জাতীয়

পরিবর্তিত ঈদ সংস্কৃতি || স্বকৃত নোমান

পৃথিবীটা আসলে এক কর্মক্ষেত্র। কর্মযজ্ঞে আমাদের ব্যস্ত থাকতে হয়। এই ব্যস্ততার কারণে পারস্পরিক যোগাযোগ, সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি বিনিময় করাটা সব সময় ঠিক হয়ে ওঠে না। মানুষ যতই সামাজিক জীব হোক না কেন, বাস্তবে এই সামাজিকতা সে পুরোপুরি প্রকাশ করতে পারে না, বেশির ভাগই ভেতরে লালন করতে হয়। ধর্মীয় উৎসবগুলো সেই অপ্রকাশিত সামাজিকতার বহিঃপ্রকাশ ঘটায়, বিচ্ছিন্ন মানুষের সম্মিলন ঘটায়, অন্তর্জগতের গোপনে লুকানো ভাব-ভালোবাসা আর সহমর্মিতা জাগিয়ে তোলে।

 

মানুষ যে নিঃসঙ্গ নয়, একে অন্যের সঙ্গে যে আমরা গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত, তা স্মরণ করিয়ে দেয় এসব উৎসব। উৎসবগুলো যতটা না ধর্মীয় তার চেয়ে বেশি সামাজিক। ঈদুল ফিতরের কথাই ধরা যাক। আরবীয় সমাজের ঈদ-সংস্কৃতির সঙ্গে কিন্তু বাঙালি সমাজের ঈদ-সংস্কৃতির পুরোপুরি মিল নেই। কিংবা আলাস্কায় বসবাসরত মুসলমানদের যে ঈদ-সংস্কৃতি, তার সঙ্গে জাপানে বসবাসরত মুসলমানদের ঈদ-সংস্কৃতির কিছুটা হলেও তফাত আছে। সামাজিকতার কারণে এই তফাতের সৃষ্টি হয়েছে। যেমন, ঈদের দিন মিষ্টান্ন খাওয়া সুন্নত, বাংলাদেশের মুসলমানরা তাই মিষ্টান্ন হিসেবে সেমাই খায়। এটাই এ দেশীয় মুসলমানদের সংস্কৃতি। কিন্তু সুদূর আফ্রিকার মুসলমানরাও কি ঈদের দিনে সেমাই খায়? খায় না। মিষ্টান্ন হিসেবে তারা অন্য কিছু খায়। সামাজিকতাই এই সাংস্কৃতিক পরিবর্তন ঘটিয়ে দিয়েছে।

শুধু ভৌগোলিক কারণেই নয়, সময়ের সঙ্গেও এই সংস্কৃতির পরিবর্তন হয়েছে, হচ্ছে। চৌদ্দ শ বছর আগের যে ঈদ-সংস্কৃতি, তার সঙ্গে কিন্তু বর্তমানের ঈদ-সংস্কৃতির অনেক তফাত। বাংলাদেশের বাঙালি মুসলমান সমাজেও গত তিন দশকে ঈদ-সংস্কৃতির ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে। তখনকার ঈদ-সংস্কৃতি বর্তমানের সঙ্গে মৌলিকভাবে ঠিক থাকলেও আনুষঙ্গিক বহু কিছুর পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। উদাহরণ হিসেবে গত শতকের আশির দশকের গ্রামীণ ঈদ-সংস্কৃতির একটা চিত্র তুলে ধরা যেতে পারে। রমজানের বিশ তারিখ রাতে যখন গ্রামের দু-একজন বয়োজ্যেষ্ঠ মুরব্বি ‘ইতেকাফ’ আদায়ের লক্ষ্যে দশ দিনের জন্য মসজিদে অন্তরীণ হতেন, সেদিন থেকেই ঈদের দূরায়ত হাতছানি দেখতে পেতাম আমরা। ঈদের আরো নয়-দশ দিন বাকি থাকলেও একটা চাপা উত্তেজনা দেখা যেত সবার মধ্যে। আসন্ন ঈদের বিশেষ দিনটিকে উদযাপনের জন্য সবার ভেতর দেখা যেত একধরনের ব্যস্ততা।

