জাতীয়

‘আমার ভূমিকায় ভাষা আন্দোলনে ছাত্ররা সোচ্চার হন’

মো. মামুন চৌধুরী, হবিগঞ্জ : অ্যাডভোকেট আলহাজ চৌধুরী আব্দুল হাই। তিনি একজন ত্যাগী ভাষাসংগ্রামী। তার যুগান্তকারী ভূমিকায় ভাষা আন্দোলনে হবিগঞ্জের ছাত্ররা সোচ্চার হয়ে উঠেছিল।হবিগঞ্জের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ছাত্ররা বাংলা ভাষার স্বীকৃতির দাবিতে শুরু করেন আন্দোলন। এ সময় তিনি ছাত্রদের মধ্যে প্রিয়মুখ হয়ে ওঠেন। এ ভাষাসংগ্রামীর মতো হবিগঞ্জের অন্য ভাষাসংগ্রামীরা ছাত্রদের নিয়ে আন্দোলনে শরিক হন। সবার সার্বিক সহযোগিতায় হবিগঞ্জের ছাত্র-জনতা মিলে যখন আন্দোলনে ব্যস্ত, ঠিক সে মুহূর্তে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে ভাষাসংগ্রামী মো. আবিদ আলী হবিগঞ্জে আসেন। তিনি ভাষাসংগ্রামী চৌধুরী আব্দুল হাইকে সঙ্গে নিয়ে কোর্টস্টেশন রোড এলাকায় প্রথম সভা আহ্বান করেন। এ সভায় হবিগঞ্জের ভাষাসংগ্রামী ও ছাত্ররা অংশগ্রহণ করেন। এ সভার পর ছাত্ররা আরো গতিশীল হয়ে ওঠেন। এ সময় ভাষাসংগ্রামী চৌধুরী আব্দুল হাই হবিগঞ্জ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির ক্যাপ্টেন। মূলত এজন্যই ভাষা আন্দোলন সংক্রান্ত ছাত্রদের জাগ্রত করে তোলার দায়িত্বটাও কাঁধে পড়ে। দেশ-মাটি-মানুষের ভালবাসায় আসক্ত হয়ে তিনি খাওয়া-ঘুম হারাম করে রাজপথে নেমে পড়েন। ছাত্ররাও তাকে অনুসরণ করে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তিনি ভাবলেন শুধু হবিগঞ্জে বসে থাকলে হবে না। যেতে হবে ঢাকায়। প্রয়োজনে প্রাণ যাবে। তাই ভয়কে দূর করে চলে গেলেন ঢাকায়। সেখানে গিয়ে দেখা করেন ভাষাসংগ্রামী সালাম, রফিক, বরকত, জব্বারদের সঙ্গে। সেখানে তাদের সঙ্গে তিনিও আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। এ সংবাদ শুনে হবিগঞ্জের ছাত্ররা উৎসাহ পেয়ে আন্দোলনে আরও সক্রিয় হয়ে ওঠেন।  

 

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ নিয়ে একান্ত আলাপকালে অ্যাডভোকেট চৌধুরী আব্দুল হাই বলেন, আমাদের মায়ের ভাষা বাংলা। পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে ভাষাসংগ্রামীরা বুকের তাজা রক্ত ঢেলে প্রতিষ্ঠা করেছে বাংলা ভাষা। এ ভাষাকে গভীরভাবে লালন করতে হবে। তাহলেই ভাষা শহীদদের আত্মা শান্তি পাবে। এসব ত্যাগের ফলে মায়ের ভাষা বাংলায় কথা বলতে পারছি। এটাই বড় পাওয়া। আলাপকালে তিনি হবিগঞ্জের অন্য ভাষাসংগ্রামীদের কথাও গুরুত্বসহকারে উল্লেখ করেন। পরিশেষে তিনি বলেন, সঠিকভাবে সবাই যেন এ ভাষার মূল্যায়ন করেন। ঃ

 

বিশিষ্ট এই ভাষাসংগ্রামী হবিগঞ্জ-লাখাই আসনের সাবেক সাংসদ ছিলেন। এই আলোকিত মানুষটি নিজ কর্মগুণে সবার মনে বিরাজিত রয়েছেন।

   

তিনি মুক্তিযুদ্ধেরও সংগঠক। হবিগঞ্জ জেলা বারের সভাপতি ও সেক্রেটারি ছিলেন। রাজনীতি থেকে অবসরে গিয়েও নানা সামাজিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত আছেন হবিগঞ্জের প্রিয়মুখ চৌধুরী আব্দুল হাই।

 

তার জন্ম হবিগঞ্জ সদর উপজেলার বড় বহুলা গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে ১৯৩৯ সালের ৯ মার্চ। বাবা মৃত চৌধুরী আব্দুল গণি ও মা মরহুমা আছিয়া খাতুন চৌধুরী। তিনি বহুলা প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে বৃত্তিসহ তৃতীয় শ্রেণি পাস করে হবিগঞ্জ মাধ্যমিক হাইস্কুলে ভর্তি হন। সেখান থেকে বৃত্তিসহ ষষ্ঠ শ্রেণি পাস করে হবিগঞ্জ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে ১৯৫৪ সালে সাধারণ ও অতিরিক্ত গণিতে লেটার মার্কসহ প্রথম বিভাগে মেট্রিক পাস করেন। ১৯৫৬ সালে বৃন্দাবন কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে আইএ ও ১৯৫৮ সালে দ্বিতীয় বিভাগে বিএ পাস করেন। ১৯৬২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৬৩ সালে বার কাউন্সিলে ও হবিগঞ্জ অ্যাডভোকেট সমিতিতে এনরোলড হন।

 

১৯৬৫ সালে তিনি রাজনীতিতে যোগদান করে ভাসানী ন্যাপের হবিগঞ্জ মহকুমার সেক্রেটারির দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৭ সালে তিনি মোজাফ্ফর ন্যাপে যোগদান করে হবিগঞ্জে সভাপতির দায়িত্ব চালিয়ে যান। ১৯৮৬-৮৭ সালে আট দলীয় জোটের প্রার্থী হিসেবে বিপুল ভোটে হবিগঞ্জ-লাখাই আসনের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।

 

১৯৯৬ সালে প্রত্যক্ষ রাজনীতি থেকে তিনি অবসর গ্রহণ করে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয়, বিভিন্ন অধিকার আদায় আন্দোলনে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ এবং হবিগঞ্জবাসীর সুখ-দুঃখের সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত রাখেন।

 

তিনি ভ্রমণ করেছেন ভারত, থাইল্যান্ড, সোভিয়েত ইউনিয়ন (বর্তমানে রাশিয়া) ও আমেরিকায়। জেলা বারের সভাপতি ও সেক্রেটারি ছিলেন।

   

রাইজিংবিডি/হবিগঞ্জ/১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৬/মামুন/মুশফিক