জাতীয়

নিশ্চিত হোক ‘অস্ত্র ও সন্ত্রাসমুক্ত বিশ্ব’

হাসান মাহামুদ : গত জুলাইয়ে জার্মানির মিউনিখে বর্বর হত্যাকাণ্ডের পর চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মার্কেল বলেছিলেন, ‘জার্মানির মানুষ ভাবছে তাদের নিরাপত্তা এখন কোথায়?’ বৈশ্বিক পরিস্থিতি এখন এমন পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে যে, বর্তমানে এই প্রশ্ন বিশ্বময়।

 

রাজনৈতিক এবং কূটনৈতিক ভাষা পরিহার করে সহজ কথায় বলতে গেলে, এই নিরাপত্তা এখন কোথাও নেই। না ইউরোপ-আমেরিকায়, না এশিয়ায়, না আফ্রিকার কোনো দেশে। সন্ত্রাসের এখন নানা চেহারা। কোথাও তারা জিহাদিস্ট। কোথাও মাওবাদী। কোথাও হিন্দুত্ববাদী।

 

উগ্র ক্রিশ্চিয়ানিটির বীভৎস চেহারাও দেখা গেছে এক সময় আমেরিকায়। এমনকি পরম শান্তিকামী বৌদ্ধদেরও একাংশের সন্ত্রাসের চেহারা এক সময় দেখা গেছে শ্রীলংকায়, ভিয়েতনামে, লাওসে। তার পাশাপাশি আছে গোষ্ঠিগত, রাজনৈতিক এবং ব্যক্তিসন্ত্রাস।

 

বাংলাদেশে কোনো সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটলে ইউরোপ ও আমেরিকা একসঙ্গে চিৎকার করে ওঠে, ‘বাংলাদেশ নাগরিক-নিরাপত্তা রক্ষায় ব্যর্থ’। কূটনৈতিকদের আগমনে হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়, বাড়তি নিরাপত্তার আওয়াজ তোলা হয়, ইত্যাদি ইত্যাদি।

 

কিন্তু ইউরোপের উন্নত দেশগুলো, এমনকি আমেরিকার মতো একটি সুপার পাওয়ারও কি তার নাগরিকদের নিরাপত্তা দিতে পেরেছে? ওলান্ডোর ওই ঘটনা কী বলে? মিউনিখের সন্ত্রাস আইএস বা জিহাদিস্টদের সন্ত্রাস নয়। মিউনিখ পুলিশের দাবি অনুযায়ী ব্যক্তিসন্ত্রাস।

 

এই ব্যক্তিসন্ত্রাসেও পৃথিবীতে কম বিপর্যয় ঘটেনি। আমেরিকা ও পাকিস্তানে স্কুলগৃহে হামলা চালিয়ে শত শত শিশু-কিশোরের মৃত্যু ঘটানো হয়েছে। সমূদ্র সৈকতে হামলা চালিয়ে অবকাশ যাপনরত শত শত নিরীহ নর-নারী হত্যা করা হয়েছে।

 

এসব হত্যাকাণ্ডের পেছনে যে ঘাতক, সে জঙ্গিবাদী না হলে বলা হয় লোন কিলার বা নিঃসঙ্গ ঘাতক। তার মানসিক বিকার রয়েছে। এ ধরনের কৈফিয়ত দিয়ে সমাজ এবং রাষ্ট্র এ হত্যাকাণ্ড সম্পর্কিত তাদের সব দায়-দায়িত্ব শেষ করে ফেলে। প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের পর রাষ্ট্রনেতারা তার নিন্দা করেন, ঘাতকদের প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করেন। কিন্তু এ হত্যার পুনরাবৃত্তি বন্ধ করতে পারেন না। তবুও বারবার আঙুল তোলা হয় বাংলাদেশের দিকে।

 