 

তারপর শবে কদরের রাত থেকে সেই ব্যস্ততা তুঙ্গে ওঠে, ঈদকে বরণ করে নেওয়ার জন্য সবাই চূড়ান্ত প্রস্তুতি নেয়। হাতে আর মাত্র কয়েকটা দিন, তারপরই ঈদের দিন। শুরু হয় হাটবাজারে কেনাবেচার ধুম। গ্রামের দোকানগুলো ভরে ওঠে সেমাই-চিনি-নারিকেল-বাদাম-কিশমিশ ইত্যাদি দ্রব্যে। মা-বাবারা তাদের মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে উপহার হিসেবে পাঠিয়ে দেয় এসব জিনিস, জামাতাকে উপহার দেয় পায়জামা-পাঞ্জাবি-টুপি ইত্যাদি, ছেলেমেয়েদের কিনে দেয় নতুন জামা-কাপড়। ঈদের আগের রাত পর্যন্ত চলে ধুম বেচাকেনা। শবে কদরের পরদিন থেকে গ্রামের ফকির-মিসকিনরা গেরস্তের বাড়ি বাড়ি ধরনা দেয় ফিতরার টাকার আশায়। ছেলেমেয়েরা পাঁচ-দশ টাকা দামের ঈদকার্ড পাঠিয়ে শুভেচ্ছা ও আমন্ত্রণ জানায় তাদের বন্ধুবান্ধবদের। ঈদের আগের দিন বিকেলে মেহেদিপাতা সংগ্রহের ধুম পড়ে যায় তাদের মধ্যে। ইফতারের সময় বাবা-মায়ের সঙ্গে বসে ইফতারি খাওয়া ফেলে খোলা মাঠে গিয়ে হাজির হয় ঈদের বাঁকা চাঁদ দেখার জন্য। পশ্চিমাকাশে সন্ধ্যাতারার আশপাশে নখাকৃতির বাঁকা চাঁদ দেখা গেলে হৈ-হৈ রৈ-রৈ পড়ে যায় দিকে দিকে। সঙ্গে সঙ্গে পড়ে যায় মেহেদি বাটার ধুম। গভীর রাত অবধি হাতে আর নখে নানা আলপনায় মেহেদি লাগায় তারা। সারা রাত কাটে উত্তুঙ্গ উত্তেজনায়। পরদিন যথারীতি সুবহে সাদিকের সময়ই ঘুম ভেঙে যায়। মুয়াজ্জিনের আজানকে প্রতিদিনকার আজানের মতো মনে হয় না তখন। আজকের এই বিশেষ দিনের প্রারম্ভের আজানটা দেওয়ার জন্য তিনি যেন সারা বছর কণ্ঠটাকে প্রস্তুত করে রেখেছিলেন। কী যে সুরের মূর্ছনা!

 

তারপর ভোর। গ্রীষ্মকাল হলে তো কথা নেই, পৌষ-মাঘ মাসের কড়া শীত হলেও গ্রামের পুকুরঘাটে তিল ধারণের ঠাঁই থাকে না। কসকো কোম্পানির সুগন্ধি সাবান, নতুন লুঙ্গি আর গামছা নিয়ে সবাই ঘাটে এসে হাজির। পুকুরের পানি ঘোলা হয়ে ওঠে অসংখ্য মানুষের স্নানকর্মে। কারো মুখে বিষাদের এতটুকু ছাপ নেই, সবাই কেমন প্রাণখোলা হাসিখুশি। বিষণ্ন বুড়োদেরও ঠোঁটের কোণে ঝুলে থাকে হাসির রেখা। গা-গোসল ধুয়ে বাড়ি ফিরে নতুন কিংবা ধুয়ে ইস্ত্রি করে রাখা পুরোনো জামা-কাপড় গায়ে দেওয়ার পালা। ঈদ উপলক্ষে গ্রামের দোকান থেকে কেনা দুই কি পাঁচ টাকা দামের খুশবুদার আতর পায়জামা-পাঞ্জাবিতে ছিটায় সবাই। তারপর নকশাদার জায়নামাজ কি নলখাগড়ার তৈরি পাটিটা বগলদাবা করে ঈদগাহের দিকে রওনা হয়।

