জাতীয়

কক্সবাজারের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত, ব্যাপক প্রস্তুতি

ডেস্ক রিপোর্ট : বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় ‘মোরা’ আগামীকাল মঙ্গলবার সকালে দেশের উপকূলীয় এলাকা অতিক্রম করতে পারে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। এর প্রভাবে উপকূলীয় জেলা এবং জেলার অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরগুলোর নিম্নাঞ্চল স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে চার থেকে পাঁচ ফুট অধিক উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হতে পারে। কক্সবাজার জেলার নিম্নাঞ্চল সোমবার সন্ধ্যায় প্লাবিত হতে শুরু করেছে। উপকূলীয় ১৯ জেলায় ইতোমধ্যে প্রস্তুতিসভা করেছে স্থানীয় প্রশাসন। জরুবি বিভাগের কর্মচারিদের ছুটি বাতিল করা হয়েছে। প্রস্তুত রাখা হয়েছে মেডিকেল টিম। বিভিন্ন জেলায় দুপুর থেকেই মাইকিং করে স্থানীয়দের নিরাপদ আশ্রয়ে সরে যেতে পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। কক্সবাজার : ঘূর্ণিঝড় ‘মোরা’র প্রভাবে কক্সবাজার উপকূলের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। সমুদ্রের জোয়ারের পানি স্বাভাবিক উচ্চতার চেয়েও বেড়ে যাওয়ায় উপকূলের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়। বিকেল ৪টায় কক্সবাজার শহরের নাজিরারটেক, কুতুবদিয়াপাড়া, ফদনারডেইল, সমিতি পাড়ায় জোয়ারের পানি প্রবেশ করে প্লাবিত হয়েছে। ফলে জোয়ারের পানিতে মানুষ দুর্ভোগে পড়েছেন। এ ছাড়া মহেশখালী, কুতুবদিয়া, পেকুয়া ও টেকনাফ উপজেলায় জোয়ারের পানিতে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। কক্সবাজারের বিভিন্ন এলাকায় মাইকিং করে ঝুঁকিপূর্ণদের নিরাপদ আশ্রয় নেওয়ার জন্য বলা হলেও অনেকে নিরাপদ আশ্রয়ে যাননি। তারা জানিয়েছেন, পরিস্থিতি বুঝে তবে নিরাপদ আশ্রয়ে যাবেন। কক্সবাজার রেড ক্রিসেন্ট ইউনিটের যুব প্রধান মোহাম্মদ হোসাইন মাসুম জানান, ৭ নম্বর বিপদ সংকেত দেওয়ার পর রেড ক্রিসেন্ট কক্সবাজার ইউনিটের ৫৫ জনের একটি টিম তিন গ্রুপে ভাগ হয়ে বিভিন্ন স্থানে মাইকিং করছেন। মাইকিং করলে লোকজন কিন্তু সরে আসছেন না। তারপরও মানুষকে সতর্ক করে দেওয়া হচ্ছে। চট্টগ্রাম : চট্টগ্রাম বন্দরে অ্যালার্ট-৩ জারি করেছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। এই বিশেষ সতর্কতার আওতায় চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজ থেকে পণ্য খালাস বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। বন্দরে অবস্থানরত সবগুলো বড় জাহাজকে বহির্নোঙ্গরে চলে যেতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব ওমর ফারুক চট্টগ্রাম বন্দরে অ্যালার্ট-৩ জারির বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। বন্দর সচিব বিকেলে রাইজিংবিডিকে জানান, আবহাওয়া দপ্তরের তথ্যমতে মঙ্গলবার সকালে ঘূর্ণিঝড় মোরা চট্টগ্রাম বন্দর অতিক্রম করতে পারে। তাই বন্দরের নিরাপত্তায় অ্যালার্ট-৩ জারি করা হয়েছে। বন্দর জেটিতে থাকা সব ধরনের জাহাজ সাগরে পাঠানো হচ্ছে। ঘূর্ণিঝড়ের সময় বড় জাহাজ জেটিতে থাকলে জাহাজের আঘাতে বন্দর ও জেটি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। গোপালগঞ্জ : ঘূর্ণিঝড় ’মোরা’ এর প্রভাবে গোপালগঞ্জে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। সেই সঙ্গে বইছে হালকা বাতাস। ফলে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে জেলার জনজীবন। সাধারণ মানুষ ঘর থেকে বাইরে বের হতে পারছেন না। বাগেরহাট : ঘূর্ণিঝড় ‘মোরা’র প্রভাবে বাগেরহাটে দমকা হাওয়া ও গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি শুরু হয়েছে। মংলা সমুদ্র বন্দরকে ৫ নম্বর বিপদ সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে। ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলায় বাগেরহাটে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। জেলার সকল সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারির ছুটি বাতিল করা হয়েছে। স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষ থেকে ৮৩টি মেডিকেল টিম গঠন করা হয়েছে। বাগেরহাট জেলা প্রশাসক তপন কুমার বিশ্বাস বলেন, জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ১০টি কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে। জেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির উদ্যোগে দুর্যোগ মোকাবেলায় প্রস্তুতিমূলক জরুরিসভা করা হয়েছে। উপকূলীয় এলাকার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের জরুরিসভা করে দুর্যোগ মোকাবেলায় সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, জেলার সাইক্লোন শেল্টারগুলো প্রস্তুত রাখা হয়েছে। শুকনো খাবার সরবরাহের জন্য তৈরি রাখা হয়েছে। সরকারি বিভিন্ন সংস্থার পাশাপাশি বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোকে মাঠ পর্যায়ে কাজ করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বাগেরহাটের পূর্ব-সুন্দরবন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মো. সাইদুল ইসলাম জানান, বঙ্গোপসাগরে অবস্থান করা পাঁচ শতাধিক ফিশিং ট্রলারকে দুবলারচর, হিরণপয়েন্ট, কটকা, কচিখালীসহ বিভিন্ন এলাকার ছোট ছোট নদী ও খালে নিরাপদ আশ্রয়ে রাখা হয়েছে। সুন্দরবনে পর্যটন মৌসুম না হওয়ায় বন বিভাগের কর্মকর্তা, কর্মচারি, জেলে ও মৌয়ালদের নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সুন্দরবন বিভাগের সব নৌযান নিরাপদে নোঙ্গর করে রাখা হয়েছে। খুলনা : খুলনার বিভিন্ন উপজেলার মানুষকে ঘূর্ণিঝড় মোরা সম্পর্কে সতর্ক করতে ও নিরাপদে আশ্রয়ে নিতে মাইকিং করা হচ্ছে। জেলার নয় উপজেলায় ২৫০টি সাইক্লোন শেল্টার প্রস্তুত রাখা হয়েছে। ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলায় সোমবার দুপুরে খুলনা জেলা প্রশাসনে জরুরি প্রস্তুতি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে।  খুলনা জেলা প্রশাসক মো. আমিন উল আহসান বলেন, সকল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে জরুরিসভা করে দুর্যোগ মোকাবেলায় প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। জেলার উপকূলীয় উপজেলা কয়রা, পাইকগাছা, দাকোপে শুকনো খাবার প্রস্তুত রাখা হয়েছে। সরকারি বিভিন্ন সংস্থার পাশাপাশি বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোকে মাঠ পর্যায়ে কাজ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। মংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের হারবার মাস্টার কমান্ডার ওলিউল্লাহ বলেন, ৪ নম্বর সতর্ক সংকেতের পর বন্দরে মিটিং হয়েছে। বন্দর থেকে আর কোনো জাহাজ ছাড়ছে না। কিন্তু বন্দরের উদ্দেশে ইতিমধ্যে যেসব জাহাজ আসছিল সেগুলো আসছে। মংলা বন্দরে অবস্থানরত জাহাজে পণ্য ওঠা-নামার কাজ বন্ধ রয়েছে। নোয়াখালী : ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলায় নোয়াখালীতে জরুরি প্রস্তুতিমূলক সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। দুপুর ১২টায় জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে জেলা প্রশাসক মাহবুবুল আলম তালুকদারের সভাপতিত্বে  সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তা, পুলিশ, রেড ক্রিসেন্ট, পানি উন্নয়ন বোর্ড, ফায়ার সার্ভিস, আবহাওয়া অফিসের কর্মকর্তা, এনজিও প্রতিনিধি, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, সাংবাদিক ও সরকারি-বেসরকারি সংস্থার লোকজন উপস্থিত ছিলেন। সভায় নয়টি উপজেলার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে সতর্ক থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। জরুরিভিত্তিতে উপকূলীয় অঞ্চলে মাইকিং করা, লোকজনদের নিরাপদে সাইক্লোন শেল্টারে নিয়ে আসা, ১০২টি মেডিকেল টিম গঠন ও পর্যাপ্ত শুকনো খাবার সংগ্রহ করে মজুদ রাখার সিদ্বান্ত হয়েছে। বরিশাল : বরিশালের অভ্যন্তরীণ রুটের নৌযান চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে। বিকেলের পর থেকে নৌযান চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে বিআইডব্লিউটিএ।  