জাতীয়

অবশেষে ফেরা

|| স্বপ্না ইসলাম ছোঁয়া ||ঘুম থেকে উঠেই শিয়রের কাছ থেকে ফোনটা হাতে নিয়ে অহনা দেখল আবিরের ১১টা মিসড কল। ভ্রু কুঁচকে গেল তার- এই সকাল সকাল মহারাজার এতগুলো মিসড দেয়ার কারণ কী?বিরক্তি ভাব নিয়ে কল ব্যাক করলো। রিং বাজার সাথে সাথেই খট করে ধরে ফেললো আবির-‘হ্যালো, কি রে এতগুলো কল দিছিস, কোন প্রব্লেম?’‘ভাল আছিস তো তুই?’ হাই তুলতে তুলতে অহনার জিজ্ঞাসা।আবির ব্যাপক উচ্ছ্বাস নিয়ে বলল,‘মরছিলি নাকি তুই? এতবার ট্রাই মেরেও তোমার সাড়া পাইলাম না।আজীব!তা মহারানী আপনার ঘুম কি এইমাত্র ভাঙিলো?’অহনা বিরক্তি ভাবটা আটকাতে পারল না।সকালবেলা ওর কথার ঢঙ শুনে মেজাজ গরম হয়ে গেল- ‘তুই আবার এমন টাইপের কথাবার্তা শুরু করেছিস? চণ্ডাল একটা।এসব বলার জন্যে কল দিয়েছিলি? ওকে, রাখলাম, ভার্সিটিতে দেখা হবে।’ধড়ফড়িয়ে উঠলো আবির, আহত কণ্ঠে বলে উঠলো,‘এই,এই ফোনটা রাখিস না প্লিজ, দোস্ত, জরুরি কথা আছে। সেইজন্যেই ফোন করেছিলাম। আর বলব না। শোন না দোস্ত, আমার না হয়ে গেছে।’অহনা বেশ অবাক হলো। ও কী পাগল হয়ে গেল নাকি? অদ্ভুত কথাবার্তা বলছে। অহনা কৌতূহল নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,‘কি হয়ে গেছে রে? বাচ্চাকাচ্চার বাপ হইছিস নাকি?’ বলেই মুখ টিপে হাসতে লাগলো। ও জানে আবির এবার রেগে যাবে, উল্টাপাল্টা কথা বলবে।কিন্তু কিছুই হল না।আবির শান্ত গলায় বলল, ‘মাম্মা, যতই পঁচানি দাও আমায়, আমি আজ  রাগ করব না, কারণ আজ  আমার সবচেয়ে খুশীর দিন।আর সেই খুশীটা তোমার সাথে ভাগাভাগি করব বলেই ফোন দেয়া। এখন শোন বালিকা,রিয়ার সাথে আমার প্রেমটা হয়ে গেছে। কোন রিয়ার কথা বলছি, চিনতে পারছিস তো? আমার ফ্রেন্ড তন্ময়ের কাজিন, সে অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে, আমাদের ভার্সিটিতেই। এই খবরটা তোকে দেব বলে সারারাত ঘুমুইনি আমি।খুব, খুব-ই খুশী রে আমি।’ বলেই খট করে লাইনটা কেটে দিল।এদিকে আবিরের কথাগুলো শোনার পর অহনার কাছে মনে হল, দূর, বহুদূর থেকে একটা পাথর ছুটে এসে মনের দেয়ালে আঘাত করল। এবং নিমিষেই কাচের টুকরোর মত ঝনঝন করে ভেঙ্গে মাটিতে পড়তে লাগলো।নিজের মনের দেয়ালের ভাঙন নিজের কানে শুনতে পেল সে। কানে কে যেন গরম সীসা ঢেলে দিয়ে স্তব্ধ করে দিল এক মুহূর্তেই।