 

ঈদের আনন্দটা বড়দের চেয়ে ছোটদেরই যেন বেশি। ঈদগাহে গিয়ে নামাজ পড়ার চাইতে তারা বেশি ব্যস্ত থাকে বাঁশি, বেলুন ইত্যাদি খেলনা নিয়ে। দোকানিরা ঈদের দিন দোকানের বাইরে চাটাই বিছিয়ে নানা খেলনা সামগ্রী নিয়ে বসে। সেইসব খেলনার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বিশেষভাবে তৈরি বাঁশের বাঁশি। এই বাঁশির পেছনের দিকটা বেলুনের ভেতর ঢুকিয়ে সুতা দিয়ে ভালো করে বেঁধে নিতে হয়। তারপর ফুঁ দিয়ে বেলুনটাকে ফুলিয়ে লাউ কি কুমড়ার মতো করে বহিরাংশের ছিদ্রটি ছেড়ে দিলে সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় ইস্টিমারের সাইরেনের মতো ভোঁ-ওঁয়া ভোঁ-ওঁয়া শব্দ। শিশু-কিশোরদের কাছে ঈদের দিনে এই বিশেষ খেলনাটি অত্যন্ত জনপ্রিয়। খেলনার মধ্যে আরো আছে রেফারি-বাঁশি, প্লাস্টিকের তৈরি প্রাইভেট কার। কারটির সামনের সরু ছিদ্রটাতে মোটা একটা সুতা বেঁধে টেনে টেনে চালাতে হয়। অনেকটা দুধের স্বাধ ঘোলে মেটানোর মতো। আর লাটিম তো ব্যাপক জনপ্রিয় খেলনা। পুরোনোটা ফেলে দিয়ে ঈদের দিন কেনা হয় নতুন লাটিম।

 

তারপর ঈদগাহে নামাজ শেষে শুরু হয় পারস্পরিক কোলাকুলি। তারপর মুসল্লিরা দল বেঁধে চলে যায় গ্রামের বড় গোরস্তানে। মরহুম আত্মীয়-স্বজনদের রুহের মাগফিরাত কামনায় কবরলাগোয়া রাস্তায় সার বেঁধে পশ্চিমমুখী দাঁড়িয়ে মোনাজাত করে। দোয়া-খায়ের শেষে আবার শুরু হয় কোলাকুলি। এরপর দলে দলে ভাগ হয়ে আত্মীয়-স্বজনদের বাড়ি বাড়ি সেমাই খেতে যায়। সেমাই বলতে তখন গ্রামের মানুষদের ভাষায় ‘বাংলা সেমাই’ বা ‘আলবা সেমাই’ ছিল প্রধান। চিনি-নারিকেল-বাদাম-কিশমিশ ও দুধ সহযোগে রান্না হয় এ সেমাই। চিনামাটির ছোট ছোট পিরিচে করে পরিবেশন করা হয় আগত মেহমানদের। ছোটরা বড়দের পা ছুঁয়ে সালাম করে শ্রদ্ধা জানায়। খুশি হয়ে বড়রা দু-চার টাকা বকশিশ না দিয়ে পারে না।

 

ঈদের দিন বিকেলবেলা কারো হাতে কোনো কাজ থাকে না। পার্থিব যাবতীয় কর্মযজ্ঞ থেকে আজ একেবারেই মুক্ত। অখ- অবসরতা কেবল। গ্রামের চা দোকানে ব্যাটারি-চালিত টেলিভিশনে ঈদের সিনেমা দেখার ভিড় লেগে যায়। যাদের বাড়িতে সনি কোম্পানির ক্যাসেট প্লেয়ার আছে, তারা চড়া আওয়াজে গান বাজায়। কিশোররা গ্রামের নির্জন রাস্তাঘাটে পয়সা আর মার্বেল খেলায় মেতে ওঠে। মেয়েরা নতুন নতুন জামা-কাপড় পরে ঘুরে বেড়ায় সারা গ্রাম। রাতের প্রথম প্রহর পর্যন্ত লেগে থাকে এসব আনন্দ।

