ত করে রাখবে। তাঁর রচনা ‘চল চল চল, উর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল, নিম্নে উতলা ধরণী তল...’ এই যে রণধ্বনি, বাঙালিকে জাগিয়েছে, জাগাবে ভবিষ্যতেও। সবকিছু ছাপিয়ে নজরুলকে প্রেমের কবি হিসেবেই আমরা আখ্যা দিতে পারি। প্রমীলা, নার্গিস, বুলবুল নামক নারী কিংবা গানের পাখি তাঁর জীবনকে দারুণভাবে আন্দোলিত করেছে। কলকাতা, কুমিল্লা, মানিকগঞ্জ, ঢাকা পরিসরগুলোতে তাঁর এই আন্দোলিত ঢেউয়ের দোলা লেগেছে। ‘মোর প্রিয়া হবে এসো রাণী, দেবো খোঁপায় তারার ফুল’, ‘নয়নভরা জল গো তোমার আঁচলভরা ফুল’, ‘এতো জল ও কাজল’ কিংবা ‘অন্ধকারে এসেছিলাম আঁধারে যাই চলে/ক্ষণিকের ভালবেসেছিলাম চিরকালের নাহি হলে’। এমন বাণীর মর্ম যে কোনো মানুষের ভিতরে শিহরণ, অনুরণন, জাগরণ জাগাতে বাধ্য। তিনি নদী, প্রকৃতি ও প্রেমকে একাকার করে দিয়ে উচ্চারণ করেছেন ‘পদ্মার ঢেউরে’ বা ‘শাওন রাতে যদি’র মতো কালজয়ী গান। এইসব গান শুনতে শুনতে চোখের সামনে যে চিত্র ফুটে ওঠে, তা নান্দনিক ও সুন্দর।