মূলত এসব সন্ত্রাসবাদ কিছু বিকৃতমনা মানুষের সাময়িক ফায়দা লুটার একটি ঠুনকো হাতিয়ার মাত্র। সন্ত্রাসী কার্যক্রমের দ্বারা পৃথিবীতে কিছু আদায় হয়েছে, এমন দৃষ্টান্ত বিরল। তবুও কিছু পথভ্রষ্ট মানুষ অস্ত্র ও সন্ত্রাসবাদে মেতে উঠে। পরে আবার সর্বস্বান্তও হয়ে যায়। মাঝে কিছু মানুষের ক্ষতি হয়, কিছু অনাকাঙ্খিত রেখা এঁকে দেওয়া হয় সাধারণ মানুষের জীবনে।

 

মূলত পৃথিবীর সকল মানুষ, সকল প্রাণী শান্তিই কামনা করে। সুন্দর ও মানবিক জীবন যাপনের জন্য মানসিক ‘শান্তি’ মানুষকে সামনের দিকে অগ্রসর হওয়ার ক্ষেত্রে অদৃশ্য ভাবে প্রেরণা যোগায়। মানুষের বেঁচে থাকার জন্য যে সকল মৌলিক বিষয় বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ তার মধ্যে ‘শান্তি’ অন্যতম।

 

বেঁচে থাকার অভিলাষে, একটু সুখ বা শান্তির সন্ধানে মানুষকে ছুটে বেড়াতে হয় চেনা-অচেনা কতো পথ। সম্মুখিন হতে হয় হরেক রকম পরিস্থিতির। আর হয়তো সে কারণেই সেপ্টেম্বর মাস আমাদের জন্য একটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ মাস। কেননা, এই সেপ্টেম্বর মাসেই মানবতার ব্রত নিয়ে জাতিসংঘ তাদের মহান যাত্রা শুরু করেছিল।

 

আজ বুধবার আন্তর্জাতিক শান্তি দিবস। বিশ্বের শান্তিকামি মানুষের দাবির প্রেক্ষিতে জাতিসংঘ এই দিনটিকে আন্তর্জাতিক শান্তি দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের শান্তিকামি মানুষ দিবসটি পালন করে আসছে। বাংলাদেশেও বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্যদিয়ে দিবসটি পালিত হচ্ছে।

 

বিশ্বব্যাপী চলমান পরিস্থিতির বিবেচনায় গত বছরের মতো এবারো ‘অস্ত্র ও সন্ত্রাসমুক্ত বিশ্বের’ দাবি নিয়ে চলছে নানা আয়োজন।

 

আন্তর্জাতিক শান্তি দিবস প্রবর্তিত হওয়ার পর, জাতিসংঘ প্রতিবছরের এ দিনটিতে শান্তি ঘণ্টা বজিয়ে শিল্পী, শিক্ষাবিদ ও মানবপ্রেমিকদের শান্তি দূত হিসেবে অংশ নিতে আমন্ত্রণ জানায়। এ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক শান্তি দিবস বিশ্বে আড়াই হাজারেরও বেশি সংস্থার সমর্থন পেয়েছে। বহু বছর ধরে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বিশ্বের নানা অঞ্চলের স্থিতিশীলতা ও শান্তি বাস্তবায়নের জন্য অনেক রকমের চেষ্টা ও তদবির করে যাচ্ছে। কিন্তু তারপরও যুদ্ধ, সন্ত্রাসী হামলা, আঞ্চলিক সংঘর্ষসহ বিভিন্ন ধরনের বল প্রয়োগমূলক সংঘর্ষ রয়ে গেছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে হয়তো বলা যায়, ‘মানবজাতির সত্যিকার শান্তি বাস্তবায়নের পথ এখনো অনেক দূর’।’ কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আমরা দেখেছি সন্ত্রাসবাদ কখনোই এই দেশে স্থায়ী আসন গাড়তে পারেনি। দীর্ঘস্থায়ী হয়নি কোনো দুষ্কৃতকারী।