 

ঈদের পরের দিন শুরু হয় অন্য আয়োজন। তরুণ-যুবকরা দল বেঁধে চলে যায় জেলা শহরে। ঈদ উপলক্ষে রাজ্জাক-ববিতা বা ইলিয়াস কাঞ্চন-চম্পার নতুন মারদাঙ্গা কি বিরহকাতর ছবি মুক্তি পেয়েছে। রেডিও বাংলাদেশে নাজমুল হোসাইন বা গাজী মাজহারুল ইসলামের ভরাট কণ্ঠে সেই ছবির বিজ্ঞাপন শুনতে শুনতে ছবিটি দেখবার জন্য তীব্র আগ্রহ তৈরি হয়েছে তাদের ভেতর। তাই দল বেঁধে জেলা শহরের সিনেমা হলে সেটি দেখতে যাওয়া। সিনেমা দেখা শেষে চলে যায় দূরদূরান্তের আত্মীয়-স্বজনদের বাড়িতে। মামা-মামি, খালা-খালু, ফুফা-ফুফিদের সঙ্গে দেখা না করলে তো ঈদ আনন্দ অপূর্ণাঙ্গই থেকে যায়।

 

এই হচ্ছে গত বিশ বছর আগের বাঙালির ঈদ সংস্কৃতি। এবার আসা যাক সমসাময়িককালের ঈদ সংস্কৃতি প্রসঙ্গে। কিছু কিছু ব্যাপার আগের মতো থাকলেও অনেক কিছুরই পরিবর্তন ঘটেছে। যেমন ঈদের দিন শিশু-কিশোরদের যেসব খেলনার কথা বলা হলো, সাম্প্রতিককালে উক্ত খেলনার গুণগত মান বহু উন্নত হয়েছে। ছোট ছোট বেলুনের বদলে এখন এসেছে বড় বড় মজবুত যতসব বাহারি বেলুন। এসেছে ব্যাটারিচালিত নানা খেলনা গাড়ি, প্লাস্টিকের পুতুল, পশু-পাখিসহ কত কি। এখন মেহেদিগাছ থেকে মেহেদি পাতা সংগ্রহ করে কষ্ট করে বেটে হাতে লাগাতে হয় না, বিভিন্ন কোম্পানি ‘সাজ’, ‘শাহজাদী’ ইত্যাদি নামে দিয়ে এনেছে নানা প্যাকেটজাত মেহেদি। নাগরিক জীবন তো বটেই, গ্রামীণ জীবনেও লেগেছে এই পরিবর্তনের ছোঁয়া। এখনো ঈদকার্ডের প্রচলন আছে বটে, কিন্তু তাতে লেগেছে প্রযুক্তির হাওয়া। আজকাল নানা ডিজাইনের ঈদকার্ড বাজারে পাওয়া যায়। আবার ঈদকার্ডের মধ্যে বাতিও জ্বলতে দেখা যায়, সুইস অন করলে বেজে ওঠে নানা মিউজিক। এখন ঈদের শুভেচ্ছা পাঠানো হয় মোবাইলে এসএমএস করে, ই-মেইল কিংবা ফেসবুক চ্যাট-এর মাধ্যমে। ২০ রমজানের পর থেকে হাটেবাজারে এমনকি নগরে টাঙানো হয় ঈদ-শুভেচ্ছা লেখা বড় বড় ব্যানার। বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা শহরে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা বড় বড় তোরণ বানায় জনগণকে ঈদের শুভেচ্ছা জানাতে।

 