কেন এমন হচ্ছে? কেন পৃথিবীটা ক্রমশ ছোট হতে লাগলো অহনার কাছে। সে তো আবিরকে শুধুই বন্ধু ভেবে এসেছে- একজন ভাল বন্ধু, ভাল তো বাসেনি। তবে কেন তার এমন মনে হচ্ছে? আবির বহুবার তাকে ‘ভালবাসি’ বলার চেষ্টা করেছে, অহনা বুঝেও না বোঝার ভান করে সরে পড়েছে, তার একটাই কথা-ভালবেসে বিয়ে করে কেউ কখনো সুখী হতে পারে না। চোখের সামনে বাবা-মা কে দেখছে। বড়আপুও ভালবেসে বিয়ে করে আজ  অসুখী। বিয়ের আগে একটা সম্পর্কের মাঝে শুধু ভালবাসা থাকবে, আর বিয়ের পর সেই ভালবাসা কর্পূরের মত উবে যাবে, এটা সে কিছুতেই মেনে নিতে পারে না, তাই আবির কে সে বুঝিয়েছে- সব সম্পর্কগুলো কেন সোশ্যাল বাইন্ডিং-এ আবদ্ধ করে তুলতে হবে? বন্ধুত্বই ঠিক আছে, প্রেম ভালবাসা এসবের দরকার নাই। আবির ওকে অনেকবার বোঝাবার চেষ্টা করেছে- সব সম্পর্কগুলো ওর বাবা-মা, বা ওর আপুর সম্পর্কের মত শ্যাওলা পড়ে না, এর বাইরেও অনেকেই সুখী হয়। কিন্তু অহনা এত কিছু বুঝতে নারাজ, কেননা সে চোখের সামনে যা দেখছে তাই বিশ্বাস কলে। এটাই স্বাভাবিক। এই কারণে ওদের বন্ধুত্বটা প্রেমে গড়ায়নি। কিন্তু আজ যখন আবির কারোর সাথে সম্পর্কে জড়াচ্ছে তখন অহনার এত খারাপ লাগছে কেন? ওর তো খুশী হওয়ার কথা। তবে কি সে আবিরকে নিজের অজান্তেই ভালবেসে ফেলেছে? না-না এসব সে কি ভাবছে।বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লো অহনা। ফ্রেস হয়ে নাস্তার টেবিলে এল। বাবা সকালেই বেরিয়ে যায়, মা এক কাপ চা নিয়ে বারান্দায় বসেছিল। অহনাকে দেখেই আবার টেবিলে এল, পানসে গলায় বলল, ‘কি রে মুখটা অমন শুকনো লাগছে কেন? রাতে ঘুমাস নাই?’অহনা ম্লান মুখে স্মিত হেসে জবাব দিল, ‘ঘুমিয়েছি তো মা, তোমার এমন মনে হবার কোনো কারণ নেই,আমি ঠিক আছি। মাটিতে দৃষ্ট রাখল অহনা। এই বুঝি ছলছল চোখ দেখে মা আবার হাজার প্রশ্ন জুড়ে দেন। তারপর গলায় বেশ জোর টেনে বলল, ‘মা আজ দুপুরে হাঁসের মাংস আর ভুনা খিচুড়ি রান্না করবে? খুব খেতে ইচ্ছে করছে। আজ আর ভার্সিটিতে যাবো না। কিছু নোট আছে সেগুলো তুলতে হবে।বাসায়-ই আছি।’অহনার অদ্ভুত লাগে, একটা মানুষ কি করে এত অন্যায় অবিচার নির্বিবাদে মেনে নেয়? মাকে সে খুব কম রাগ করতে দেখেছে,বাবা-ই সব সময় একটু কিছু হলেই চিৎকার চেঁচামেচিতে পাড়া-পড়শির ঘুম নষ্ট করে ফেলে। বাবা যতো বেশি রেগে যায় মা তত বেশি মিইয়ে যায়,কেন এমন করে? সে প্রতিবাদের ভাষা না জানুক অন্তত ফোঁস করে তো ওঠতে পারে, বাবাকে দিন দিন প্রশ্রয় দিয়ে আরও  বেশি অপরাধী হচ্ছেন মা, এটা অহনার ধারণা। বাবা কথায় কথায় বলেন- কোন কুক্ষণেই যে তোমাকে বিয়ে করতে গেছিলাম, অসহ্য একটা মানুষ তুমি। অথচ বিয়ের আগে বাবা নাকি আমার মাকে প্রচণ্ড ভালবাসতেন। তাদের দুই পরিবারের অমতেই তারা গোপনে বিয়ে করেছিলেন তাদের ভালবাসা রক্ষা করার জন্যে। সেই ভালবাসা স্বার্থপরের মতো এদের ফাঁকি দিয়ে মিলিয়ে গেল। অহনা মনে মনে ক্ষেদোক্তি করে, ভালবাসা বলতে কিচ্ছু নাই,সব মোহ,হয় শরীরের না হয় টাকার।