জাতীয়

পার্লামেন্টারি শব্দকোষ : রাজনীতির ভিন্ন আয়োজন

মনি হায়দার : মানুষের বিকাশের ক্ষেত্র রাজনীতি। রাজনীতিই পরিচালনা করে রাষ্ট্র। রাষ্ট্র পরিচালনা করে সংসদীয় সরকারের, সংসদ বা পার্লামেন্ট। পার্লামেন্ট যারা চালায়, তারা সংসদ সদস্য। হাল আমলের সংক্ষিপ্ত রুপ ‘সাংসদ’। ইংরেজিতে যাকে বলে পার্লামেন্টারিয়ান। পৃথিবীর ইতিহাসে সহনশীল রাজনীতির ক্ষেত্র হিসেবে পার্লামেন্টের ভূমিকা অনন্য।

 

১৯৭১ সালে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের পর স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর পার্লামেন্টের গুরুত্ব বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। পার্লামেন্টে দেশের নানা গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা হয়। সরকার দেশ ও জাতির প্রয়োজনে যে সব সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, এ বিষয়ে সরকারি ও বিরোধী দলের মধ্যে তুমুল আলোচনা হয়। আলোচনার পর সংসদের স্পীকার সংসদ সদস্যদের ভোট নেন। এবং যে প্রস্তাব সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট পায়, সেই প্রস্তাব আইনে পরিণত হয়। সেই আইন অনুসারে দেশের মানুষ বা জনগণকে চলতে হয়। সুতরাং পার্লামেন্ট যে কেনো দেশের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ,  সরকারের জন্য তো বটেই।

 

কিন্তু পার্লামেন্ট কেমন করে চলে, কীভাবে কথা বলতে হয়- পার্লামেন্টের ভাষা ও পরিভাষা নিয়ে অসাধারণ একটি গ্রন্থ প্রণয়ন কররেছে জালাল ফিরোজ। বইটির নাম ‘পার্লামেন্টারি শব্দকোষ’। বইটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৯৮ সালে বাংলা একাডেমি থেকে। বইটির ব্যাপক চাহিদার কারণে সংস্করণসহ তিনবার পুনমুর্দ্রণ করতে হয়েছে। বইমেলাকে সামনে রেখে বইটি চতুর্থবারের মতো সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে বাংলা একাডেমি থেকে।

 

তৃতীয় সংস্করণের ভূমিকায়  জালাল ফিরোজ লিখেছেন, ‘পার্লামেন্টারি শব্দকোষ’ এর তৃতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হলো। দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশের পর বাংলাদেশের সাংবিধানিক পার্লামেন্টারি ও রাজনৈতিক জীবনে অনেক পরিবর্তন এসেছে। এসব পরিবর্তনের পটভূমিতে এই সংস্করণের সময় অনেক ভুক্তি সম্পাদিত হয়েছে। নবম ও দশম সংসদ এবং সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী পর্যন্ত পরিবর্তনগুলো ধারণ করে নতুন কিছু ভুক্তি এবার সংযোজিত হয়েছে। এখন গ্রন্থে ভক্তির সংখ্যা প্রায় সাতশ।’

 

মানব সভ্যতা মূলত দাঁড়িয়ে আছে রাজনীতির ওপর। রাজনীতি আশ্রয় করে ক্ষমতা। ক্ষমতার শীর্ষকেন্দ্র পার্লামেন্ট। জালাল ফিরোজ রাজনীতি ও ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে ভর করে রাজনীতির যে চর্চা বিচর্চা- তারই চমৎকার নজির উপস্থাপন করেছেন, ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় ‘পার্লামেন্টারি শব্দকোষ’ বইয়ে। উদাহরণ হিসেবে একটি শব্দকে ব্যবচ্ছেদ করা যায়। মিনিস্টার শব্দটির অর্থ বা প্রয়োগ প্রাচীনকালে কি ছিল? শব্দকোষে জালাল ফিরোজ মিনিস্টিার শব্দের উৎপত্তির ইতিহাস লিখেছেন-‘ উৎপত্তিগত দিক থেকে মিনিস্টার বলতে বুঝায় নি¤œস্তরের লোক, ভৃত্য। পুরনো ফরাসি শব্দ মনিস্টার বলতে বুঝায় সারভেন্ট। ১৬ শতকে এর অর্থে পরিবর্তন ঘটে। তখন যাজক বুঝাতে শব্দটি ব্যবহৃত হয়। মিনিস্টার শব্দ বর্তমান রাজনৈতিক অর্থ লাভ করে সতেরো শতকে।’

