জাতীয়

আমার অশ্লীল কোনো দৃশ্য নেই : মুনমুন

রাহাত সাইফুল : ঢালিউডে একটি ঝড়ের নাম মুনমুন। ঢাকাই সিনেমায় তিনি আলোড়ন তুলেছিলেন নিজের মহোনীয় রূপ আর সাহসিকতার গুণে। ১৯৯৬ সালে চলচ্চিত্রে অভিষেক হয় চিত্রনায়িকা মুনমুনের। ক্যাপ্টেন এহতেশাম পরিচালিত মৌমাছি সিনেমায় প্রথম কাজ করেন তিনি। সিনেমাটি মুক্তি পায় ১৯৯৭ সালে। এর পর টারজান কন্যা, মৃত্যুর মুখে, রাজা, মরণ কামড়, রানী ডাকাত, আজকের সন্ত্রাসীসহ অসংখ্য সুপারহিট সিনেমায় অভিনয় করেছেন।

 

বর্তমান সময়ের দেশ সেরা নায়ক শাকিব খানের প্রথম ব্যবসা সফল সিনেমার নায়িকাও ছিলেন মুনমুন। সিনেমাটির নাম বিষে ভরা নাগীন।

এ ছাড়া বিভিন্ন সময় কারণে-অকারণে মুনমুনকে নিয়ে চলচ্চিত্রাঙ্গনে তৈরি হয়েছে সমালোচনার ঝড়। তবু নিন্দুকের কথার তীরকে তিনি কখনই তোয়াক্কা করেননি। সব সমালোচনাকে পিছনে ফেলে সামনে এগিয়ে গেছেন নিজের তৈরী পথে। এ পর্যন্ত তার অভিনীত চলচ্চিত্র সংখ্যা ৮১, যার বেশির ভাগই ছিল সুপারহিট।

মুনমুনের জন্ম মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ইরাকে। বাবার চাকরির সুবাদে সাত বছর বয়স পর্যন্ত সেখানেই ছিলেন। এর পর তার পরিবার ঢাকায় ফিরে এলে এই নগরীতেই বেড়ে উঠেছেন। তার পৈতৃক বাড়ি চট্টগ্রামের রাউজানে। এলাকায় তাদের বাড়িটি সুপরিচিত ‘মীর বাড়ি’ নামে। এখন দুই সন্তানের জননী মুনমুন। বড় ছেলে সালমানের বয়স ১০। ছোট ছেলে ছালাম আহম্মেদের বয়স তিন বছর।

মুনমুনকে সর্বশেষ কুমারী মা সিনেমাতে দেখা যায় ২০১৪ সালে। সিনেমাটি পরিচালনা করেন বাবুল রেজা। মাঝে বেশ কিছুটা সময় এক রকম অন্তরালেই ছিলেন। তবে এ বছর মে মাসের মাঝামাঝিতে তিনি কাজ শুরু করেছেন সরকারি অনুদান পাওয়া চলচ্চিত্র কাসার থালায় রুপালি চাঁদ সিনেমাটিতে।

সম্প্রতি রাইজিংবিডির বিনোদন বিভাগ ‘অ্যাকশন কুইন’ খ্যাত এ অভিনেত্রীর চলচ্চিত্র ক্যারিয়ার এবং ব্যক্তি জীবনের নানা বিষয় নিয়ে আলাপ করেছে তার সঙ্গে। পাঠকদের জন্য সেই আলাপচারিতার চুম্বকাংশ তুলে ধরা হলো-

রাইজিংবিডি : বেশ কিছু দিন ধরেই আপনি চলচ্চিত্রাঙ্গন থেকে দূরে রয়েছেন, কেন?মুনমুন : এটা ঠিক, লম্বা সময় চলচ্চিত্রাঙ্গন থেকে দূরে ছিলাম আমি। কেউ নতুন কোনো সিনেমায় কাজের জন্য ডাকলেও রাজি হইনি। এর কারণ আমার দ্বিতীয় সন্তান। তাকে সময় দেওয়ার জন্যই এতদিন কাজ করিনি।

 

রাইজিংবিডি : এখন কী নিয়ে ব্যস্ত আছেন?মুনমুন : দেলোয়ার জাহান ঝন্টুর তত্ত্বাবধানে এবং ড্যানি সিডাকের পরিচালনায় কাসার থালায় রুপালী চাঁদ সিনেমার কাজ করছি।

 

রাইজিংবিডি : এ সিনেমায় আপনার চরিত্র কেমন?মুনমুন : এ সিনেমায় আমি একজন গ্রামের মেয়ে। আমার স্বামী ড্যানি সিডাক। তার কোনো আয়ের পথ নেই। টাকা পয়সা কম থাকে। আমি খুব উচ্চাভিলাষী। মানুষ আমাকে সুন্দর বললে আমার ভালো লাগে। এর মধ্যে এক খারাপ লোকের পাল্লায় পড়ি। সে আমাকে নায়িকা বানানোর প্রলোভন দেখিয়ে ঢাকায় নিয়ে আসে। এরপর আমি প্রতারিত হই। আমি যখন প্রতিবাদ করতে যাই, তখনই আমাকে হত্যা করা হয়।

  রাইজিংবিডি : আপনাকে নিয়ে অনেককেই নেতিবাচক মন্তব্য করতে দেখা যায়। কিন্তু কেন?  