ঈদ সংস্কৃতির পরিবর্তন হয়েছে খাবার-দাবারের ক্ষেত্রেও। গত শতকের শেষের দিকে লাচ্ছা সেমাই প্রত্যন্ত গ্রাম অবধি পৌঁছে যায়। আগে এই সেমাই খোলা বিক্রি হতো। এখনো হয়। তবে এখন খোলা লাচ্ছা সেমাইর চেয়ে বাহারি প্যাকেটজাত আধুনিক লাচ্ছা সেমাইর কদর বেশি। লাচ্ছা সেমাইয়ের সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছে নুডলস্। মাংস বা ডিম দিয়ে রান্না করা এই খাবারটি সেমাইর সঙ্গে পরিবেশিত হয়। একটু অবস্থাসম্পন্ন গেরস্তরা আরো একধাপ এগিয়ে। তারা সেমাই বা নুডলসের পরিবর্তে মাংসে পাকানো খিঁচুড়ি পরিবেশন করে থাকে। মোল্লা-মৌলবিরাও ঈদের দিন মিষ্টান্ন খাওয়া সুন্নতের কথা ভুলে গিয়ে অনায়াসে খায় এসব মশলাদার খাবার-দাবার। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দেখা যাচ্ছে সুন্নতেরও পরিবর্তন হয়! সকাল বেলায় সেমাই খাওয়া হলেও দুপুরে সামর্থ্য অনুযায়ী মুরগি, গরুর মাংস বা খাসির মাংসের ভোজ চলে। অবস্থাসম্পন্নদের ঘরে তৈরি হয় হালিম, কাবাব, বিরিয়ানি ইত্যাদি।

 

ঈদ-সংস্কৃতির পরিবর্তন হয়েছে পোশাক-আশাকের ক্ষেত্রেও। ঈদকে সামনে রেখে নতুন নতুন কাপড়-চোপড় বাজারে আনার প্রতিযোগিতায় নামেন ব্যবসায়ীরা। এখন ঈদ উপলক্ষে জিনসপত্রের দাম দ্বিগুণ বেড়ে যায়। যে যেভাবে পারে অন্যকে ঠকিয়ে দুই পয়সা আদায় করে নেওয়ার ধান্দায় থাকে সবাই ঈদ এলে। তিন শ টাকার শাড়ি ছয় শ টাকায়, এক হাজার টাকার জামা দুই হাজারে গিয়ে ঠেকে। বিপণিবিতানে গিয়ে কাপড়-চোপড়ের দাম দেখে মানসিকভাবে ভেঙে পড়া ছাড়া উপায় থাকে না। ঈদ এলে বিক্রেতরা এতই ব্যস্ত থাকে যে, ক্রেতার সঙ্গে মুখে বাতচিত করার সময় পায় না। তাই কাপড়ের গায়ে দাম লিখে রাখে। দরাদরি করার কোনো সুযোগ নেই। এক দাম। যার ইচ্ছে হয় সে কিনে নেবে। ঈদকে কেন্দ্র করে পরিবহন ভাড়া বেড়ে যায় দ্বিগুণ। পাড়ায়-মহল্লায় চাঁদাবাজিও কম চলে না। ঢাকা শহরে দ্বিগুণ বেড়ে যায় ছিনতাই। যদিও ঈদের তাৎপর্য এসব নয়। নিঃসন্দেহে এসব মানুষের ভেতর থেকে পারস্পরিক সহমর্মিতা বিনষ্টের ফল।

 

আজকের ঈদ-সংস্কৃতি অনেকটা প্রতিযোগিতামুখর। সমাজের সর্বস্তরে চলে এই প্রতিযোগিতা। এই প্রতিযোগিতা ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির, পরিবারের সঙ্গে পরিবারের এমনকি সমাজের গণ্ডি পেরিয়ে রাষ্ট্র পর্যন্ত বিস্তৃত। ছাত্র, শিক্ষক, আমলা, ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ, কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবীরাও এই প্রতিযোগিতার বাইরে নয়। প্রতিযোগিতার এই দৌড়ে টিকতে গিয়ে এখন কেউ আর সত্য-মিথ্যা, ন্যায়-অন্যায় ও ভালো-মন্দের বাছ-বিচার করে না মোটেই। 