রুমে এসে ছোট্ট ডায়েরিটা হাতে নেয় অহনা। অনেকদিন কিছু লিখা হয় নি এতে। আজ  কিছু লিখতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু কি লিখবে সে? আবিরের কথা? নিজের না বলা কথা,নাকি নতুন করে যে ভাবনাগুলো উঁকি দিচ্ছে মনের মাঝে তার কথা? কয়েকটা সাদা পৃষ্ঠা রেখে মাঝ বরাবর লিখতে শুরু করলো।: আবির একটা মুক্ত আকাশের নাম, আর সেখানে অহনা নামের একটা সূতা ছিন্ন ঘুড়ি সারাক্ষণ নির্দ্বিধায় উড়ে বেড়াত। যার অস্তিত্বে মিশে ছিল আকাশের এক মুঠো শুভ্র মেঘ। অহনা আর আবির, যেন জন্মের সময়ই একাত্মতা ঘোষণা করে বের হয়েছিল, এই অস্তিত্ব কখনো বিচ্ছেদ্য হবার কথা নয়। আজ  এই অস্তিত্বে ফাঁটল ধরেছে, দুই ভাগ হবার জন্যে, তার ভাগে খুব বেশী অংশ পড়বে না হয়ত, কেননা, ভালবাসার মানুষকে সব সময় বেশী অংশ দিতে হয়, বন্ধুত্বের হিসেব কোথাও বেশী হয় না।এমনও হতে পারে, সে আবিরের কোন অংশেই তার নাম দেখতে পেলো না, এটাই নিয়ম, এটাই নির্মম সত্যি। কিন্তু এই ফাঁটল সে মেনে নিতে পারবে না। তাহলে কি অহনা আর আবিরের চ্যাপ্টার এখানেই শেষ হয়ে যাবে? হয়ত তারই উচিৎ এখন আবিরকে গুছিয়ে নিতে নিজেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে ওকে সময় দেয়া।এসব লিখে সে কম্পিউটারের সামনে বসলো, আজ  খুব ফাঁকা লাগছে সব কিছু। শূন্যতা তাকে অক্টোপাসের মত আটকে ধরেছে। হঠাৎ দেখল স্কাইপিতে ওর ভাই সজল,সে আজ  ৫ বছর ধরে কানাডায় আছে,অহনাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য অনেক বার বলেছে,কিন্তু অহনা সাফ সাফ না বলে দিয়েছে,তবুও সে অহনার কাগজপত্র গুছিয়ে রেখেছে,যদি ও মত পাল্টে নেয়, সে এখন অনলাইনেই আছে। নক করে বলল, ‘ভাইয়া কল দিতে পারবে? কথা বলবো।’মিনিট পাঁচেক পর স্কাইপিতে ভাইয়া ফোন দিল। অহনা মনে জোর নিয়ে কুশলাদি জিজ্ঞেস করে নিল প্রথমে, এরপর দ্বিধা না করেই বলে ফেললো,‘ভাইয়া, আমার কাগজপত্র রেডি কর, আমি তোর কাছে চলে আসব।’ভাইয়া মৌন চিন্তা করে বলল,‘কি রে তোর কিছু হয়েছে নাকি? এতদিন এত সাধার পরও আসতে রাজী হলি না, আর আজ  হঠাৎ বলে ফেললি-চলে আসবি? এনিথিং সিরিয়াস?’অহনার বেশ কান্না পাচ্ছিল, তবুও মনের জোর ধরে রেখেই বলল, ‘না ভাইয়া, কিচ্ছু হয় নাই, চিন্তা করে দেখলাম, মাস্টার্স শেষ করার পর চাকরি বাকরি পাব কিনা সন্দেহ আছে। তারচেয়ে বরং চলেই যাই।’