জাতীয়

পুলিশের গুলি উপেক্ষা করে রাজপথে ছিলাম

শাহীন রহমান, পাবনা : বাহান্ন’র ফেব্রুয়ারি মাসে সারাদেশে যখন রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়েছিল তখন পাবনাতেও প্রচণ্ড আন্দোলনে রাজপথ কাঁপিয়েছিলেন ভাষা সৈনিকরা। বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে জেলার ছাত্র নেতা, রাজনৈতিক নেতা থেকে শুরু করে সাধারণ জনতাও ছিলেন আন্দোলনের কাতারে। গ্রেফতার হয়ে কারাবরণ করেছিলেন অনেকে। যাদের অসামান্য অবদান ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে আজও সমুজ্জল।

 

পাবনার ভাষাসংগ্রামীদের মধ্যে যারা জীবিত আছেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য রনেশ মৈত্র, অ্যাডভোকেট গোলাম হাসনায়েন ও আনোয়ারুল হক। বয়সের ভারে ন্যুজ এই বর্ষিয়ান তিন ভাষাসংগ্রামী কথা বলেছেন রাইজিংবিডির সঙ্গে। জানিয়েছেন পাবনার ভাষা আন্দোলনের সেই উত্তাল দিনের কথা।

 

রাইজিংবিডি : ভাষা আন্দোলনের সময় পাবনার প্রেক্ষাপট কেমন ছিল?

রনেশ মৈত্র : একুশে ফেব্রুয়ারিতে ছাত্রদের ওপর যে গুলি চলল ঢাকায়, তার খবরটা আমরা ইন্ডিয়ার রেডিওতে পাই। আমরা তখন শিখা সংঘের নেতারা বৈঠকে বসি। সেখান থেকে সিদ্ধান্ত নেই এর প্রতিবাদে আমরা পরদিন পাবনায় হরতাল করব। ওইদিন রাতেই প্রশাসন থেকে ১৪৪ ধারা জারি করা হল, মোড়ে মোড়ে পুলিশ দাঁড়িয়ে ছিল। আমরা কয়েকটি দলে ভাগ হয়ে টিনের চোঙা দিয়ে এক মোড়ে হরতালের ঘোষণা দেই, আবার দৌড়ে আরেক মোড়ে গিয়ে ঘোষণা দেই। পুলিশের গুলিবর্ষণের ভয়কে উপেক্ষা করে রাজপথ কাঁপিয়েছিল ছাত্র-জনতা।

 

আনোয়ারুল হক : আমি তখন আরএম একাডেমির ছাত্র। আমাদের স্কুলটি ছিল এডওয়ার্ড কলেজের পাশেই। ঢাকায় গুলি চালানোর খবর শুনে ছাত্ররা খবরের কাগজে পোস্টার লিখে মিছিলে যোগ দিয়েছিল। সভা করে পরদিন হরতাল পালনের ঘোষণা দেন। সারা পাবনা শহরে টিনের চোঙা ফুঁকে হরতাল প্রচার করেন ছাত্ররা। দেখা গেল পরদিন এডওয়ার্ড কলেজে প্রচুর ছাত্র জমায়েত হয়েছে। সেখান থেকে বিশাল মিছিল নিয়ে শহর প্রদক্ষিণ করে। সেই মিছিলে আমিও ছিলাম।

 

অ্যাডভোকেট গোলাম হাসনায়েন : আমরা তখন ক্যাপ্টেন মনসুর আলীর বাড়িতে বসতাম, ভাষা আন্দোলনের বিষয় ও করণীয় নিয়ে আলোচনা করতাম। আন্দোলনে সারা পাবনা শহর তখন এক হয়েছিল। শহরের দোকানপাট বন্ধ ছিল, সবাই স্বতস্ফূর্তভাবে হরতাল পালন ও মিছিল করেছিল। অচল হয়ে পড়েছিল পাবনা। কিশোর, ছাত্র, রাজনৈতিক নেতা, শ্রমিক, দিনমজুর সবাই ছিল আন্দোলনে। সেই আন্দোলন গ্রাম পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিল। সবার দাবি ছিল একটাই তা হল বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার।

 

রাইজিংবিডি : পাবনায় ভাষা আন্দোলনে কারা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন ?

