জাতীয়

একাত্তরে শেখ হাসিনা

নিজস্ব প্রতিবেদক : আজ ২৮ সেপ্টেম্বর ৭১ বছরে পা দিলেন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা। ৭১ বছরের জীবনে ৩৬ বছর ধরে বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসমাপ্ত স্বপ্ন পূরণে আওয়ামী লীগের হাল ধরে রেখেছেন তার জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনা। বঙ্গবন্ধু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে নিহত হওয়ার পর আওয়ামী লীগের টালমাটাল অবস্থায় প্রবাস জীবনের পাঠ চুকিয়ে ১৯৮১ সালে আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে নৌকার হাল ধরেন তিনি। প্রবাসে থাকা অবস্থাতেই ১৯৮১ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত কাউন্সিলে তিনি সভাপতি নির্বাচিত হন। এরপর ওই বছরের ১৭ মে দেশে ফিরে আওয়ামী লীগের দায়িত্বভার নেন। তারপর থেকে আজ পর্যন্ত সাতবার দলীয় সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন। গত ৮ জুলাই ক্ষমতায় থেকে ২০২০ সালে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী ও ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করার আশা ব্যক্ত করেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার সরকারি বাসবভন গণভবনে আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে সূচনা বক্তব্যে তিনি বলেন, ‘আমি চাই আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থেকে ২০২০ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী ও ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করবে। কী পেলাম তা বড় কথা নয়, দেশের জনগণকে কী দিতে পারলাম, কতটুকু দিতে পারলাম তা-ই আমার কাছে সবচেয়ে বড় কথা। আজ এখানে (প্রধানমন্ত্রী) আছি, না থাকলে থাকব না। আমি হাঁটতেও পারি, রিকশা-ভ্যানেও চলতে পারি। যখন যেভাবে চলতে হয় সেভাবেই চলতে পারব। আমার কাছে দেশের মানুষই সবচেয়ে বড় কথা।’ আওয়ামী লীগের হাল ধরে চলার পথে বিভিন্ন ঘটনা তুলে ধরে বলেন, ‘এত অত্যাচার-নির্যাতনের মধ্য দিয়েও কিন্তু এই সংগঠন টিকে থেকেছে। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে ভেঙে ভেঙে টুকরো করে দেওয়া হয়েছিল। আমি এসে তো দেখলাম অনেক ব্রাকেট। একটা রাজনৈতিক দল, যে দলটি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু নিজের হাতে গড়ে তুলেছিলেন তার ওপর বার বার আঘাত এসেছে, ঝড়-ঝঞ্ঝাট, অত্যাচার-নির্যাতন, জেল-জুলুম সহ্য করতে হয়েছে। তারপরও এ দলটি টিকে থেকেছে এবং ২১ বছর পর সরকারে এসেছে।’ অবিশ্রান্ত পথচলার পথে সর্বশেষ ২০১৬ সালে ২০তম জাতীয় সম্মেলনে বয়সের কথা তুলে ধরে দলীয় দায়িত্বভার বহনে অপরাগতা প্রকাশ করেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘আমি চাই যে আমি জীবিত থাকতে থাকতে নতুনভাবে নেতা নির্বাচিত করে এই সংগঠনকে আরো গতিশীল করার চেষ্টা করবেন। ৩৫ বছর এই দলের সভাপতি। এত লম্বা সময় কেউ কখনো থাকেনি।’ তবে শেখ হাসিনার এমন ইচ্ছায় তৃণমূলের নেতারা সমস্বরে না, না বলে উঠলে শেখ হাসিনা সবাইকে বসার ইঙ্গিত দিয়ে বলেন, ‘এখনই নির্বাচন হচ্ছে না। ওটা পরে বলেন। কিন্তু এটা করতে হবে। আমার বয়স ৭০ বছর হয়ে গেছে। এটাও মনে রাখতে হবে। যে গুরু দায়িত্ব আপনারা আমাকে দিয়েছেন, তা বহন করব। ৩৫ বছর একটা দলের সভাপতি, তবে একটা সময় আমাকে বিদায় নিতে হবে।’ ১৯৪৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর মধুমতি নদী বিধৌত গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গীপাড়ায় নিভৃত পল্লীতে জন্মগ্রহণ করেন শেখ হাসিনা। বাবা-মায়ের প্রথম সন্তান। পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের লড়াই-সংগ্রাম দেখে যার বেড়ে ওঠা। তিনি শিক্ষাজীবন শুরু করেন টুঙ্গীপাড়ার এক পাঠশালায়। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে শেখ মুজিবুর রহমান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য (এমপিএ) নির্বাচিত হন। এরপর বঙ্গবন্ধুর পরিবারকে ঢাকায় স্থানান্তর করা হয়। শেখ হাসিনা ভর্তি হন টিকাটুলির নারীশিক্ষা মন্দির বালিকা বিদ্যালয়ে। ১৯৬৫ সালে আজিমপুর বালিকা বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৬৭ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন ঢাকার বকশীবাজারের পূর্বতন ইন্টারমিডিয়েট গভর্নমেন্ট গার্লস কলেজ (বর্তমান বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা মহাবিদ্যালয়) থেকে। সে বছরই ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। কলেজে অধ্যয়নকালে তিনি কলেজ ছাত্রী সংসদের সহ-সভানেত্রী পদে নির্বাচিত হন। রাজনৈতিক পরিবারে জন্মগ্রহণ করায় কিশোর বয়স থেকেই তার রাজনীতিতে পদচারণা শুরু করেন। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে ছাত্রলীগের নেত্রী হিসেবে তিনি আইয়ুববিরোধী আন্দোলন এবং ৬ দফা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। এরপর ১৯৬৮ সালে পিতার আগ্রহে পরমাণু বিজ্ঞানী ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়ার সাথে তার বিয়ে হয়। ১৯৮১ সালের ১৩-১৫ ফেব্রুয়ারি হয় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের দ্বিবার্ষিক সম্মেলন। জাতির এক ক্রান্তিলগ্নে শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতে তাকে দলের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। এরপর সামরিক শাসকদের রক্তচক্ষু ও নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ১৯৮১ সালের ১৭ মে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন জননেত্রী শেখ হাসিনা। এরপর দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে সামরিক জান্তা ও স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে একটানা অকুতোভয় সংগ্রাম, জেল-জুলম, অত্যাচার উপেক্ষা করে ১৯৯৬ সালের ১২ জুনের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়ের মাধ্যমে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। ২০০১ সালের নির্বাচনের পর বিএনপি-জামাত জোট সরকার গঠন করে। এরপর বিএনপি-জামাত জোট সরকারের সময় ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের শান্তি সমাবেশে গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। তিনি অলৌকিকভাবে প্রাণে বেঁচে গেলেও আওয়ামী লীগ নেত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ জন নেতা-কর্মী নিহত হন। এরপর ১/১১ নতুন ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয় অর্জিত হয়। ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি দ্বিতীয়বারের মতো দেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। সর্বশেষ ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেশ পরিচালনার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। শেখ হাসিনার সংগ্রামমুখর জীবনের পথচলা সহজ ছিল না। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস তিনি গৃহবন্দি থেকেছেন। সামরিক স্বৈরশাসনামলেও বেশ কয়েকবার তাকে কারাভোগ ও গৃহবন্দি থাকতে হয়েছে। বার বার তার জীবনের ওপর ঝুঁকি এসেছে। অন্তত ১৯ বার তাকে হত্যার অপচেষ্টা করা হয়েছে। জীবনের ঝুঁকি নিয়েও অসীম সাহসে তিনি তার পিতার অসমাপ্ত স্বপ্ন পূরণের পথে এগিয়ে চলছেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, জঙ্গিবাদ প্রতিরোধ, বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনিদের বিচার, পার্বত্য চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক শান্তি চুক্তি সম্পাদন, ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতিসহ জাতীয় জীবনের বহুক্ষেত্রে অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করেছেন তিনি। শেখ হাসিনা বর্তমানে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭২তম অধিবেশনে যোগদান উপলক্ষে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন। এর আগে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭১তম অধিবেশনে তিনি নারীর ক্ষমতায়নে তার অসাধারন অবদানের স্বীকৃতি হিসাবে ‘প্লানেট ৫০-৫০ চ্যাম্পিয়ন’ ও ‘এজেন্ট অব চেঞ্জ’ অ্যাওয়ার্ড গ্রহণ করেন। এ ছাড়াও জাতিসংঘের ৭০তম অধিবেশনেও তিনি দুটি পুরস্কারে ভূষিত হন। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবেলায় জাতীয় ও আন্তজাতিক পর্যায়ে সক্রিয় ও দৃশ্যমান ভূমিকা এবং বলিষ্ঠ নেতৃত্বের স্বীকৃতি হিসেবে ‘চ্যাম্পিয়নস অব দ্য আর্থ’ ও ডিজিটাল বাংলাদেশ নির্মাণে যুগান্তকারী উদ্যোগের জন্য ‘আইসিটি টেকসই উন্নয়ন’ পুরস্কার লাভ করেন শেখ হাসিনা। এর আগে রাষ্ট্র পরিচালনায় দক্ষতা, সৃজনশীলতা এবং সাফল্যের জন্য আন্তর্জাতিকভাবে তিনি ‘সাউথ সাউথ’ ও ‘সেরেস’ পদকসহ অন্যান্য পুরস্কারে ভূষিত হন। বাংলাদেশে নারী ও শিশুর উন্নয়নে ভূমিকা রাখার জন্য ইউনেস্কো থেকে ‘শান্তির বৃক্ষ (ট্রি অব পিস) অভিধায়ও সিক্ত হন। শেখ হাসিনার জন্মদিনে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে বাদ জোহর জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে মিলাদ ও দোয়া মাহফিল, সকাল ১০টায় মেরুল বাড্ডার আন্তর্জাতিক বৌদ্ধ বিহার ও মিরপুরে খ্রিস্টান অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশে (সিএবি) এবং সুবিধাজনক সময়ে ঢাকেশ্বরী মন্দিরে বিশেষ প্রার্থনা হবে। দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সংশ্লিষ্ট সবাইকে এসব কর্মসূচি পালন করার আহ্বান জানিয়েছেন। রোহিঙ্গা সংকটের কারণে এবার শেখ হাসিনার নির্দেশে তার জন্মদিন উপলক্ষে কেক কাটা ও আনন্দ উৎসব থেকে বিরত থাকার জন্য বাংলাদেশ আওয়ামী লীগসহ সকল সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের নেতা-কর্মী, সমর্থক-শুভানুধ্যায়ীদের প্রতি দলের পক্ষে অনুরোধ করা হয়েছে। রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৭/নৃপেন/রফিক