জাতীয়

বৈশাখী উৎসবের আওতা বেড়েছে

হাসিবুল ইসলাম মিথুন : পয়লা বৈশাখ উদযাপন এখন বাঙালির সার্বজনীন উৎসবে রূপ নিয়েছে। দিনে দিনে এর আওতা বেড়েছে, উদযাপনে লেগেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। তবে গুণীজনেরা বলছেন অন্য কথা। তাদের মতে পয়লা বৈশাখে আগে যে আয়োজন হতো তাতে মনে হয় ভাটা পড়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রাক্তন উপদেষ্টা মোঃ হাফিজ উদ্দিন খান তার বৈশাখের স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন পয়লা বৈশাখে হালখাতার কথা খুব মনে পরে। আমাদের সময়ে পয়লা বৈশাখে তেমন কোন অনুষ্ঠান হতো না এখনকার মতো। তখন হালখাতা ছিল দিনটির প্রধান আকর্ষণ। আমাদের মফস্বল শহরে কিছু কিছু স্থানে গানের আসর হতো। সেখানে গিয়ে গান শুনতাম। বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতাম।’ তিনি বলেন, ‘আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি তখন মঙ্গল শোভাযাত্রা ছিল না। এখন মহা ধুমধাম করে নানা অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে আমাদের দেশে বৈশাখকে বরণ করে নেয়া হয়। আমাদের সময়ে ইউনিভার্সিটিতে হাতে গোনা কয়েকটি স্থানে কিছু গানের ফাংশন হতো। আর এখনতো রাস্তার মোড়ে মোড়ে অনুষ্ঠান। তবে আমাদের সময়ে খুব মজা করতাম বৈশাখে। কারণ ইউনিভার্সিটি এলাকায় তেমন লোক থাকতো না আর এখন তো বৈশাখের দিন বাইরে বের হওয়াই মুশকিল হয়ে পরে।’ বৈশাখের কোন বিশেষ স্মৃতি মনে পরে কিনা- এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘না এমন কোন বিশেষ স্মৃতি আমার মনে পরে না ‘ এবার পয়লা বৈশাখ কিভাবে কাটাবেন- এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এখন আর পয়লা বৈশাখে বাইরে বের হই না। বাসায় বসেই টিভিতে অনুষ্ঠান দেখে সময় কাটাই। আর বাসায় সকাল বেলা হয়তো ইলিশ পান্তা খাবো। এছাড়া সন্ধ্যার পরে বন্ধু বান্ধবদের সঙ্গে আমাদের অফিসার্স ক্লাবে যাওয়া হবে। সেখানে কোন ফাংশন থাকলে কিছুক্ষণ তা উপভোগ করে বাসায় চলে আসবো। সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার তার বৈশাখের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, ‘ছোটবেলায় পহেলা বৈশাখের দিন খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে সবাই আমাদের মাটির ব্যাংকটি নিয়ে বসতাম। মাটির ব্যাংকটি ভেঙে যতো টাকা পাওয়া যেত তা গণনা করে রেখে দিতাম। তারপর আমরা এবং প্রতিবেশী সঙ্গি-সাথীরা একসাথে নদীতে গোসল করতে যেতাম। বাসায় মা ভোর বেলায় উঠেই ভালো খাবারের আয়োজন করতেন। আমরা সবাই মিলে গোসল সেরে এসে খাবার খেতাম। তারপর সুন্দর পোশাক পরে বৈশাখী মেলায় যাওয়ার প্রস্তুতি নিতাম। এরই ফাঁকে আমরা সবাই বাবা, চাচা আর দাদার কাছ থেকে পছন্দের জিনিস পত্তর কেনার জন্য অতি সামান্য পরিমানে টাকা পেয়ে যেতাম। যার বয়স যতো বেশি তার প্রাপ্ত টাকার পরিমান ততো বেশি। এভাবেই ছোটবেলায় বৈশাখ পালন করতাম।’ তিনি বলেন, ‘এখন বর্তমানে গ্রামের বাড়িতেও তেমন যাওয়া হয়না। ঢাকাতেই বৈশাখ কাটানো হয়। অবশ্য বিভিন্ন সামাজিক কার্যক্রমে জড়িত থাকার কারণে বৈশাখের দিন ব্যস্ত সময় পার করতে হয়।’ গণস্বাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, ‘আমি যখন ছোট ছিলাম তখন পয়লা বৈশাখের দিন মেলা হতো। আমরা বান্ধবীরা মিলে বাবার সাথে মেলায় যেতাম। মেলায় গিয়ে এটা সেটা দেখে দেখে মনের মধ্যে তখন শুধু লোভ আর লোভ। এটা কিনবো, ওটা কিনবো, এটা পছন্দ, ওটা পছন্দ - পছন্দের যেন কোন সীমা নেই। বাবা ঠিকই মাথা ঠাণ্ডা রেখে বাজেট অনুযায়ী কেনাকাটা শুরু করতেন। আমার হাত ধরেই মেলার সমগ্র মাঠ ঘুরে আমার জন্য সাজগোজ সামগ্রী কেনা শুরু করতেন বাবা।’ তিনি বলেন, ‘হরেক রকম চুড়ি, নেইল পলিশ, লিপস্টিক, কপালের টিপ, নূপুর, মাটির টেপা পুতুল, হাড়ি-পাতিল, ঢেকি ও আরো অনেক কিছু। একটা কিছু কিনে দিলে আরো হাজারটা কেনার জন্য লোভ জাগতো মনের মধ্যে। তারপর একে একে বাকিদের জন্য লাটিম, বাঁশি, ঢোল, লাঠিতে লাগানো হেলিকপ্টার, মাটির ব্যাংক, বেলুন, বিভিন্ন রকম মাটির ও প্লাস্টিকের পণ্য নিতাম। কেনাকাটা যখন প্রায় শেষ হয়ে আসতো, তখন অল্প টাকা দিয়েই কিনে নিতাম বাতাশা, মুড়ির মোয়া, লাড্ডু, মুরালী ও নাম না জানা আরো কিছু। মেলার কোন এক পাশ ঘেষে বড়রা নানা ধরনের খেলার আয়োজন করতো। আমি অবশ্য নগরদোলাতে চড়তে খুব ভয় পেতাম। তাই আমার বাবা তার ইচ্ছা সত্ত্বেও ওটাতে চড়তেন না।’ তিনি বলেন, ‘এখন আগের থেকে পয়লা বৈশাখ অনেক বড় করে পালন করা হয়। আগে হাতে গোনা দুই তিনটি স্থানে বৈশাখী অনুষ্ঠান বা গানের অনুষ্ঠান হতো। এখনতো বলতে গেলে অলিতে গলিতে অনুষ্ঠান হয়। সকাল থেকে রাস্তায় মানুষের ভিড় লক্ষ্য করা যায়। এখন বৈশাখ রীতিমতো আমাদের বাঙালিদের প্রাণের উৎসবে পরিণত হয়েছে।’ রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৪ এপ্রিল ২০১৭/হাসিবুল/শাহনেওয়াজ