 

মিডিয়া জগতেও লক্ষ করা যায় এই প্রতিযোগিতা। ঈদ সংস্কৃতির পরিবর্তন হয়েছে ইলেকট্রনিকস মিডিয়াতে। ঈদকে কেন্দ্র করে টিভি চ্যানেলগুলোতে প্রচারিত হয় বিশেষ নাটক, টেলিফিল্ম, সিনেমাসহ বিশেষ অনুষ্ঠানমালা। তাও এক-দুদিন নয়, টানা ছয়-সাত দিন ধরে প্রচারিত হয় এসব বিশেষ অনুষ্ঠান। ঈদের পনেরো দিন আগ থেকে শুরু হয় এসব অনুষ্ঠানের বিজ্ঞাপন প্রচার। কে কত ভালো অনুষ্ঠান বানাতে পারে তা নিয়ে চলে তীব্র প্রতিযোগিতা। আবার বিজ্ঞাপনদাতারাও নির্মাণ করে ঈদকেন্দ্রিক বিশেষ বিজ্ঞাপন। দর্শকরাও এই আয়োজনের সঙ্গে এখন সম্পৃক্ত হয়ে গেছে অনেকটা। সারা বছর যারা টিভি দেখার মতো সময় পায় না, ঈদ এলে তারা প্রাণভরে এসব অনুষ্ঠান উপভোগ করে।

 

প্রিন্ট মিডিয়াতেও এসেছে ঈদ-সংস্কৃতির ব্যাপক পরিবর্তন। দৈনিক, সাপ্তাহিক, পাক্ষিক ও মাসিক পত্রিকাগুলো প্রকাশ করে ঈদ বিশেষ সংখ্যা। সেই সংখ্যা চার শ থেকে পাঁচ শ পৃষ্ঠা পর্যন্ত হয়ে থাকে। ছাপা হয় নবীন-প্রবীণ কবি-সাহিত্যিকদের নানা বিষয়ের লেখা, থাকে বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের নানা বিজ্ঞাপন। এর মাধ্যমে তাদের ক্রেতা-গ্রাহকদের ঈদ শুভেচ্ছা জানানো হয়। এই বিশেষ সংখ্যাটি কার আগে কে বাজারে ছাড়বে, থাকে সেই প্রতিযোগিতাও। হালে প্রিন্ট মিডিয়ায় ঈদ উপলক্ষে প্রকাশিত হয় ফ্যাশন পাতা বা ফ্যাশন সংখ্যাও। শহরের বিভিন্ন ফ্যাশন হাউসগুলো তাদের নতুন ডিজাইনের কাপড়গুলো জমা দেয় পত্রিকার দপ্তরে। মডেলদের সেসব পোশাক পরিয়ে ফটোগ্রাফারকে দিয়ে ছবি তোলা হয়, আর সেই ছবি ছাপানো হয় পত্রিকার ফ্যাশন সংখ্যায়। এ ছাড়া ঈদ উপলক্ষে পত্রিকার বিশেষ রান্না পাতা বা রান্না সংখ্যাও প্রকাশিত হচ্ছে বেশ ক’বছর ধরে। রন্ধনশিল্পীরা ঈদের বিভিন্ন রেসিপি দিয়ে থাকেন এসব সংখ্যায়। ঈদ বিশেষ সংখ্যা ছাড়াও ঈদের ছুটির আগে দৈনিক পত্রিকাগুলো প্রকাশ করে পত্রিকার বর্ধিত পাতা। সেখানেও থাকে যথারীতি গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ ইত্যাদি।

দেখুন, বিশ বছর আগের ঈদ-সংস্কৃতির সঙ্গে আজকের ঈদ-সংস্কৃতির কত তফাত! ভবিষ্যতে যে এই ঈদ-সংস্কৃতির আরো ব্যাপক পরিবর্তন ঘটবে তাতে সন্দেহ নেই।

   

লেখক : কথাসাহিত্যিক

     

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৮ জুন ২০১৬/এএন/তারা