 

কি চাঞ্চল্যকর তথ্য! কিন্তু এটাই বাস্তব। সময় এবং অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে শব্দ, শব্দের অর্থ এভাবেই পাল্টে যায়। যেমন গেছে রাজনীতি ও ক্ষমতার প্রবল শব্দ ‘মিনিস্টার’ শব্দটি। এ ভাবে পার্লামেন্টারি শব্দকোষের সাতশ শব্দের মধ্যে কেবল বাংলাদেশ নয়, গোটা পৃথিবীর পার্লামেন্টের হদিশ পাওয়া সম্ভব। আমরা পার্লামেন্টের অনেক শব্দ শুনি বা পত্রিকায় পাঠ করি কিন্তু অর্থ অনুধাবন করতে পারি না। সেক্ষেত্রে এই বইটি সহায়ক হতে পারে।  না, কেবল রাজনীতিকদের জন্যই নয়, সাধারণ কিন্তু উৎসুক মানুষদের জন্যও বইটি প্রয়োজন।

 

গিলোটিন, শব্দটি কম বেশি সচেতন মানুষ জানেন। কিন্তু এই গিলোটিন শব্দটিরও একটি ইতিহাস আছে। জালাল ফিরোজ রাজনীতি বা পার্লামেন্ট বিষয়ক গবেষক হিসেবে বইটিতে সেই শব্দটিও উঠিয়ে এনেছেন। ১১৪ পৃষ্ঠায় গিলোটিন শব্দটি সর্ম্পকে লেখেন-‘ সাধারণ অর্থে গিলোটিন বলতে শিরোচ্ছেদ করার একটি বিশেষ ধরনের যন্ত্রকে বোঝায়। ১৭৮৯ সালের ফরাসি বিল্পবের পর ফ্রান্সে এই যন্ত্র ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়।...গিলোটিন শব্দটি জোসেফ ইগন্যাস গিলোটিন নামক একজন ফরাসি চিকিৎসকের নাম থেকে উদ্ভুত। গিলোটিনের জন্ম ফ্রান্সে ১৭৩৮ সালে। ১৭৮৯ সালের কনস্টিটুয়েন্ট এসেম্বলি’র তিনি সদস্য ছিলেন। ...মানুষের মৃত্যুকে যাতে কম বেদনাময় করা যায় সেজন্যই গিলোটিন যন্ত্র ব্যবহারের কথা বলেন। ফরাসি বিল্পবের পর মৃত্যদ-প্রাপ্ত ব্যক্তিদের দ-াদেশ এই যন্ত্রের মাধ্যমে কার্যকর করা হয়। তারপর থেকে জোসেফ ইগন্যাস গিলোটিনের নামানুসারে ‘গিলোটিন’ বলতে শিরোচ্ছেদ  করার বিশেষ যন্ত্র বোঝায়।’

 

এই প্রকারের ইতিহাস আশ্রিত, ব্যাপক অর্থপূর্ণ শব্দে পরিপূর্ণ জালাল ফিরোজের ‘পার্লামেন্টারি শব্দকোষ’ বইটি। শব্দকোষের আরও কয়েকটি শব্দ : মুলতবি বৈঠক, সংশোধনী, বিলের পরিশিষ্ট,  ব্যাকবেঞ্চার, দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা, বর্জন, কালো পার্লামেন্ট, বাজেট অধিবেশন, সিদ্ধান্ত প্রস্তাব, জরুরি জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মনোযোগ আকর্ষণ, চিফ হুইফ, বিশেষ অধিকার কমিটি, সংবিধান, ছাটাই প্রস্তাব,  ডার্ক হর্স প্রার্থী, মধুচন্দ্রিমা কাল, অভিশংসন, কিচেন ক্যবিনেট, সংসদ নেতা, দিনের কার্যতালিকা...অজস্র বিষয়।

 

সাতশ শব্দ থেকে মাত্র কয়েকটি শব্দ তুলে ধরলাম পাঠকদের বুঝবার জন্য। মেলায় প্রথম থেকে বইটির প্রতি পাঠকদের আগ্রহ দেখা যাচ্ছে। সাদা কাগজে চমৎকার ছাপা বইটির দাম মাত্র তিনশ টাকা। দৃষ্টি কাড়া প্রচ্ছদ এঁকেছেন সব্যসাচী হাজরা। রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৬/তারা