ভাইয়া কি যেন ভাবল,আর কথা বাড়াল না। শুধু বলল, ‘ওকে তাই হবে,ভাল থাক,এখন রাখছি রে বলে লাইনটা কেটে দিল।’অহনা বিছানায় শুয়ে শুয়ে অনেক কথা ভাবছিল, যেগুলোর কোন কারণ নেই, কোনও মানেও নেই।এমন সময় আবিরের ফোন-‘ কিরে ক্লাসে এলি না যে? শরীর খারাপ?’অহনা ধীর গলায় উত্তর দেয়,‘না তো, কিচ্ছু হয় নাই, ছোট খালা এসেছে অনেকদিন পর,আড্ডা দিচ্ছি, এখন রাখি, পরে কথা হবে।’ বলেই ফোনটা কেটে দিল।একটা মিথ্যে ঢাকতে গিয়ে আজ  অহনা ক্রমাগত মিথ্যে বলে যাচ্ছে। কি দরকার এতগুলো মিথ্যে কথা বলার।মনের মাঝে ঝড় বয়ে যাচ্ছে, আসলেই কি সেটা মিথ্যে ছিল নাকি? আবিরকে ভালবাসাটা যদি মিথ্যেই হয় তবে কেন এই লুকোচুরি? ধুর আর কিছু ভাবতে পারছে না সে।পরদিনও অহনা ভার্সিটিতে গেল না। আবির ক্লাসে ঢুকেই অহনার খোঁজ করলো। শুধুমাত্র খালা এসেছে বলে অহনা ক্লাসে আসছে না, এটা যেন ওর হিসেবে মিলছে না। ও ক্লাস শেষে অহনার বাসায় চলে এলো সরাসরি।ড্রইংরুমে আবির বসে আছে বুয়ার মুখে শোনার পর অহনার মুখটা অদ্ভুত এক আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো।দৌড়ে রুম থেকে বেরুতে যাবে এমন সময় অজানা শঙ্কায় মুখটা পাংশুবর্ণ হয়ে গেল। ও পিছিয়ে গেল এক পা, দুপা করে। অহনা কিছুতেই আবিরের কাছে ধরা পড়তে চায় না। বুয়াকে বলল, ওকে গিয়ে বলো-‘আপা ঘুমাচ্ছে।’ বুয়া ইতস্তত করে বেরিয়ে গেল।অহনা দৌড়ে বারান্দায় এসে দাঁড়াল। এখান থেকে রাস্তাটা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে সে। আবির বাইকটা নিয়ে বেরিয়ে গেল, যাবার সময় বারবার অহনাদের বাসার দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখছিল।ওর হয়ত বিশ্বাস হয়নি অহনা ঘুমাচ্ছে।কারণ এর আগেও সে যখন অহনাদের বাসায় আসতো তখন মাঝে মাঝেই অহনা ঘুমিয়ে থাকতো,কিন্তু বুয়া গিয়ে খবর দিলে ও ঘুম থেকে লাফ দিয়ে ওঠেই দৌড়ে চলে আসতো। তারপর ছাদে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলত ওরা। কি এমন কথা হত অহনা মনে করার চেষ্টা করতে লাগলো। তেমন প্রয়োজনীয় কথা বার্তা নয়, তবু তাদের সময় কেটে যেত বেশ। আজ  সামান্য একটা কারণে ওদের সম্পর্কটা ধুলোর আস্তরণে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। কিন্তু কেন? অহনা নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করছে, এবার ও মন মৌন ভূমিকা পালন করলো। কোন উত্তর নেই।