জাতীয়

স্টেশনেই ওদের ঈদ

নিজস্ব প্রতিবেদক : হাজার হাজার মানুষ যখন স্বজনদের সঙ্গে ঈদের খুশি ভাগাভাগি করতে গ্রামে যাচ্ছেন, স্টেশনে ট্রেন ছাড়ার অপেক্ষায় ট্রেনে বা প্লাটফর্মে বসে আছেন, তখন ওরা কমলাপুর রেলস্টেশনের প্লাটফর্মে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ঘুরে বেড়াচ্ছে শুধু পেটের দায়ে। চেষ্টা করছে কিছু আয়ের জন্য, যা দিয়ে তারা একবেলা খাবে। নেই বাড়ি যাওয়ার তাড়াহুড়ো, নেই ঈদের কোনো পরিকল্পনা। স্টেশনেই হবে ওদের ঈদ। কারণ, এই স্টেশনই এসব শিশুর বাড়িঘর। এই স্টেশনই তাদের রুটিরুজির ব্যবস্থা করে। বৃহস্পতিবার কমলাপুর রেলস্টেশনে গিয়ে দেখা যায়, ট্রেন আসার সঙ্গে সঙ্গে স্টেশনের থাকা এসর শিশুর কেউ দৌড়ে গিয়ে ট্রেনে উঠছে, বোতল কুড়াচ্ছে, কাগজ কুড়াচ্ছে, এখানে ঢু মারছে, ওখানে ঢু মারছে, কী যেন খুঁজছে। একটা পরিত্যক্ত বোতল সামনে পেলে তা তুলে নিচ্ছে, একটু পানি কিংবা জুস থাকলে তা পান করছে। মা-বাবার সঙ্গে গ্রামের যাওয়ার জন্য প্লাটফর্মে অপেক্ষা করা শিশুদের দেখে হয়তো তাদের আফসোস হচ্ছে। কিন্তু কিছুই করার নেই। তাদের ভাগ্যে যে এটাই লেখা ছিল। সিনেমার পরিচালক তাদের এই রোলই দিয়েছেন। এই রোল নিয়েই তারা বাস্তবে অভিনয় করে যাচ্ছে। অন্য শিশুদের কারো বাবা খাইয়ে দিচ্ছে, কারো মা খাইয়ে দিচ্ছে, আর তারা চেয়ে চেয়ে দেখছে। ইসমাইল নামের এক শিশু জানায়, তার বাড়ি সুনামগঞ্জে। মা-বাবা আলাদা হয়ে দুইজনেই আবার বিয়ে করেছে। তার খবর কেউ রাখে না। সে দীর্ঘদিন ধরে ময়মনসিংহ স্টেশনে ছিল। মাসখানেক হলো কমলাপুর স্টেশনে এসেছে। এখানে তার দিনরাত কাটে। এখানেই তার ঈদ কাটবে। তার নতুন পোশাক কেনা হয়নি। কেনারও সামর্থও নেই।  

