জাতীয়

মৃত্যুর আগে তারা ভাষাসংগ্রামীর রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি চান

মহাসিন আলী, মেহেরপুর : ২০১০ সাল থেকে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রতি বছর ভাষাসংগ্রামীর সম্মাননা পেয়ে আসছেন নজির হোসেন বিশ্বাস ও ইসমাইল হোসেন। মৃত্যুর আগে তারা ভাষাসংগ্রামীর রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেতে চান।

 

মেহেরপুর জেলা শহর থেকে ১২ কিলোমিটার দক্ষিণে সদর উপজেলার পিরোজপুর গ্রামের ধনাঢ্য ও সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের সন্তান নজির হোসেন বিশ্বাস। ফয়েজ উদ্দিন বিশ্বাস ও সরসী নেছা বিবির নয় সন্তানের মধ্যে প্রথম নজির হোসেন বিশ্বাস। গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করে ১৯৫১ সালে মেহেরপুর মডেল হাই স্কুলে ভর্তি হন তিনি।

 

এদিকে মেহেরপুর শহরের হোটেল বাজার শহীদ গফুর সড়কের বাসিন্দা এস্কেন্দার জুলকার নাইন ও খালেছা খাতুনের ১১ সন্তানের মধ্যে বড় মহা. ইসমাইল হোসেন। তিনি ১৯৫১ সালে মেহেরপুর মডেল হাই স্কুলের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র ছিলেন।

 

১৯৫১ থেকে ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত তারা ভাষার জন্য লড়াই করে পুলিশি নির্যাতন সহ্য করেছেন। অবশেষে তারাসহ ওই স্কুলের সাতজন ছাত্র পান রাজটিকিট। যে কারণে ধনাঢ্য ও সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম নিয়েও নজির হোসেন বিশ্বাসের শিক্ষাজীবন নষ্ট হয়ে যায়। ইসমাইল হোসেন দারিয়াপুর হাই স্কুলে ভর্তি হয়েও নির্যাতনের শিকার হন। তার পরও তিনি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে লেখাপড়া চালিয়ে যান এবং ¯œাতক পাস করেন।

 

২০১০ সাল থেকে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে এ দু’জন প্রতি বছর ভাষাসৈনিকের সম্মাননা পেয়ে আসছেন। দুই ছেলে ও তিন মেয়ের জনক নজির হোসেন বিশ্বাস এবং এক ছেলে ও এক মেয়ের জনক ইসমাইল হোসেন মৃত্যুর আগে তারা ভাষাসৈনিকের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেতে চান।

 

সরেজমিনে পিরোজপুর গ্রামে গিয়ে নজির হোসেনের বড় ছেলে মাসুদ বিশ্বাসের সহযোগিতায় তার সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। এছাড়া শহরের টিঅ্যান্ডটি সড়কের বাসভবন থেকে ইসমাইল হোসেনের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করা হয়। আমাদের প্রিয় পাঠকদের জন্য তার কিছু অংশ তুলে ধরা হলো।

 

সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন ভাষাসংগ্রামী মহা. ইসমাইল হোসেন

 

ভাষাসংগ্রামী ইসমাইল হোসেন

রাইজিংবিডি : আপনি কেমন আছেন? ভাষা আন্দোলনের সময় আপনি কোন শ্রেণির ছাত্র ছিলেন? তখন আপনার বয়স কত ছিল? আর এখন আপনার বয়স কত হবে?

ইসমাইল হোসেন : আমি এক প্রকার ভালো আছি। ১৯৫১ সালে আমি মেহেরপুর মডেল হাই স্কুলের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র ছিলাম। আমার বয়স তখন প্রায় ১৬ বছর হবে। আর বর্তমানে আমার বয়স ৮০ বছর হবে।

 

রাইজিংবিডি : আপনারা দু’জনেই ভাষা আন্দোলনের সময় পঠিত শ্রেণি অনুযায়ী বয়স অনেক বেশি বললেন। এটা কি সরকারি বিধিবহির্ভূত ছিল না?

ইসমাইল হোসেন : আসলে সে সময় দেশের কয়টি পরিবারের ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া করত আর দেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই বা কয়টা ছিল? তখনকার দিনে বয়সের বার ছিল না। এখন যেমন ঘরে ঘরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হতে সরকার নির্ধারিত বয়স লাগে। তারপরও তিন বছর থেকে চার বছর বয়সের শিশুদের কিন্ডারগার্টেন স্কুলে ভর্তি করে মায়েরা স্কুল আঙিনায় বসে থাকেন। এটা আমাদের জন্য আশার কথা হলেও তখনকার দিনে এ ধরনের সুযোগ ছিল না। তাই ছেলেরা অনেক বয়স হলেই স্কুলমুখী হতো।

 

রাইজিংবিডি : ভাষা আন্দোলনের কোন কোন স্মৃতি আপনার মনে পড়ে?