মুনমুন : এর কারণ হলো দর্শকদের সামনে আমাকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। যারা আমার সিনেমা দেখছেন আর যারা দেখেননি, সবার সামনে আমাকে এমনভাবে উপস্থাপনা করা হয়, যাতে মনে হয় আমি সিনেমায় উলঙ্গ হয়ে কাজ করেছি। বাস্তবতা হলো- আমি কোনো দিনই কোনো সিনেমায় উলঙ্গ হয়ে অথবা অশ্লীল কোনো দৃশ্যে কাজ করিনি। এক ঈদে আমার অভিনীত সিনেমা রানী কেন ডাকাত মুক্তি পায়। তখন একই সঙ্গে সাতটি সিনেমা মুক্তি পায়। তবে সবগুলো সিনেমাকে টপকিয়ে রানী কেন ডাকাত দারুণ জনপ্রিয়তা পায়। এ সিনেমার ধারে কাছেও যেতে পারেনি অন্য সিনেমাগুলো। বিষয়টি অনেকেই মেনে নিতে পারেননি। তখন থেকেই আমার পিছনে কিছু লোক লাগে।

 

রাইজিংবিডি : আপনার অভিনীত ‘নিষিদ্ধ নারী’, ‘মহিলা হোস্টেল’ এর মতো সিনেমাগুলো নিয়ে বেশ বির্তক রয়েছে। এ বিষয়ে আপনার অভিমত জানতে চাই।মুনমুন : আমার অভিনীত শেষের দিকের তিন থেকে চারটা সিনেমায় অশ্লীলতা ছিল। তবে সেগুলোতে আমার অভিনীত অংশগুলোতে অশ্লীল কিছু ছিল না। অশ্লীল যা কিছু ছিল, তা হচ্ছে ‘কাটপিস’। এর জন্য তো আর আমি দায়ী নই। আমি তো পরিচালক-প্রযোজক নয়। আমার অভিনীত অশ্লীল কোনো দৃশ্য নেই। তবে আমার সিনেমায় অন্যের দৃশ্য কাটপিস হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে।

 

রাইজিংবিডি : অনেক সময় নারী শিল্পীদের সংক্ষিপ্ত পোশাক পরিয়ে অভিনয় করানো হয়। এটাতো একজন অভিনয় শিল্পীর না জানার কিছুই নেই।মুনমুন : হ্যাঁ, তা ঠিক। এজন্য আমিও ব্যক্তিগতভাবে অনেকবার প্রতিবাদ করেছি। একবার আমি এক সিনেমার সেটে পরিচালকের সঙ্গে ঝগড়াও করে শুটিং স্পট থেকে বেড়িয়ে আসার জন্য উদ্যত হই। সে সময় তারা আমাকে আটকিয়ে দেয়। সেদিন আমি তাদের নির্বাচিত খোলামেলা পোশাক পরতে রাজি ছিলাম না। পরে বিরোধিতার মুখে তারা আমার সিদ্ধান্ত মেনে নিতে বাধ্য হয়। আমি, আমার সঙ্গে থাকা কস্টিউম পড়ে শট দিই। কিন্তু পরে সিনেমাটিতে দেখলাম, তারা আমাকে বিকৃতভাবে পর্দায় উপস্থাপন করেছে।

 

রাইজিংবিডি : মাঝে একটা সময় দেশের চলচ্চিত্রে অশ্লীলতা ছড়িয়ে পড়ে। এই বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখেন?মুনমুন : আপনি যে সময়টার কথা বলছেন, তখন নায়িকাদের কোনো দোষ ছিল না। অভিনেত্রীরা চাপে পড়ে বাধ্য হয়ে অশ্লীল দৃশ্যে কাজ করেছেন। এতে শিল্পীদের কোনো কিছু করার ছিল না। সে সময় তারা বড় জোর সিনেমার কাজ ছেড়ে দিতে পারত। কিন্তু কিছু লোক ছিল যারা নানা কৌশলে মেয়েদের মগজ ধোলাই করত। তারা মেয়েদের জীবনকে একবারে বরবাদ করে দিয়েছে। এ রকম একটি ঘটনার কারণে পারিবারিক অশান্তি তৈরি হওয়ায় একটা মেয়ে আত্মহত্যাও করে। এমন কিছু মেয়েরা সে সময় কাজ করেছে, যারা পরিবারের কাছেও খারাপ ছিল, আবার সিনেমায় কাজ করতে এসে পরিচালকদের কথা মানতে হতো। আসলে তারা সিনেমার কাজও ছেড়ে দিতে পারেনি সে সময়। পরিবারও তাদের পাশে থাকেনি। সব মিলিয়ে তারা ছিল পরিস্থিতির শিকার। আদতে মেয়েদের কোনো দোষ ছিল না।