বিআইডব্লিউটিএ’র পরিবহণ পরিদর্শক মো. রিয়াদ হোসেন জানিয়েছেন, সকল রুটের নৌযান চলাচলে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। সন্ধ্যার পর আবহাওয়া দপ্তরের সঙ্গে আলোচনা করে পরবর্তী সিদ্বান্ত নেওয়া হবে। সাতক্ষীরা : সাতক্ষীরায় সম্ভাব্য আঘাত মোকাবেলায় প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিয়েছে জেলা প্রশাসন।  ইতোমধ্যে উপকূলীয় শ্যামনগর ও আশাশুনি উপজেলায় মাইকিং করে জনগণকে সতর্ক করা  হয়েছে। খোলা রাখতে বলা হয়েছে সাইক্লোন শেন্টারগুলো। প্রত্যেক উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে প্রয়োজনীয় ওষুধ রিজার্ভ রাখা হয়েছে। গঠন করা হয়েছে মেডিকেল টিম। একই সঙ্গে শুকনো খাবার এবং প্রয়োজনে ব্যবহারের জন্য যানবাহন প্রস্তুত রাখা হয়েছে। শ্যামনগর উপজেলার ২০০০ জন এবং আশাশুনি উপজেলার ১৩০০ জন স্বেচ্ছাসেবককে দুর্যোগকালীন উদ্ধার তৎপরতার জন্য প্রস্তুত থাকতে বলা হয়েছে। শ্যামনগর ও আশাশুনি উপজেলার সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারিদের ছুটি বাতিল করা হয়েছে। শ্যামনগর উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. কামরুজ্জামান জানান, সকালে স্থানীয় সংসদ সদস্য এস এম জগলুল হায়দারের সভাপতিত্বে জরুরি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সভায় সকল ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ও মেম্বরদের নিজ নিজ এলাকার জনগণকে সতর্ক রাখার পাশাপাশি তাদের সহায়তা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আশাশুনি উপজেলা নির্বাহী অফিসার সুষমা সুলতানা জানান, তার উপজেলার সব সাইক্লোন সেল্টার খোলা রাখা হয়েছে। গ্রামবাসীকে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে।  সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক আবুল কাসেম মো. মহিউদ্দিন জানান, দুর্যোগকালীন আশ্রয়ের জন্য জেলার ১৩২টি সাইক্লোন সেল্টার প্রস্তুত রয়েছে। প্রত্যেক উপজেলায় পাঁচটি করে পিকআপ ও ১০টি করে ইঞ্জিনচালিত নৌযান প্রস্তুত রাখতে বলা হয়েছে। চাঁদপুর : ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলায় গুরুত্বপূর্ণ সরকারি দপ্তর প্রধানদের নিয়ে চাঁদপুর জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে জরুরিসভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। জেলা প্রশাসক মো. আব্দুস সবুর মন্ডল বলেন, চরাঞ্চলের ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের সতর্ক থাকার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। চরাঞ্চলে মাইকিং করা হয়েছে। শুকনো খাবার ও নগদ অর্থ প্রস্তুত রাখা হয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোকে প্রস্তুত করা হয়েছে। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কর্মীরাও প্রস্তুত রয়েছে। পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত কোনো সরকারি কর্মকর্তা কর্মস্থল ত্যাগ করতে পারবেন না। লক্ষ্মীপুর : ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলায় লক্ষ্মীপুর জেলা প্রশাসন প্রস্তুতি সভা করেছে। দুপুরে জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে আসা, দুর্যোগ পূর্ববর্তী, দুর্যোগ কালীন ও পরবর্তী সময়ে খাদ্য সরবরাহ, মেডিকেল টিম গঠন ও ছয়টি কন্ট্রোলরুম খোলাসহ ব্যাপক প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৯ মে ২০১৯/বকুল