ইসমাইল হোসেন : বড় ভাই নজির হোসেন বিশ্বাস যে কথাগুলো বলেছেন তার সবকিছুই আমার মনে পড়ে। আরো মনে পড়ে- যখন আমরা সাতজন ছাত্র আটক হই। প্রশাসনের পক্ষ থেকে আমাদের গুরু সাজা দেওয়ার চিন্তা-ভাবনা চলছে। তখন বৃহত্তর কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসক (একজন অবাঙালি) মেহেরপুর মহাকুমাতে আসেন। তার আসার সংবাদে আমাদের অভিভাবকরা রাস্তা ব্যারিকেড করতে রাস্তার উপর শুইয়ে পড়েন। তিনি গাড়ি থেকে নেমে অভিভাবকদের কথা শোনেন এবং আমাদের যাতে বড় ধরনের (গুরু) শাস্তি দেওয়া না হয় সে ব্যবস্থা করেন। এরপর আমরা জামিনে মুক্তি পাই।

 

রাইজিংবিডি : ভাষার জন্য লড়তে আপনারা যে সাতজন বিভিন্ন সময়ে নির্যাতনের শিকার হন তাদের নাম কী? তারা এখন কে কোথায় আছেন? তাদেরকে মেহেরপুরের মানুষ ভাষাসংগ্রামী হিসেবে স্মরণ করেন কিনা?

ইসমাইল হোসেন : ভাষার জন্য অনেকে তখনকার দিনে আমাদের সঙ্গে কম-বেশি মিছিল-মিটিংয়ে অংশগ্রহণ করেছিল। তবে পুলিশি নির্যাতনের ভয়ে অনেকে পিছিয়ে গিয়েছিল। চিহ্নিত আমরা সাতজন নির্যাতনের শিকার হই ও একাধিকবার কারাভোগ করি। সাতজনের মধ্যে ছিলাম মেহেরপুর শহরের আমি, পিরোজপুর গ্রামের নজির হোসেন বিশ্বাস এবং মেহেরপুর শহরের বিভিন্ন এলাকার সামছুল আলা, কদম রসুল, আবুল কাশেম আঙ্গুর, গোলাম কবীর খান ও মোশারফ হোসেন। আমি আর বড় ভাই নজির হোসেন বিশ্বাস বেঁচে আছি। বাকিরা সবাই মারা গেছেন। তাদের সরকার ভাষাসংগ্রামীর মর্যাদা দেইনি। তবে স্থানীয় সাংবাদিকরা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জনের সঙ্গে কথা বলে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে আমাদের সাতজনকে ভাষাসংগ্রামী হিসেবে চিহ্নিত করেছেন এবং জাতীয় ও স্থানীয় দৈনিক এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় প্রচার করেছেন।

 

রাইজিংবিডি : সরকারিভাবে আপনারা ভাষাসংগ্রামীর মর্যাদা কিংবা সম্মাননা পেয়েছেন কি?

ইসমাইল হোসেন : না, সরকারিভাবে ভাষাসংগ্রামীর মর্যাদা আমরা পায়নি। তবে স্থানীয় সাংবাদিকদের লেখালেখির কারণে খুলনা বিভাগীয় কমিশনারের দৃষ্টিগোচর হওয়ায় ২০১০ সালে তার নির্দেশে মেহেরপুর জেলা প্রশাসন আমাদের দু’জনকে ভাষাসংগ্রামী হিসেবে সম্মাননা দেওয়া হয়। এর পর থেকে জেলা প্রশাসন, মেহেরপুর মৃত্তিকা গ্রুপ থিয়েটার, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা মক্কর স্মৃতি পাঠাগারসহ বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে আমাদের সম্মাননা দেওয়া হয়েছে।

 

রাইজিংবিডি : আপনার সময় কীভাবে কেটেছে বা কাটছে?

ইসমাইল হোসেন : আমি বরাবরই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলাম। তাই রাজনীতি আর সমাজসেবার মধ্যে দিয়ে দীর্ঘ সময় পার করেছি। আমি মাত্র দেড় বছর একটি প্রাইভেট ব্যাংকে চাকরি করেছি। ভালো লাগেনি তাই চাকরি ছেড়ে দিয়েছি। আমি বিভিন্ন সময়ে মোট ২৯ বছর মেহেরপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও ১৩ বছর জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ছিলাম। বর্তমানে জেলা আওয়ামী লীগের সম্মানিত উপদেষ্টা হিসেবে আছি। বর্তমানে আমি অসুস্থ। ওষুধ খেয়ে কোন রকম টিকে আছি। এর পরও যখন ওষুধ কেনার টাকা পাই না তখন ওষুধ খেতে পারি না।

 

রাইজিং বিডি : শেষ জীবনে আপনাদের দাবি কী?

নজির হোসেন বিশ্বাস ও ইসমাইল হোসেন : জীবন সায়াহ্নে সরকারের কাছে একটি মাত্র চাওয়া- ‘সারাদেশের শতাধিক জীবিত ভাষাসংগ্রামীকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেওয়া হোক’।

       

রাইজিংবিডি/মেহেরপুর/২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৬/মহাসিন/মুশফিক