 

রাইজিংবিডি : তাহলে দোষটা কাদের বলে আপনি মনে করছেন?মুনমুন : আসল দোষটা টাকা লগ্নিকারীদের। অধিক মুনাফার লোভে তারা এসব কাজ করেছেন। আমার সময় ইন্ডাস্ট্রিতে অনেক সম্ভাবনাময়ী অভিনেত্রী এসেছেন, যাদের ভবিষৎ খুবই উজ্জ্বল হতে পারত। তাদের প্রথমই গলা টিপে মেরে ফেলছে এসব খারাপ লোকেরা।

 

রাইজিংবিডি : আপনাকে নিয়ে এতো সমালোচনা কেন তৈরি হয়েছে বলে আপনি মনে করছেন?মুনমুন : আমাদের চলচ্চিত্রাঙ্গন এমন একটা পলিটিক্সের জায়গা; এখানে যারা খারাপ কাজ করছেন তারাই হাইলাইট হয়েছেন। আমি সেটা করতে পারিনি, তাই সমালোচিত হয়েছি। আমাদের সময় কিছু নায়িকা প্রভাবশালীদের ছায়াতলে ছিলেন। তাদের নামে কোনো খারাপ কথা হয়নি। আমি কারো ছায়ায় ছিলাম না বলেই আমাকে নিয়ে বিভিন্ন খারাপ কথা লেখা হয়েছে পত্রপত্রিকায়।

রাইজিংবিডি : নায়িকারা সাধারণত রোমান্টিক ঘরনার সিনেমায় কাজ করতে পছন্দ করে। আপনার অভিনীত বেশিরভাগ সিনেমাই ছিল অ্যাকশন ঘরানার। এটা কেন?মুনমুন : আমার ক্যারিয়ারের শুরু দিকে আজকের সন্ত্রাসী নামের একটি সিনেমায় কাজ করি। সিনেমাটির  নায়ক ছিলেন মান্না। এই সিনেমায় অভিনয় করার পরেই আমি রাজনীতির শিকার হই। আমারও প্রত্যাশা ছিল রোমান্টিক চরিত্রে অভিনয় করব। তবে সে সুযোগ না পেয়ে আমি টারজান কন্যা সিনেমায় চুক্তিবদ্ধ হই। এই সিনেমা ছিল অ্যাকশন ধাচের। সিনেমাটি ভালো ব্যবসা করায় আমার কাছে অ্যাকশন ধাচের সিনেমার প্রস্তাব আসতে শুরু করল। সেই থেকে আমি বাংলাদেশের ‘অ্যাকশন কুইন’ হয়ে গেলাম।

 

রাইজিংবিডি : চলচ্চিত্র ছাড়া মিডিয়ার আর কী কাজ করছেন?মুনমুন : চলচ্চিত্রের বাইরে নানা ধরনের কাজের প্রস্তাব পাই। সারা দেশ থেকেই স্টেজ শো করার প্রস্তাব পাই এখন। বাছাই করা কিছু অনুষ্ঠানও করছি। এ ছাড়া বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলো থেকেও প্রস্তাব আসে নানা অনুষ্ঠানের। এখন তো একটি চ্যানেলের সিনেমা বিষয়ক অনুষ্ঠানের সঞ্চালনাও করছি। এর বাইরে পরিবারকে সময় দিই।

 

রাইজিংবিডি : আপনি যে স্টেজ শো করছেন, এটাকে কীভাবে দেখছেন?মুনমুন : স্টেজ শোতে খারাপ কিছুই দেখি না আমি। ভারতের জনপ্রিয় সব শিল্পীরা স্টেজে শো করেন। সে সব অনুষ্ঠান তো ভালোভাবেই নিচ্ছি। তাহলে আমরা স্টেজ শো করলে সমস্যা কোথায়? আমাকে যারা মুনমুন বানিয়েছেন তাদের সামনে গিয়ে পারফর্ম করতে পেরে আমার ভালো লাগে।

 

রাইজিংবিডি : চলচ্চিত্রে আপনার কিছু পাওয়ার বাকি আছে কি?মুনমুন : চলচ্চিত্রে থেকে যা কিছু পাওয়ার তা আমি পেয়ে গেছি। সব চেয়ে বড় যা পেয়েছি তা হলো দর্শকদের ভালোবাসা। এটাই সবচেয়ে বড় পাওয়া। এখন সময় নতুনদের। তাদেরকেই সুযোগ দেওয়া উচিত।

 

রাইজিংবিডি : আমাদের সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।মুনমুন : আপনাদের এবং আমার দর্শকদেরও ধন্যবাদ।

 

ছবি : সাগর খান।

   

রাইজিংবিডি/ঢাকা/৭ জুন ২০১৫/রাহাত/রাশেদ শাওন/মারুফ/সাইফুল