জাতীয়

‘নিজের পায়ে দাঁড়ানোর লক্ষ্যে ইতিহাসের সর্ববৃহৎ বাজেট দিয়েছি’

সংসদ প্রতিবেদক : প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘অতীতের মতো আমরা পরনির্ভরশীল হয়ে থাকব না। বিদেশের কাছ থেকে ভিক্ষা, অনুদান নিয়ে নয়, আমরা নিজের পায়ে দাঁড়ানোর লক্ষ্য নিয়েই দেশের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ বাজেট দিয়েছি। আমরা ৯০ ভাগ প্রকল্পই নিজেদের অর্থায়নে বাস্তবায়ন করছি।’ বুধবার জাতীয় সংসদ অধিবেশনে ২০১৭-১৮ সালের প্রস্তাবিত বাজেটের ওপর সাধারণ আলোচনায় অংশ নিয়ে তিনি এসব কথা বলেন।  প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সরকারের ঋণের যে সীমা, তার মধ্যেই থাকবে। বাড়তি ঋণ সরকার নেবে না। ফলে আর্থিক খাত ক্ষতিগ্রস্ত হবে না- এটা আমি কথা দিতে পারি। এ নিয়ে দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই। অতীতেও জিডিপির ৫ ভাগ ঘাটতি ছিল, এবারও তাই থাকবে। একটুকুও বাড়বে না। আর আমাদের বাজেটের সবচেয়ে বড় অর্জনই হচ্ছে আমরা দেশের ধনী-গরিবের বৈষম্য হ্রাস করতে সক্ষম হয়েছি। সামাজিক নিরাপত্তাকেও আমরা সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়েছি। নতুন বাজেট বাস্তবায়নের মাধ্যমে সরকার দেশকে উন্নত-সমৃদ্ধশালী করে গড়ে তুলতে পারব। বাজেট হচ্ছে জনগণের কল্যাণের জন্য। সেই জনগণের কোনো দুর্ভোগ হোক, কষ্ট হোক আমরা তা চাই না। অর্থমন্ত্রীও তা চান না।’ সমাপনী বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী প্রস্তাবিত বাজেটকে আরো জনমুখী করতে এবং দেশের মানুষের মধ্যে এ বাজেট নিয়ে যেটুকু ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছে তা দূর করতে অর্থমন্ত্রীর কাছে তিনটি সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব রাখেন। তিনি বলেন, ‘নতুন বাজেট পাসের জন্য অপেক্ষা না করে চাল আমদানির ক্ষেত্রে আরোপিত শুল্ক ১০ ভাগে নামিয়ে দিয়েছি। তবে দেশে আমাদের খাদ্যের কোনো সমস্যা নেই। তাই যতদিন প্রয়োজন হবে, ততদিনই চাল আমদানি হবে, তার পরে নয়। তাই যেটুকু সময় প্রয়োজন ততদিন চাল আমদানির শুল্ক ১০ ভাগই থাকবে।’ ভ্যাট আইন স্থগিতের সুপারিশ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘২০০৮ সালে ভ্যাট আইন প্রণয়নের সুপারিশ করা হয়। এ নিয়ে অর্থমন্ত্রী সব মহলের সঙ্গে প্রায় তিন বছর ধরে আলোচনা করেছেন। ২০১২ সালে জাতীয় সংসদে ভ্যাট আইনটি পাস হয়। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, ব্যবসায়ীরা এই ভ্যাট আইনের ব্যাপারে খুব একটা সাড়া দিচ্ছেন না। তাই ভ্যাটের বিষয়টি আগের মতো থাকবে অর্থাৎ আগামী দুই বছর এই ভ্যাট আইন কার্যকর হবে না।’ হঠাৎ করেই চালের মূল্য বৃদ্ধি নিয়ে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের সমালোচনার জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘দেশে কোনো খাদ্যের অভাব নেই। সরকারি, বেসরকারি, চাল মিলসহ কৃষক পর্যায়ে দেশে বর্তমানে প্রায় ১ কোটি ৮৮ লাখ মেট্রিক টন খাদ্যশস্য মজুদ রয়েছে। কিন্তু ধারাবাহিকভাবে অতি বৃষ্টি ও হাওরে অকাল বন্যার পাশাপাশি কিছু ব্যবসায়ীর কারসাজির কারণে চালের দাম কিছুটা বাড়তে পারে। আমরা বিষয়টি নিয়ে বেশকিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি। চাল আমদানির ওপর আরোপিত শুল্ক কমিয়ে দিয়েছি। এ কারণে খুব শিগগিরই চালের দাম কমে যাবে বলে আমি আশাবাদী।’ কিছু ব্যাংকের আর্থিক অনিয়মের অভিযোগের জবাবে তিনি বলেন, ‘আর্থিক খাতে যেখানে অনিয়ম হয়েছে, আমরা তদন্ত করে ব্যবস্থা নিচ্ছি। আমরা বসে নেই।’ পুঁজিবাজার নিয়ে প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি এইচ এম এরশাদের বক্তব্যের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, ‘দেশের পুঁজিবাজারকে আমরা শক্তিশালী, স্থিতিশীল ও স্বচ্ছ করতে নিরন্তর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। শেয়ারবাজারে লেনদেনে কারচুপি বন্ধে ব্যবস্থা নিয়েছি। পুঁজিবাজার সংক্রান্ত মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য ট্রাইব্যুনালে পাঠানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের জন্য যে প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে, তা অব্যাহত রাখা হয়েছে। আমরা বসে নেই, পুঁজিবাজারের উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছি।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সারা পৃথিবীই এগিয়ে যাচ্ছে। আমাদেরও এগিয়ে যেতে হবে। পেছনে পড়ে থাকলে চলবে না। আমাদেরও সবকিছুতে পরিবর্তন আনতে হবে। সেজন্যই এবারের বাজেটে অর্থনৈতিক খাতে বেশকিছু সংস্কারের প্রস্তাব করা হয়েছে। যাতে আমরা আধুনিক যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারি।’ দেশবাসীর উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘ভ্যাট ও ট্যাক্স যা আদায় হয়, তা তো দেশের কল্যাণ ও উন্নয়নেই ব্যয় হয়। সবকিছু চাইব, কিন্তু কিছুই দেব না- এমনটা হলে তো চলবে না। কর না দিলে তো আপনারাই পিছিয়ে পড়বেন। ভিক্ষা নিয়ে কেউ সম্মানের সঙ্গে চলতে পারে না। আমরা চাই- দেশের একটি মানুষ গৃহহারা থাকবে না, প্রতিটি মানুষ উন্নত জীবন পাবে। সে লক্ষ্য নিয়েই আমরা কাজ করে যাচ্ছি।’ সারাবিশ্বের কাছে বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের রোল মডেল, এ কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে দেশের মানুষকে ভালবাসতে শিখেছি। বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন দেশের সব মানুষ সুন্দর ও উন্নত জীবন পাবে। তার সেই স্বপ্ন পূরণেই কাজ করে যাচ্ছি। অতীত সরকারগুলোর মতো ক্ষমতাকে ভোগ-বিলাসের বস্তু হিসেবে দেখিনি। দেশের মানুষ ভালো আছে কি না, সেটিই আমার কাছে সবচেয়ে বড়। আজ প্রধানমন্ত্রী আছি, না থাকলে চলে যাব। আমি হাঁটতে পারি, রিকশা-ভ্যানে চড়তে পারি। বঙ্গবন্ধুর কন্যা হিসেবে সব অভ্যাসই আমার আছে।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বিশ্বের যেখানেই যাই সবাই বিস্ময় প্রকাশ করেন যে, এত প্রতিকূলতার মধ্যেও বাংলাদেশ কীভাবে ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধি অর্জন ও উন্নয়ন করে যাচ্ছে। জবাবে আমি বলি, এটা কোনো ম্যাজিক নয়। আমি রাজনীতিই করি দেশের মানুষের জন্য। যে শিক্ষা আমি আমার বাবা বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে পেয়েছি। জনগণের জন্য রাজনীতি করি বলেই দেশ সবদিক থেকে আজ এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাবে।’ আওয়ামী লীগ সরকারের সময় দেশের মানুষের চাহিদাই পাল্টে গেছে, উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘৮১ সালে পরিবারের সকলকে হারিয়ে যখন দেশে আসি, ঘুরে ঘুরে দেখেছি মানুষের পেটে ভাত ছিল না। উত্তরবঙ্গসহ দেশের অনেক স্থানেই কঙ্কালসার-হাড্ডিসার মানুষ দুর্ভিক্ষে জর্জরিত। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর উত্তরবঙ্গ থেকে মঙ্গা শব্দটিই হারিয়ে গেছে। আমরা নিভৃত গ্রাম পর্যন্ত উন্নয়নের ছোঁয়া পৌঁছে দিয়েছি। দেশের মানুষের এখন খাদ্যের কোনো অভাব নেই।’ তিনি আরো বলেন, ‘২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী আর ২০২০ সালে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী। বাংলার মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তনের জন্য বঙ্গবন্ধুসহ আমার পুরো পরিবার জীবন দিয়ে গেছেন। সেই বাংলার মানুষের উন্নত জীবন দিতে, একটু ভালো রাখতে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছি। এ ব্যাপারে আমি দেশবাসীরও সহযোগিতা চাই।’ রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৮ জুন ২০১৭/এম এ রহমান/রফিক