পরদিন নিজের মন বেশ শক্ত এবং শান্ত করে ভার্সিটিতে গেল অহনা। অহনা বুঝতে পারছে, তার এই পালিয়ে বেড়ানোই সব প্রশ্নের উত্তর ক্লিয়ার করে দেবে, তাই আর নয় লুকোচুরি। আবিরের সামনে সে যাবে, এবং আগের মতোই দৃঢ় চিত্তে। কথা বলবে খুব চিন্তা করে, যাতে আবির ঘুণাক্ষরেও বুঝতে না পারে, অহনার ভেতরের অহনা কি চায়। ক্লাসে অহনাকে দেখে আবির মনে হয় অনেক খরতার মাঝে এক আঁজলা বৃষ্টি খুঁজে পেয়েছে। সে কি উচ্ছ্বাস।উল্লসিত কণ্ঠে বলে উঠলো, ‘তুই এসেছিস দোস্ত? খুব খুশী লাগছে রে আমার, কি হয়েছিল তোর? ফোন দিলে ঠিকমতো ফোন ধরছিস না? ক্লাসে আসছিস না, বাড়িতে গেলাম তাও তোকে পেলাম না। কোন সমস্যা?’অহনা কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলে, ‘আরে নাহ, কিচ্ছু হয় নাই। তোর কি খবর? রিয়ার সাথে সব কিছু ঠিকঠাক মতো চলছে তো?’আবির শান্ত গলায় বলল, ‘তুই-ই নাই ভাল আর চলি কেমনে,তুই বল?’অহনা মুচকি হেসে বলে, ‘এইত আমি আছি।’আবির অহনার হাসিটা লক্ষ্য করলো। বুঝতে পারল, সামথিং ইজ মিসিং। যে অহনাকে সে চিনে, এর সাথে সেই অহনার বিস্তর ফাঁরাক। জোর করে সব কিছুই হয়ত পাল্টানো যায়, কিন্তু চোখের ভাষা বদলাতে হলে যে এক জনম তপস্যা করতে হবে, সে ক্ষমতা অহনার নেই। আবির আর কিছু বলল না।এভাবেই পানসে একটা সম্পর্কের মাঝে ওরা ধীরে ধীরে লীন হতে লাগলো। আজ ১৪ ফেব্রুয়ারি। অহনার ফ্লাইট আজকে। কাউকেই অহনা্ এ কথা জানায়নি। অবশ্য আবির ছাড়া তার তেমন ঘনিষ্ঠ কোন বন্ধু-বান্ধবীও নেই, যার কাছে সে মনের কথা খুলে বলতে পারে। এ জন্যেই অহনা ছোটবেলা থেকেই চাঁপা স্বভাবের হয়ে বড় হয়েছে। সকাল থেকে মা`র মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। তার একটা বড় সাপোর্ট সে আজ  হারাতে বসেছে। দুঃখের কথা সে কাউকেই শেয়ার করত না, জানে সে, দুঃখগুলো তার একার, শুধুই একার। এগুলোর ভার কেউ নেয় না। কিন্তু অহনাকে কিছু বলতে হত না, সে সব সময় মা`য়ের মুখ দেখে সব উপলব্ধি করে নিত। আজ এই উপলব্ধির মানুষটাও হারিয়ে যাচ্ছে।অহনা যথসময়ে বাসা থেকে এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে রওনা হল। সাথে বাবা-মা দু`জনেই গেছেন। দু`জনের চোখই ছলছল। কেউ কারোর সাথে তেমন কথা বলছে না। আবির বেশ কয়েকবার ফোন দিল, অহনা কেটে দিচ্ছে দেখে বাইক নিয়ে অহনাদের বাসার দিকে ছুটল। বাসায় কয়েকবার কলিং চাপল, খোলার নাম নেই, অনেকক্ষণ ধাক্কাধাক্কির পর, বুয়া ঘুম জড়ানো চোখে এসে দরজা খুলে দিয়ে আবার সোফার নিচে বসে ঝিমুতে লাগলো। আবির কোন কথা না বলে অহনার