দেখা যায়, তার গায়ের শার্ট আর প্যান্ট ময়লার কালো আবরণে পুরু হয়ে গেছে। গায়েও ময়লা স্পষ্ট। প্রচণ্ড গরমে ঘেমে যাচ্ছে। হাঁটছে আর গায়ের ময়লা হাত দিয়ে ঘঁষে ঘঁষে তুলছে। তার সঙ্গে আরো দুটি শিশু রয়েছে। স্টেশনে কী করো, জানতে চাইলে ইসমাইল জানায়, সে ট্রেনের যাত্রীদের বোঝা বয়ে যা পায় তা দিয়েই তার পেট চলে। শুধু ইসমাইল নয়, তার মতো কয়েক শ’ শিশুর ঈদ কাটবে স্টেশনে। তারা চেয়ে থাকবে অন্যের দিকে। হয়তো জুটবে না সেমাই, মিষ্টি বা ভালো কোনো খাবার। হয়তো জুটবে না নতুন পোশাক। ময়লার আবরণে কালো হয়ে যাওয়া পোশাক পরেই ঈদ কাটবে তাদের। স্টেশনের বাইরে এক কোণে দেখা যায়, কয়েকজন ব্যক্তি কয়েকজন শিশুকে প্যাকেট দিচ্ছেন। কাছে গিয়ে কথা বলে জানা গেল, কয়েকজন ব্যক্তিগত উদ্যোগে স্টেশনের শিশুদের পোশাক আর খাবার দিচ্ছেন। কথা হয় শর্বরী ফাহমিদার সঙ্গে। তিনি বলেন, আমরা ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করার জন্য মূলত তাদের নতুন পোশাক দিচ্ছি। আমাদের সামর্থ অনুযায়ী ১০০ শিশুকে আমরা জিন্সের প্যান্ট, টি-শার্ট ও দুপুরে খাওয়ার জন্য বিরিয়ানি দিয়েছি। এ সময় তিনি এসব শিশুর হাতে মেহেদি লাগিয়ে দেন। তারা ১০০ শিশুকে দেওয়ার জন্য আগে থেকেই টোকেন দিয়ে রেখেছিলেন। কিন্তু টোকেন ছাড়া অনেকেই এসে পোশাকের জন্য ঘুরছে। তাদের তারা দিতে পারছেন না। কারণ, তাদের আর সামর্থ নেই। ফাহমিদার সঙ্গে যখন কথা হচ্ছিল, তখন আরো অনেক শিশু এসে এ প্রতিবেদককে বলছিল- স্যার, আমাকে একটা টোকেন দেন। স্যার, দেন না। স্যার, আমার নামটা লেখেন। এদের মধ্যে একজন রাজন। তার বাড়ি হবিগঞ্জে। তার বাবার নাম শামিম, মায়ের নাম শামিমা। শামিম সৎবাবা। সৎবাবার হাতে মারধর থেকে বাঁচতে পালিয়ে চলে আসে কমলাপুর স্টেশনে। ঈদ চলে এসেছে, কিন্ত নতুন পোশাক এখনো জোটেনি রাজনের ভাগ্যে। বাড়িও তার যাওয়া হবে না। কার কাছে যাবেন, স্বজন থেকেও তার নেই। রাজনের সঙ্গে কথা বলা শেষ হওয়ার আগে আসেন এক বৃদ্ধ নারী। বয়সের ভারে কুঁজো হয়ে গেছেন। শরীর চামড়া ঝুলে গেছে। তিনি নিজের জন্য কিছু চান না। চান নাতনির জন্য। ভেবেছেন, এ প্রতিবেদক তাদের কিছু সহযোগিতা করবে। তাই এ প্রতিবেদকের কাছে এসে বলেন, স্যার, আমার নাতির নামটা একটু লেখেন। স্টেশনে থাকা এসব শিশুর কারো বাবা-মা, ভাই-বোন আছে, তারা গ্রামের বাড়িতে। কারো নেই। কারো বাবা আছে, মা নেই। কারো মা আছে, বাবা নেই। কেউবা নানির বা দাদির সঙ্গে স্টেশনের সেন্টারে থাকে। আবার কারো বাবা–মা থেকেও নেই। তারা বিয়ে করে আলাদা থাকে। অন্যত্র মাথা গোজার ঠাঁই নাই। তাই তাদের সন্তানদের আশ্রয় হয়েছে এই স্টেশনে। এই স্টেশনই তাদের বাবা-মা, এই স্টেশনই তাদের খাওয়া, এই স্টেশনই তাদের আন্দদ দেয়, কষ্ট ভোলায়। স্টেশনেই তারা একে অপরের সাথে ভাগাভাগি করে নেবে ঈদের আনন্দ।

   

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৫ জুন ২০১৮/সাওন/রফিক