আনোয়ারুল হক : পাবনার সেই ভাষা আন্দোলনে ছাত্র নেতারাই অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিল। তাদের মধ্যে সবচেয়ে প্রধান ভূমিকায় ছিলেন তখনকার পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের পাবনা জেলা শাখার সভাপতি আব্দুল মমিন তালুকদার। তবে ছাত্র নেতাদের পাশাপাশি রাজনৈতিক নেতারাও তখন বড় ভূমিকা রেখেছিলেন। তাদের মধ্যে ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, আমজাদ হোসেন, রওশনজান চৌধুরী, আব্দুর রব বগা মিয়া, রনেশ মৈত্র, গোলাম হাসনায়েনসহ অনেকের নাম উল্লেখযোগ্য।

 

রাইজিংবিডির সঙ্গে কথা বলছেন ভাষা সৈনিক অ্যাডভোকেট গোলাম হাসনায়েন

 

এর আগে ভাষা আন্দোলন করতে গিয়ে আটক হয়েছিলেন আমিনুল ইসলাম বাদশা, কমরেড প্রসাদ রায়, লিলি রায়, মাহবুবুর রহমানসহ অনেকে।

 

রনেশ মৈত্র : ‘উর্দূই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’ বাহান্ন’র ২৭ জানুয়ারি ঢাকায় তৎকালীন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর এই ঘোষণায় বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন ছাত্র-জনতা। সেসময় আওয়ামী মুসলিম লীগের তৎকালীন নেতা ক্যাপ্টেন মনসুর আলীর উদ্যোগে পাবনায় গঠন করা হয় ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’। এডওয়ার্ড কলেজের ছাত্রলীগ নেতা আব্দুল মমিন তালুকদারের আহ্বানে সংগঠিত হয় ছাত্ররা।

 

এ ছাড়া সেসময়ের পাবনার প্রগতিশীল তরুণদের সংগঠন ‘শিখা সংঘ’র মাধ্যমে আন্দোলনে ভূমিকা রাখেন আব্দুল মতিন, কামাল লোহানী, জয়নাল আবেদীন খান, আনোয়ারুল হকসহ অনেকে। সঙ্গে আমিও ছিলাম।

 

রাইজিংবিডি : যে উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য বুকে ধারণ করে ভাষা আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন, স্বাধীন বাংলাদেশে সেই বাংলা ভাষার চর্চা ও উদ্দেশ্য কতটুকু সঠিক পথে এগুচ্ছে বলে মনে করেন?

অ্যাডভোকেট গোলাম হাসনায়েন : দেশে যেটুকু উন্নয়ন, অগ্রগতি হয়েছে বা হচ্ছে তা কেবল বাংলা ভাষা ও তার আন্দোলনের মাধ্যম থেকেই পাওয়া বলে মনে করি। কারণ বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠা ও তার পথ ধরে পরবর্তী মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত আমাদের বাংলাদেশ। মায়ের ভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করতে না পারলে স্বাধীন বাংলা পেতাম কিনা ভেবে দেখা দরকার। তবে বর্তমানে অনেকে ইংরেজি বলতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করেন, এটা আমাকে কষ্ট দেয়। ইংরেজি শিখলেও বাংলা ভাষাকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে ভাষাচর্চা আরো ভালভাবে করা উচিত।

 

রনেশ মৈত্র : ভাষা আন্দোলনে যারা শহীদ হয়েছেন, শুধুমাত্র তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে একুশে ফেব্রুয়ারিতে আমরা যে শহীদ মিনারে যাই, ফুল দেই, প্রার্থনা করি, এটাই সব না। এগুলো যেমন করতে হবে, তেমনি প্রতিদিন আমাদের কাজ আছে, যাতে করে বাংলা ভাষা, বাংলা সাহিত্য সমৃদ্ধ হয়। আমাদের মধ্যে অনেকেই এখন সন্তানদের নাম ইংরেজিতে রাখতে পছন্দ করি। আমাদের চেতনায় বাংলা ভাষাকে লালন করতে হবে।

