জাতীয়

বাঙালিত্ব নিজেরাই লুপ্ত করেছি : নিখিল সেন

জে. খান স্বপন, বরিশাল : ‘বাঙালি তার বাঙালিত্ব নিজেরাই লুপ্ত করেছে। আমি ইংরেজি ভাষাকে অবজ্ঞা করছি না। বিশ্বের সঙ্গে তাল মেলাতে ইংরেজি ভাষার প্রয়োজন আছে, কিন্তু বাংলাকে অবজ্ঞা করা ঠিক নয়। কেননা এই ভাষার জন্যই আমরা পেয়েছি একটি দেশ। বাংলাদেশ ছাড়া পৃথিবীর কোথাও এ নজির নেই।’

 

রাইজিংবিডি’র বরিশালের নিজস্ব প্রতিবেদকের সঙ্গে একান্ত কথোপকথনে এমনই মন্তব্য করেন বরিশালের ভাষাসংগ্রামী, মুক্তিযোদ্ধা আর সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নিখিল সেন।

 

ভাষাসংগ্রামী নিখিল সেন বরিশালের কাশিপুরের কলস গ্রামে ১৯৩১ সালের ১৬ এপ্রিল জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম যতিষ চন্দ্র। বর্তমানে বরিশাল নগরীর ঝাউতলা এলাকায় বসবাস করছেন। এক ছেলে ও দুই মেয়ের বাবা। বরিশালের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত আছেন।

 

তিনি তার কথোপকথনে ১৯৫২ সালের ভাষার আন্দোলনের নানান দিক তুলে ধরেছেন।

 

প্রায় ৮৫ বছর বয়সী নিখিল সেন বলেন, বরিশালে ভাষা আন্দোলনের জন্য মূলত তৎকালীন নিষিদ্ধঘোষিত কমিউনিস্ট পার্টি নেপথ্যে আন্দোলন করেছিল। তিনি ছিলেন এই পার্টির একজন সদস্য।

   

তিনি বলেন, ’৫২-এর ভাষা আন্দোলনের জন্য রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের নামে যে সংগঠনটি গঠন করা হয়েছিল তার কার্যকারিতা ছিল মূলত একটি কিংবা দুটি সভার মধ্যে সীমাবদ্ধ। এখানে এককভাবে ভাষা আন্দোলনের জন্য কেউ নেতৃত্ব দিয়েছেন তা বলা যাবে না। তবে আন্দোলনের জন্য অনেকের অবদান ছিল।

 

মূলত সর্বস্তরের জনগণ সেদিন রাস্তায় নেমে এসেছিল। কাউকে ডেকে আনা হয়নি। এরপরও অনেকেই নিজেদের ভাষাসংগ্রামী হিসেবে পরিচয় দেয়। আমি মূলত নিজেকে ভাষাসংগ্রামী হিসেবে পরিচয় দেই না। সেদিন সাধারণ জনগণের মতো আমিও ওই আন্দোলনের সঙ্গে ছিলাম। যার সফলতা এসেছে ১৯৭১-এর মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের মাধ্যমে।

 

মূল কথা হলো, ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন আজকের বাংলাদেশের মূল শেকড়।

 

’৫২-এর ভাষা আন্দোলনে বরিশালের প্রেক্ষাপট সম্পর্কে নিখিল সেন রাইজিংবিডিকে বলেন, ১৯৫২ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি বরিশালে অশ্বিনী কুমার হলে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের নামে ৩১ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। সে কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছিল আবুল হাসেম মিয়াকে। পরে ১৯ ফেব্রুয়ারি এই কমিটির আরো একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। তখন সভায় ১১৩ জন উপস্থিত থেকে একটি কাগজে স্বাক্ষর করেছিলেন।

 

’৫২-এর ২১শে ফেব্রুয়ারি ঢাকায় গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটে। এর একদিন পর ২২ ফেব্রুয়ারি বরিশালে এই খবর ছড়িয়ে পড়ে। তখন বিক্ষুব্ধ জনতা মিছিল নিয়ে সদর রোডে আসে। একটি বিশাল মিছিল হয়। মিছিলটিতে নিষিদ্ধঘোষিত কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছাড়াও তৎকালীন ইয়ুথ লীগ, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, নারী নেত্রী রানী ভট্টাচার্য, মঞ্জুয়ারা বেগম, শামসুন্নাহার নিরু বেগম, আবদুল মালেক খানসহ সবস্তরের জনগণ অংশগ্রহণ করেছিলেন। মিছিলটি অশ্বিনী কুমার হয়ে বর্তমান শহীদ মিনার (সার্কিট হাউজসংলগ্ন) এসে শেষ হয়।

   

পরের দিন ২৩ ফেব্রুয়ারি একটি সভা হয়েছিল। সভার পর ২৩ ও ২৪ ফেব্রুয়ারি গায়েবানা জানাজা হয় অশ্বিনী কুমার হলের সামনে। এরই মধ্যে ২৩ ফেব্রুয়ারি অশ্বিনী কুমার হলের সামনে কাপড় আর কলাগাছ দিয়ে শহীদ বেদী তৈরি করে পুষ্পার্ঘ অর্পণ করেছিলেন বরিশালবাসী। ২৪ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় পুলিশ ওই বেদীটি ভেঙে ফেলে।

 

এরপর ’৫৩ ও ’৫৪ সালে শহীদ বেদী তৈরি করতে দেয়নি পুলিশ। তবে ১৯৫৫ সাল থেকে সেখানেই অস্থায়ীভাবে শহীদ বেদী তৈরি করে পুষ্পার্ঘ অর্পণ করা হয়।

 

মূলত ১৯৫৫ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে জাতীয় দিবস হিসেবে পালিত হতো ২১শে ফেব্রুয়ারি ভাষা শহীদ দিবস হিসেবে। তবে ১৯৫৬ সালে আমরা বাংলা ভাষা হিসেবে মর্যাদা লাভ করার পর দিবস পালনে আর কোনো বাধা আসেনি।

 

২০০৫ সালে বরিশালের তৎকালীন সিটি মেয়র আলহাজ মজিবর রহমান সরোয়ার কর্তৃক ভাষা আন্দোলনে বিশেষ অবদানের জন্য গুণীজন সম্মাননা পদকপ্রাপ্ত নিখিল সেন আরো বলেন, ’৫২-এর ভাষা আন্দোলনের পথ ধরেই সূচিত হয় ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ।

 

তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ’৭১ ও ’৭২ সালে মুক্তিযোদ্ধার খেতাব পাওয়ার যে আইন ছিল তাতে অনেকেই মুক্তিযোদ্ধার সনদ পায় না। তবে ১৯৯৬ সালে সে আইনটি কার্যকর করতে সরকার চেষ্টা করেছিল।

 

প্রবীণ এই মুক্তিযোদ্ধা সবশেষ দেশের জনগণের উদ্দেশে বলেন, ভাষার সঠিক ব্যবহার সম্পর্কে সরকার একা পুলিশ দিয়ে দুষ্টুদের দমন করতে পারবে না। এজন্য সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। বাংলা ভাষার অভিধান সম্পর্কে সবাইকে ধারণা নিতে হবে।

   

রাইজিংবিডি/বরিশাল/৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৬/জে. খান স্বপন/মুশফিক