রুমে সরাসরি ঢুকে গেল। অহনা নেই, ঘরটা কেমন খা খা করছে। অজানা এক আশংকা মোচড় দিয়ে উঠলো আবিরের মনে। ডেস্ক টেবিলে ছোট্ট একটা ডায়েরি। আবির ইতস্তত করতে করতে ডায়েরিটা হাতে নিলো। প্রথম দিকে সাদা পৃষ্ঠা,তেমন কিছু নেই। হঠাৎ মাঝ বরাবর গিয়ে চোখ আটকে গেল। পুরো পৃথিবী দুলে উঠলো। চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। আর কিছু দেখতে পারছে না, কেবলই মনে হচ্ছিল কয়েকটি কালো অক্ষর তির্যকভাবে তাকে খুবলে খুবলে রক্তাক্ত করে দিচ্ছে। এটা কি করলো আবির। আর ভাবতে পারছে না, ঘুরে দাঁড়াতেই বুয়ার মুখোমুখি হয়ে গেল।বুয়া অপলক তাকিয়ে আছে তার দিকে। আবির কোনমতে জিজ্ঞেস করলো, ‘অহনা কোথায়?’বুয়া ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলল,‘অম্মা!আফনে জানেন না? আফা তো আইজকা ৭টার ফেলাইটে বিদেশ যাইতাছে গা।’আবির কথা না বাড়িয়ে বাইক চালালো এয়ারপোর্টের দিকে। এরচেয়ে বেশী স্পীডে সে কখনো বাইক চালায়নি। ও যখন এয়ারপোর্টে পৌঁছলো তখন প্রায় ৬টা বাঁজে। অহনাকে দেখতে পেল না, চারিদিক চোখ বুলিয়ে নিল। নাহ নেই। মিনিট দশেক পর অহনাদের গাড়ি এসে থামল। অহনা গাড়ি থেকে নেমেই দেখতে পেল আবির দাঁড়িয়ে আছে। ওর পা দুটো ক্রমশ নিশ্চল হয়ে যেতে লাগলো। আবির দৌড়ে এসে অহনার সামনে দাঁড়ালো। অহনা নীল রঙের সালোয়ার কামিজে মুখের নীল বেদনার ছাপটা পুরোপুরি ঢাকতে সক্ষম হলো না। ছলকে ছলকে বেরিয়ে পড়ছে বেদনার টুকরোগুলো।আবির পকেট থেকে দুমড়ানো মুচড়ানো লাল গোলাপ বের করে অহনাকে দিয়ে বলল, ‘হ্যাপি ভ্যালেন্টাইন ডে। আই লাভ ইউ সো মাচ। ডু ইউ লাভ মি?’অহনার চোখ দিয়ে ভালবাসার সমস্ত বন্ধন উপেক্ষা করে অঝোর ধারায় বর্ষণ হতে লাগলো। সে নীরবে তাকিয়ে আছে আবিরের দিকে।আবির আবার বলে উঠলো,‘উইল ইউ ম্যারি মি? কথা দিচ্ছি এই ছেলেটা আর কিছু পারুক আর নাই পারুক। তোকে কাঁদতে দিবে না কক্ষনো। এখন থেকে তোর কান্নার সব হিসেব আমার।’অহনা কান্না করতে করতেই বলল, ‘অনেক ভালবাসিরে। কিন্তু রিয়ার কি হবে?’আবির কৌতুকের সুরে বলে উঠলো,‘ধুর!বিবাহিতা মেয়ের আবার বিয়ে হয় নাকি? ও তো তন্ময়ের বাগদত্তা।’অহনা আবিরের পিঠে দুম করে কিল মেরে বলে উঠল, ‘তার মানে এসব মিথ্যে?’আবির হাসতে হাসতে বলল, ‘এইটুকু অভিনয়ের জন্যেই তোর ভালবাসাটা প্রকাশ হল। তোকে আমার করে পেলাম।’দূরে দাঁড়িয়ে বাবা-মা হাসছিলেন। তারাও কখন যে কাছাকাছি চলে এসেছেন নিজেরাও জানেন না।রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৫/তাপস রায়