জাতীয়

মিতুর বিবাহযাত্রা!

তানজিনা ইভা : ফারজানা মিতু। রাজধানীর উত্তরায় তিন বছর ধরে একটি বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি করছেন। গ্রামের বাড়ি কুষ্টিয়া জেলার আহাম্মদপুর গ্রামে। বাড়িতে আছেন বাবা-মা আর ছোট ভাই রিপন। পরিবারের আর্থিক অবস্থা খুব বেশি ভালো না। গ্রামের বাজারে বাবার একটি দোকান আছে। তাই দিয়ে এতকাল চলেছে তাদের সংসার।

 

কিন্তু পড়াশোনা? এ নিয়ে তো তাদের চিন্তার শেষ ছিল না। বাবার স্বপ্ন যেভাবেই হোক সন্তানদের লেখাপড়াটা চালিয়ে যেতে হবে। মিতু তখন সবে এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। তখনই থেকেই মূলত শুরু পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার সংগ্রাম। এসএসসি পরীক্ষার ফরম পূরণ করার সময়ই মায়ের পোষা শখের ছাগলটাকে বিক্রি করতে হয়েছে। এখন আবার এইচএসসিতে ভর্তি, বই-খাতা কেনার ঝামেলা, তার মধ্যে প্রাইভেটের টাকা জোগাড় করা। কীভাবে আসবে এত সব?

 

মিতু দমে যাওয়ার মতো মেয়ে নয়। বাবার স্বপ্ন তাকে পূরণ করতেই হবে। বাড়ির পাশে অল্প জায়গাতে কিছু কলার গাছ, লাউ, মিষ্টি কুমড়ার গাছ লাগায় মিতু নিজেই। সঙ্গে বাড়িতে বিকেলবেলায় পাঁচজন স্কুল ছাত্রকেও প্রাইভেট পড়ায়। এসব দিয়ে এগোতে থাকে মিতু। মাঝে মাঝে যখন ঝামেলায় পড়ে তখন ছোট খালা তো আছেনই। তিনিই মিতুর বিপদের দিনগুলোতে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করেছেন। গ্রামের কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে মিতু। যেদিন পরীক্ষার ফল প্রকাশ হয় সেদিন মিতুর বাবা যে কী খুশি!

 

একদিকে পরীক্ষার ভালো ফলের জন্য যেমন আনন্দ হচ্ছে, তেমনই মনের আকাশে উঁকি দিচ্ছে দুশ্চিন্তা। মেয়ে বড় ক্লাসে পড়বে, এত খরচের জোগাড় হবে কোথা থেকে?

 

আশা সমিতি থেকে ৫ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছে মিতুর মা। তাই দিয়ে মিতু বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দেবে। এদিকে মিতুরও চিন্তার শেষ নেই। বাবা-মা এত কষ্ট করে পড়ালেখা করাচ্ছে, যদি বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স না হয়। আল্লাহ তো সঙ্গে আছেন, সেই সঙ্গে মিতুর চেষ্টা।

 

ঋণের টাকা দিয়ে ঢাকা, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দেয়। প্রথমে পরীক্ষা হলো রাজশাহীতে। সেখানে চান্স হয় ইনফরমেশন সায়েন্স অ্যান্ড লাইব্রেরি ম্যানেজমেন্ট বিভাগে। তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তবে সেখানে তার সুযোগ হয় সমাজবিজ্ঞানে। মিতু সিদ্ধান্ত নেয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার। চান্স পেয়ে যেন আরো বিপদ। কীভাবে চলবে এখন পড়াশুনা। ওই যে ছোট খালা। তিনি থাকলে বোধহয় এ জীবনে আর অনার্স পড়াটা হতো না। তার সাহায্যেই মিতু ঢাকাতে আসে। বিশ্ববিদ্যালয়ে সিট না পেয়ে মেসে ওঠে। সেখানে তার মতো আরো পাঁচজন মেয়ে থাকে। তবে আর পাঁচজনের মতো তার চলাফেরা নয়। সবার থেকেই সে ভিন্ন।

 

ক্লাস শুরুর পর ডিপার্টমেন্টের বড় আপুদের বলে তিনটা টিউশনি ঠিক করেছে মিতু। সবাই বিকেলে যখন আড্ডায় ব্যস্ত মিতুকে তখন ছুটতে হয় টিউশনিতে। টিউশনি পাওয়ার পর তার কষ্টটা একটু কমেছে। মাস শেষে খালার কাছে আর আগের মতো হাত পাততে হয় না। নিজেরটা নিজেই ম্যানেজ করে। শুধু পরীক্ষার সময় খালাকে স্মরণ করতে হয়। হাজারটা কষ্ট শিকার করে শেষ করেছে অনার্স পরীক্ষা।

 

পরীক্ষার পর বেশ ভালো একটা চাকরিও পেয়েছে। যেদিন চাকরি পাওয়ার সুখবরটা বাবা-মাকে দিলো সেদিনের থেকে আর বেশি সুখের দিন বোধহয় আর একটাও আসেনি তার জীবনে। গত তিন বছরে অনেক কিছুই করেছে মিতু। বাড়িতে একটি আধা পাকা ঘর তুলেছে। বাবার দোকানেও কিছু অর্থের যোগান দিয়েছ। সেই তো এখন পরিবারের মধ্যমণি।

 