 

আনোয়ারুল হক : আমাদের মাতৃভাষা বাংলা, রাষ্ট্রভাষা বাংলার অনেক অগ্রগতি হয়েছে, কার্যকরিও হচ্ছে। সে সম্পর্কে আমরা অস্বীকার করব না। কিন্তু যেভাবে হওয়ার কথা ঠিক সেভাবে হচ্ছে না। যেমন ইংরেজি মাধ্যমের অনেক স্কুলে বাংলা শেখানো হয় না। আবার যেসব স্কুলে শেখানো হয়, সেখানেও বাংলাকে গুরুত্ব দেওয়া হয় না। এসব বিষয়ে খুব দুঃখ লাগে-কষ্ট পাই।

 

রাইজিংবিডির সঙ্গে কথা বলছেন ভাষা সৈনিক আনোয়ারুল হক

 

রাইজিংবিডি : ভাষা সৈনিকদের মুল্যায়ন সর্ম্পকে বলুন আর কেমন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেন?

রনেশ মৈত্র : স্বাধীন বাংলাদেশে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা করা হলেও আজ পর্যন্ত ভাষাসংগ্রামীদের তালিকা করেনি কোনো সরকার। এটা নিয়ে আমাদের আক্ষেপ আছে। আর আমার স্বপ্ন দেশের বাঙালি কোনো ছেলে-মেয়ে যাতে বেকার না থাকে, অশিক্ষিত না থাকে, সবাই যাতে সুখী সমৃদ্ধ হয়, শিল্প কল-কারখানা গড়ে ওঠে, সারবিশ্বে বাংলাদেশের নাম আরো বেশি উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, এটাই ছিল ভাষা আন্দোলনের লক্ষ্য। আমি এখনও সেই স্বপ্নই দেখি।

 

আনোয়ারুল হক : বাংলাদেশ হবে হানাহানি মুক্ত দেশ, দেশের সব সেক্টরে উন্নতি হবে, বেকারমুক্ত দেশ হবে, বাংলা ভাষাকে দেশের সব স্তরে সঠিকভাবে ব্যবহার নিশ্চিত করা হবে-এমন স্বপ্ন আমার। নতুন প্রজন্মকেও ভাষা আন্দোলন থেকে শিক্ষা নিয়ে উদ্বুদ্ধ হতে হবে।

 

অ্যাডভোকেট গোলাম হাসনায়েন : অর্থনৈতিক, সামাজিকভাবে উন্নত দেশ দেখে মরতে চাই। রাজনৈতিক হানাহানি দেখতে চাই না। যদিও একটি রাজনৈতিক দল দেশের উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত  করার চেষ্টা করছে। তারপরও সব বাধা পেরিয়ে দেশ তার লক্ষ্যে পৌঁছাবে এমন সুখী সমৃদ্ধ দেশ আমার প্রত্যাশা।

 

রাইজিংবিডি : মূল্যবান সময় দেওয়ায় রাইজিংবিডির পক্ষ থেকে আপনাদের অসংখ্য ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা।

রনেশ মৈত্র : আপনাকেও ধন্যবাদ, পাশাপাশি রাইজিংবিডিকেও ধন্যবাদ।

 

অ্যাডভোকেট গোলাম হাসনায়েন : ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস নিয়ে আমাদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করায় রাইজিংবিডিকে আমাদের অশেষ শুভেচ্ছা।

 

আনোয়ারুল হক : ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস ও আমাদের কথা নতুন প্রজন্মের কাছে নতুন করে তুলে ধরার আয়োজন করায় রাইজিংবিডি কর্তৃপক্ষকে আমাদের প্রাণঢালা অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা রইল।

     

রাইজিংবিডি/পাবনা/৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৬/শাহীন রহমান/রিশিত খান