জাতীয়

ভাষাসংগ্রামী থেকে মুক্তিযোদ্ধা জালাল উদ্দিন আহমেদ

মো. জামাল মল্লিক, শরীয়তপুর : শরীয়তপুর জেলার যে ক’জন কৃতী সন্তান ১৯৫২ সালের মহান ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন তাদের মধ্যে জালাল উদ্দিন ছিলেন অন্যতম ভাষাসংগ্রামী। ১৯৫২ সালে যখন ভাষা আন্দোলন শুরু হয় তখন থেকেই জালাল উদ্দিন আহমেদ এই আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। এই ভাষার মাসে তার ভাষা আন্দোলনে যোগ দেওয়াসহ ভাষা আন্দোলনের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তার স্মৃতিকথা তুলে ধরা হলো :

 

রাইজিংবিডি : ভাষা আন্দোলনের সময় আপনি কোন শ্রেণিতে পড়তেন এবং কীভাবে এ আন্দোলনে যোগ দিলেন?

জালাল উদ্দিন আহমেদ : ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান গঠন হওয়ার পর পাকিস্তানের কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকায় এসে ঘোষণা করলেন উর্দু হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। তার কথার সঙ্গে সুর মিলিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিনও উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা করলেন। পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ তাদের এই ঘোষণা মেনে নিতে পারেনি। বাংলা ভাষার দাবিতে যখন আন্দোলন শুরু হয় তখন আমরা শরীয়তপুরের কয়েকজন ছাত্র আন্দোলনে অংশ নেই।

 

গুরুদাস উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম-দশম শ্রেণির ছাত্র সদর উপজেলার কাগদী গ্রামের হাবিবুর রহমান মুন্সী, মজিবুর রহমান ও সেকান্দার- তাদের অনুপ্রেরণায় আমি ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করি। তখন আমি ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র এবং ওই ক্লাসের ক্যাপ্টেন ছিলাম। 

 

রাইজিংবিডি : ভাষা আন্দোলনে কোন এলাকায় অংশ নিয়েছিলেন? ঃ

জালাল উদ্দিন আহমেদ : তৎকালীন ফরিদপুর জেলার মাদারীপুর মহকুমার পালং থানার বিভিন্ন এলাকায় আমাদের মাতৃভাষা বাংলার দাবিতে আন্দোলনে অংশ নেই।

 

রাইজিংবিডি : আপনাদের কর্মসূচি কী ছিল?

জালাল উদ্দিন আহমেদ : আমাদের কর্মসূচি ছিল- বাংলা ভাষার দাবিতে পালং থানার বিভিন্ন এলাকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় বিভিন্ন শ্লোগান লেখা, পোস্টার লাগানো এবং বিক্ষোভ মিছিল করা। আমাদের শ্লোগান ছিল- ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, নুরুল আমিনের ফাঁসি চাই, আমাদের দাবি মানতে হবে।’

 

রাইজিংবিডি : আন্দোলন করতে গিয়ে আপনারা বিপদের সম্মুখীন বা গ্রেফতার হয়েছিলেন কি?

জালাল উদ্দিন আহমেদ : আন্দোলনের সময় আমাদের এক সহযোদ্ধা মজিবুর রহমানকে পুলিশ গ্রেফতার করে পালং থানায় নিয়ে যায়। খবর পেয়ে আমরা তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ জানিয়ে বিক্ষোভ করি।

   

রাইজিংবিডি : কত সাল থেকে কত সাল পর্যন্ত আপনারা ভাষা আন্দোলন চালিয়ে গেছেন?

জালাল উদ্দিন আহমেদ : ১৯৫২ থেকে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত আমারা ভাষা আন্দোলন চালিয়ে যাই। আমরা ভাষার জন্য আন্দোলন করি, অবশেষে আমাদের বিজয় হয়।

 

রাইজিংবিডি : ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন কি?

জালাল উদ্দিন আহমেদ : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে ১৯৭১ সালে দেশের জন্য মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করি। গুরুদাস উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে ট্রেনিং নেই। পালং থানা অপারেশনে অংশগ্রহণ করি। তুলাসার ইউনিয়ন থেকে যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার জন্য ভারত যান তুলাসার ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ হিসেবে আমি তাদের সার্টিফিকেট দেই। ওই সার্টিফিকেট দেখিয়ে তারা বর্ডার পার হয়ে ভারত গিয়ে ট্রেনিং নিয়ে দেশে এসে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।

 

রাইজিংবিডি : কত সালে বিয়ে করেন?

জালাল উদ্দিন আহমেদ : ১৯৭৪ সালে মুন্সীগঞ্জ জেলার হাশাইল গ্রামের আব্দুল হামিদ বেপারীর মেয়ে জোসনা আক্তারের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হই। আমার দুই ছেলে এক মেয়ে রয়েছে। তারা হলো- আরিফ উদ্দিন আহমেদ (অন্তু), সোনিয়া আক্তার ও শরীফ উদ্দিন আহমেদ (সাগর)। ১৯৯৭ সালে আমার স্ত্রী জোসনা বেগম মারা যান।

 

ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের স্মৃতি ধরে রাখার জন্য ভাষাসংগ্রামী জালাল উদ্দিন আহমেদ ’৫২-এর ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী ‘আমরা পালংয়ের ক’জন’ নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন। এই সংগঠনের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে রয়েছেন। ২০১১ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে ভাষাসংগ্রামীদের স্মৃতি ধরে রাখার জন্য প্রথম প্রকাশ করেন নিজের লেখা ‘স্মরণ ৫২’। ২০১৪ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে প্রতিটা জেলার প্রথম শহীদ মিনার দিয়ে দ্বিতীয় স্মরণ ৫২ প্রকাশ করেন। ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী সহকর্মীদের স্মৃতি ধরে রাখার জন্য তিনি সবার ছবি বাঁধাই করে রেখেছেন।   

   

রাইজিংবিডি/শরীয়তপুর/১ ফেব্রুয়ারি ২০১৬/জামাল মল্লিক/মুশফিক