সমাজের আর পাঁচটা লোক যখন তার বাবাকে বলে তোমার মেয়ে তো একটা ছেলের থেকেও ভালো। বাবার মন তখন গর্বে ভরে ওঠে।

 

রিপনেরও পড়াশুনা চলছে। এবার নবম শ্রেণিতে উঠবে। এইতো সেদিন ছোট ভাই যখন জেএসসি পরীক্ষা জিপিএ ৫ পেলো মিতুর কী যে খুশি। তার মতো আর ভাইকে কষ্ট করতে হবে না। তার সব পড়াশুনার খরচ যোগানোর দ্বায়িত্ব মিতুর। রিপনের রেজাল্টের পর তিন দিনের ছুটিতে মিতু বাড়িতে গিয়েছিল। ওই সময় বাড়িতে একটি মিলাদ দিয়েছে। আমন্ত্রণ জানিয়েছে মামা-খালা, ফুপু-চাচাসহ প্রায় সব আত্নীয়কে। সাবাই মিতুর বাড়িতে আসে। তাদের মুখে যেন মিতুর প্রশংসার শেষ নেই। এতে অবশ্য মিতুর ভালোই লাগে। তবে মনে পড়ে কষ্টের দিনগুলোর কথা। যখন তার মা-বাবা আর ছোট খালা ছাড়া পাশে কেউ ছিল না। যাই হোক, সেসব দিন তো পার হয়েছে।

 

ওই দিনই তার বড় ফুপু মিতুর বিয়ের কথা বলে তার বাবার কাছে। বাবা অবশ্য বেশ কয়েক মাস ধরেই তার বিয়ের কথা বলছে। মিতুরও একই  চিন্তা। পরিবারটাকে তো মোটামুটি গোছানো হয়েছে। এবার তাহলে বিয়ে না করার সিদ্ধান্তটা বদলানো যেতে পারে। যেই কথা সেই কাজ। পরের দিনই ছেলে, ছেলের ভাই এসে মিতুকে দেখে গেছে। তাদেরও পছন্দ। তবে এখনই তো আর বিয়ে করা সম্ভব না। অফিসের ছুটি মাত্র তিন দিন। মিতু জানিয়েছে সামনে ঈদের ছুটির সঙ্গে আর সাত দিন অফিস থেকে ছুটি নেবে। ওই সময় না হয় বিয়ের কাজটা শেষ করা যাবে। এভাবেই কথা হলো দুই পরিবারের। মিতু ঢাকায় ফিরেছে। মামাতো ভাইকে সঙ্গে নিয়ে এখান থেকেই বিয়ের জন্য কিছু কেনাকাটা করবে বলে চিন্তা করেছে মিতু। মাত্র এক মাস বাকি। এরমধ্যেই সব করতে হবে। ঈদে পরিবারের জন্য নিজের জন্য আর বিয়ের মোটামুটি কেনাকাটা শেষ করেছে মিতু। দেখতে দেখতে  ঈদ এগিয়ে এলো। অফিস থেকে আরো সাতদিন ছুটি নেওয়া হয়েছে।

 

রোববার সকালে গাবতলী থেকে বাসে মিতু আর তার মামাতো ভাই শাহীন। শাহীন তার থেকে চার-পাঁচ বছরের বড়। তার একটা মেয়েও আছে। ঢাকায় চাকরি করে শাহীন। মিতুর বিয়েতে শাহীনের বেশকিছু দায়িত্ব তার ওপর পড়েছে। গাড়িতে উঠেই বাবা-মাকে ফোন করেছে মিতু। বাড়িতে বেশ আনন্দময় একটা পরিবেশ। সবাই অপেক্ষা করছে বিয়ের কন্যা কখন বাড়ি আসবে। বিকেল ৪টার দিকে মিতুর বাবা আবার ফোন করেছে। মিতুরা ততক্ষণে চৌড়হাঁস মোড়ে। মিতু জানায় আর কিছুক্ষণের মধ্যে পৌঁছাব, বাবা। মিতু ফোনটা রেখে বাসের জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। মনের মধ্যে একরকম অস্থির আনন্দ কাজ করছে। আর কিছুক্ষণ পরই বাড়ি পৌঁছাবে।

 

এ সময় সামনে থেকে একটি ট্রাক এসে তাদের বাসের সামনে ধাক্কা দেয়। বিকট শব্দ। বাসের যাত্রীদের চিৎকার। মুহূর্তেই এতো বড় বাসটি দুমড়ে-মুচড়ে গেছে। ঘটনাস্থেলেই চারজন মারা গেছেন। মিতুর মাথায় লেগেছে। কপাল বেয়ে রক্ত পড়ছে। শাহীনের পায়ে লেগেছে। মনে হচ্ছে, পায়ে শক্তি পাচ্ছে না। স্থানীয় লোকজনই তাদের উদ্ধার করে কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করেছে। শাহীন বাড়িতে খবর দিয়েছে। মিতুর বাড়ি থেকেও লোকজন এসেছে। হাসপাতালের বেডে রাখা হয়েছে মিতুকে। মিতুর দুর্ঘটনার খবর শোনার পর থেকেই মা বারবার জ্ঞান হারাচ্ছেন। খালি পায়ে ছুটে এসেছেন বাবা। কিন্তু ততক্ষণে তো সব শেষ। বাবা শুধু মিতুর হাতটা ধরে আছে। তার চোখ থেকে অঝোরে ঝরছে জল।

   

রাইজিংবিডি/ঢাকা/৭ আগস্ট ২০১৫/ইভা/রফিক