 

কিন্তু আর্ন্তজাতিক সন্ত্রাসবাদই আমাদের ভাবিয়ে তুলছে বেশি। আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের প্রভাব আমাদের দেশে না পড়লেও পরোক্ষ প্রভাব হয়তো এড়িয়ে যাওয়া যাবে না। তাই আমরা চাই, ‘পৃথিবী হোক শান্তিময়।’

 

যদিও বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠা, বিশ্ব শান্তি রক্ষার প্রয়াস জোরদার করে তোলা, বিরোধ সমুহের শান্তিপূর্ণ নিস্পত্তি এবং আর্ন্তজাতিক সহযোগিতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে বহু পদক্ষেপ আমরা দেশে দেশে নিতে দেখেছি। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদেও এ লক্ষ্যে গৃহীত হয়েছে বহু সিদ্ধান্ত ও ঘোষণা। এসব সিদ্ধান্ত বা ঘোষণা কখনো ছিলো কার্যকর আবার কখনোবা একেবারেই অকার্যকর থেকে গেছে।

 

১৯৪৯ সালে জাতিসংঘের এক ঘোষণায় বলা হয়, স্থায়ী শান্তির লক্ষ্যে জাতিসংঘ সনদে বর্ণিত নীতিমালার প্রতি অশ্রদ্ধাই আর্ন্তজাতিক উত্তেজনা অব্যাহত থাকার জন্য প্রাথমিকভাবে দায়ী। বিভিন্ন সময়ে গৃহীত সিদ্ধান্তে নিন্দা করা হয়েছে অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের। আহ্বান জানানো হয়েছে আগ্রাসনধর্মী তৎপরতা থেকে বিরত থাকার। বারবার প্রকাশ করা হয়- উত্তেজনার কারণ ও ফলাফল মুছে ফেলে বিশ্ব শান্তির রক্ষার ভূমিকা জোরদার করার। সংকল্প এবং স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়, বিশ্ব শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা, সংরক্ষণ ও শক্তিশালী করে তোলার ভিত্তি ভূমি হলো বিভিন্ন রাষ্ট্রের স্বাধীনতা সমতা আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার পারষ্পারিক নির্ভরতা ও সার্বভৌমত্ব সম্পর্কে পারষ্পারিক শ্রদ্ধাবোধ।

 

প্রতিবছরের মতো এবারো শান্তি দিবসে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে সংস্থার মহাসচিব শান্তির ঘণ্টা বাজিয়ে বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠায় সবাইকে একযোগে কাজ করার আহ্বান জানাবেন। জাতিসংঘের প্রয়াস সবাইকে নিয়ে একটি নিরাপদ সংঘাতমুক্ত ও শান্তিপূর্ণ পৃথিবী গড়ে তোলা। আমাদেরও প্রত্যাশা ‘বিশ্ব শান্তি দিবস’ মানুষকে অনুপ্রাণিত করবে শান্তির দিকে ধাবিত হতে। আমাদের মনে রাখতে হবে আজকের পৃথিবী আগামীর ভবিষ্যৎ।

 

আমরা চাই শান্তিময় সুন্দর ও বাসযোগ্য বিশ্ব। আজকের দিনে এই হোক আমাদের দৃঢ় অঙ্গীকার। বাংলাদেশ একটি শান্তিপ্রিয় দেশ। এই দেশের সুনাগরিক হিসেবে বিশ্বের কাছে আমাদের দাবি, ‘যুদ্ধ চাই না, ধ্বংস চাই না, চাই পৃথিবীতে শান্তির পতাকা ওড়াতে।’

 

(মতামত লেখকের নিজস্ব)

 

লেখক: সাংবাদিক। ইমেইল: hasanf14@gmail.com

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২১ সেপ্টেম্বর ২০১৬/হাসান মাহামুদ/শাহনেওয়াজ