জাতীয়

কেমন আছে রানা প্লাজা ধসে নিহতদের পরিবার?

আহমদ নূর, সাভার থেকে : সাভারে রানা প্লাজায় ধসে নিহতদের মধ্যে অনেকে ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। তাদের হারিয়ে বেশিরভাগ পরিবার এখন মানবেতর জীবনযাপন করছে। ওই পরিবারের সদস্যরা বলছেন, সরকার তাদেরকে সহায়তা  দিলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম ছিল। সাময়িকভাবে তারা তাদের সমস্যার সমাধান করতে পারলেও এখন অথই সাগরে ভাসছেন। এককালীন সহায়তা তাদের দৈনন্দিন সমস্যা সমাধানের একমাত্র পথ নয়। সভারের ওমরপুরের কাশেম আলীর দুই ছেলে উজ্জল, আফজাল ও পুত্রবধূ রানা প্লাজায় একটি পোশাক কারখানায় কাজ করতেন। রানা প্লাজা ধসে তারা নিহত হয়েছেন। এ ঘটনায় তার বড় ছেলে ও তার স্ত্রীর লাশ পেলেও ছোট ছেলে আফজালের লাশ খুঁজে পাননি কাশেম আলী। ডিএনএ টেস্ট করার পরও পাওয়া যায়নি আফজালের লাশ। বড় ছেলের মৃত্যুতে ক্ষতিপূরণ হিসেবে তিনি সরকারের কাছ থেকে ২ লাখ টাকা পেয়েছেন। তবে সন্তান হারানোর বেদনা সরকারের কাছ থেকে পাওয়া ২ লাখ টাকা সহায়তার কাছে কিছু না বলে জানান কাশেম আলী। তিনি বলেন, ‘দুই ছেলের উপার্জনে সংসার চলত। তাদের উপার্জনেই দুই মেয়ের বিয়ে দিয়েছি। এখন তারা নেই। অসহায় হয়ে পড়েছি। আমার বয়স হয়ে গেছে। নিজে কোনো কাজ করতে পারি না। স্ত্রীকে নিয়ে কোনোভাবে বেঁচে আছি।’ তিনি আরো বলেন, ‘সন্তানরা যখন ছিল তখন অসুখ-বিসুখ হলে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেত। এখনো আমি অসুস্থ, কিন্তু টাকার অভাবে ডাক্তারের কাছে যেতে পারি না।’ আক্ষেপ করে তিনি বলেন, ‘একবেলা খাবার পেলে অন্য বেলা খেতে পারব কি না তার নিশ্চয়তা থাকে না, সেখানে ডাক্তারের কাছে যাওয়া তো আমাদের কাছে অকল্পনীয় ব্যাপার।’ রংপুরের রুবিনার স্বামী আব্দুল হামিদ কাজ করতেন রানা প্লাজায় একটি পোশাক করাখানায়। হামিদা ও হানুফা নামে তাদের দুই মেয়ে আছে। ওই ঘটনায় আব্দুল হামিদ নিহত হওয়ার পর সরকারি ও বেসরকারিভাবে ২ লাখ ২০ হাজার টাকার মতো অনুদান পেয়েছিলেন। এসব টাকা দিয়ে রংপুরে একটি ছাপড়া ঘর তৈরি করেছেন। এখন মানুষের বাসায় কাজ করে সংসার চালান তিনি। রুবিনা রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘মেয়ে দুইটারে স্কুলে ভর্তি কইরা দিছি। কিন্তু তাগের লেহাপড়ার খরচাপাতি ঠিকমতো চালাইতে পারি না। অনুদানের টাকা পাইয়া একটা ছাপড়া ঘর বানাইছি। এখানেই তিনজন থাকি। মাইনষের বাড়িতে কাম করি।’ ভালবেসে বিয়ে করেছিলেন হামিদ ও রুবিনা। এজন্য সব সময় রুবিনার বাড়তি যত্ন নিতেন হামিদ। সে দিন এখন অতীত। আক্ষেপ করে রুবিনা বলেন, ‘তার সাথে কথা ছিল সবসময় একসাথে থাকমু। কিন্তু সেই আমারে ছেড়ে চলে গেল। এই রানা প্লাজা তারে খাইয়া নিল। এখন মেয়ে দুইটারে নিয়ে বাঁচমু কেমনে?’ ফরিদপুরের ষাটোর্ধ্ব শাহানার একমাত্র মেয়ে মনিয়াও রানা প্লাজা ধসে নিহত হয়েছেন। কিন্তু এই ঘটনার চার বছর পরও তিনি তার মেয়ের সন্ধান পাননি। তার দাবি অন্য কেউ তার মেয়ের লাশ নিয়ে গেছে। মেয়েকে হারিয়ে এখন দিশেহারা তিনি। এখন ভিক্ষা করে তার দিন চলে। শাহানা বলেন, ‘মাইয়াটা থাকতে আমার কোনো কষ্ট আছিল না। মাইয়া মারা গেল আর আমার কষ্ট বাড়ল। এখন ভিক্ষা করে চলি।’ ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সাভার বাজার বাসস্ট্যান্ডে অবস্থিত রানা প্লাজা ধসে যায়। ভয়াবহ এই দুর্ঘটনায় প্রাণ হারায় ১ হাজার ১৩৬ শ্রমিক। আহত অবস্থায় ধ্বংসস্তূপ থেকে উদ্ধার করা হয় ২ হাজার ৪৩৮ জনকে। আগের দিন ফাটল চিহ্নিত হওয়ায় ২৪ এপ্রিল সকালে কাজে যোগ দিতে চাননি রানা প্লাজার পাঁচ কারখানার শ্রমিকরা। কিন্তু ভবন মালিক ও যুবলীগ নেতা সোহেল রানার চাপেই তারা কাজে যোগ দিতে বাধ্য হন। এর কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘটে স্মরণকালের ভয়াবহ প্রাণহানির ঘটনা। ভবনটি ধসে পড়ার পর সেনাবাহিনী, ফায়ার সার্ভিস, র‌্যাব, পুলিশসহ সাধারণ জনগণ উদ্ধার তৎপরতায় নামেন। ধীরে ধীরে দীর্ঘ হয় উদ্ধার অভিযান। প্রথমবারের মতো এত বড় বিপর্যয়ের মুখোমুখি হন উদ্ধার কর্মীরা। টানা ২০ দিন ধরে চলে উদ্ধার তৎপরতা। সেনাবাহিনীর নবম পদাতিক ডিভিশনের তত্ত্বাবধায়নে একে একে ভবন থেকে অবস্থায় বের করে আনা হয় লাশ। সাভার পৌর এলাকা লাশের নগরীতে পরিণত হয়। ১৭তম দিনে জীবিত অবস্থায় উদ্ধার করা হয় রেশমা নামের এক নারী শ্রমিককে। রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৪ এপ্রিল ২০১৭/নূর/রফিক