জাতীয়

সড়ক পরিবহন আইন : শ্রোতার প্রস্তাবনা

নিজস্ব প্রতিবেদক : বাংলাদেশে দ্রুত নগরায়ণ ও সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের পরিপ্রেক্ষিতে সড়ক পরিবহন খাতের গুরুত্ব বহুগুণে বৃদ্ধি পাওয়ায় নতুন হতে যাওয়া সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ এ সংযুক্ত করার জন্য কিছু প্রস্তাবনা জানিয়েছে শ্রোতা। রোববার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) সাগর-রুনি মিলনায়তনে সংগঠনটি আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ প্রস্তাব জানানো হয়। সংবাদ সম্মেননে বক্তারা বলেন, সড়ক পরিবহনের মতো অতি গুরুত্বপূর্ণ খাতের সুষ্ঠু ও নিয়ন্ত্রিত বিকাশের স্বার্থে আধুনিক নিরাপদ সড়ক পরিবহন ব্যবস্থাপনার একটি শক্তিশালী আইনি কাঠামো প্রয়োজন। কারণ সড়ক দুর্ঘটনা এক নতুন মহামারী হিসেবে জনজীবনকে আতঙ্কগ্রস্ত করে রেখেছে। সড়ক পরিবহন খাতের আইন কাঠামো উন্নতির লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার মোটর ভেহিকেল অর্ডিনেন্স (এমভিও) ১৯৮৩ আধুনিকায়নে উদ্যোগী হয়েছে। এই লক্ষ্যে সরকার সম্প্রতি বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ আইন ২০১৮ নামে একটি আইন জাতীয় সংসদে পাস করেছে। অপর দিকে সড়ক পরিবহন আইন ২০১৭ নামে একটি প্রস্তাবিত খসড়া আইন প্রস্তুত করেছে। আমরা মাল্টি স্টেক-হোল্ডারের পর্যালোচনা ও ওয়ার্কিং গ্রুপের নিবিড় গবেষণার মধ্য দিয়ে শ্রোতা প্রস্তাবিত সড়ক পরিবহন (খসড়া) আইন ২০১৮ তে বিভিন্ন ধরনের ঘাটতি ও দুর্বলতা সনাক্ত করে একটি সুপারিশমালা প্রস্তুত করেছি। বক্তারা আরো বলেন, বাংলাদেশে একটি পরিকল্পিত, নির্ভরযোগ্য, নিরাপদ, জনবান্ধব ও আধুনিক সড়ক পরিবহন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এই আইন প্রণীত হইল। আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে সড়ক ব্যবস্থাপনায় জড়িত সকল কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণমূলক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তে সেবামূলক মনোভাব প্রতিষ্ঠা করা এবং সংবিধানে বিধৃত মানবিক মর্যাদা, রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি ও মৌলিক অধিকারসমূহ সমুন্নত রাখা এর অন্যতম উদ্দেশ্য। সড়ক দুর্ঘটনায় জানমালের ক্রমবর্ধমান ক্ষয়ক্ষতি আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য হুমকি স্বরূপ। সুতরাং পরিবহনের সাথে নিরাপত্তার বিষয়টি আইনের সকল বিধানের সাথে সমন্বয় করা প্রয়োজন। তাই আইনটির শিরোনাম ‘সড়ক পরিবহন আইন ২০১৭’ এর পরিবর্তে ‘সড়ক পরিবহন ও সড়ক নিরাপত্তা আইন ২০১৭’ নামকরণ করারও প্রস্তাব করছি আমরা। এছাড়া কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় অন্তর্ভুক্ত না করা বা বাদ পড়ে যাওয়ার মধ্যে মোটর ভেহিকেল অর্ডিনেন্স (এমভিও) ১৯৮৩ এর অপরিহার্য/বাদ যাওয়া কিছু বিষয় অন্তর্ভুক্তকরণ: ১৯৮৩ সালের মটরযান অর্ডিনেন্সের পরিশিষ্টে উল্লিখিত বিভিন্ন ফরম, মেডিক্যাল অযোগ্যতা, লাইসেন্স প্রদান করার উদ্দেশ্যে চালকের পরীক্ষা গ্রহণ পদ্ধতি, সড়ক চিহ্ন ইত্যাদি বিষয়াবলি প্রস্তাবিত খসড়ায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। অথচ এসব বিষয় ব্যতিত আইনটির সঠিক প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন অসম্ভব। নিবারণমূলক বিধানাবলির মধ্যে-নিরাপদ যানবাহন ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে চালক-কন্ডাক্টর ও যানবাহন ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে মালিকের দায়িত্ব সুনির্দিষ্টকরণ, গণসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ, যানবাহনে প্রাথমিক চিকিৎসা সরঞ্জাম সংরক্ষণকরণ, যানবাহনের গঠন ও স্থাপত্য কৌশল সকল শ্রেণির (নারী, শিশু, প্রতিবন্ধী ইত্যাদি) যাত্রী-বান্ধবকরণ। আইনে অসংজ্ঞায়িত টেকনিক্যাল টার্মগুলোর সংজ্ঞা-খসড়া আইনে কিছু টেকনিক্যাল টার্ম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে যাদেরকে সংজ্ঞায়িত করা হয়নি যেমন ধারা ৪৪-এ মহাসড়কের ও ধারা ২৬ (৫) এ রঙচটা, বিবর্ণ, জরাজীর্ণ কিংবা ঝুকিঁপূর্ণ ও ক্ষতিগ্রস্ত ইত্যাদি। আইনগত ব্যাখ্যার সুবিধার্থে ধারা ২-এ এ টার্মগুলোর সংজ্ঞা প্রদান করা জরুরি। মোটর ভেহিকেল অর্ডিনেন্স (এমভিও) ১৯৮৩ এর ১৫৯ (অপরাধের বিচারের বিশেষ বিধান) ও ১৬৩ (তাৎক্ষণিক জরিমানা) ধারার বিধান নতুন আইনে পুনঃস্থাপনকরণ: প্রস্তাবিত খসড়ায় এই দায়িত্ব মোবাইল কোর্টের এখতিয়ারাধিন করা হয়েছে যা মোবাইল কোর্টকে ভারাক্রান্ত করবে। কারণ ইতিমধ্যে এই কোর্ট ১১০টি আইনের আওতায় কয়েক শত অপরাধের বিচারের দায়িত্বপ্রাপ্ত। আচরণবিধির মধ্যে সংশ্লিষ্ট সবার জন্য সুনির্দিষ্ট আচরণবিধি প্রণয়ন ও তার ব্যাখ্যা আইনে অন্তর্ভুক্ত করা। অভিযোগ গ্রহণ ও নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে যাত্রী, যাত্রী প্রতিনিধি, যাত্রী সংগঠন বা একই উদ্দেশ্যে গঠিত অন্যান্য সামাজিক বা সড়ক নিরাপত্তায় নিয়োজিত সংগঠনসমূহের যাত্রী স্বার্থবিষয়ক অভিযোগ গ্রহণ ও নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করার জন্য আইনে স্পষ্ট বিধান অন্তর্ভুক্ত করা। সড়ক নিরাপত্তা তহবিল গঠন বিষয়ে সরকার ও যাত্রী সাধারণের অংশগ্রহণে সড়ক নিরাপত্তা তহবিল গঠন করা। যাত্রী ছাউনি, ওভারপাস, আন্ডারপাস, জেব্রাক্রসিং, বাস স্টপেজ, ফুটপাত, বাস টার্মিনালের স্থান নির্ধারণ, স্থাপন ও রক্ষণাবেক্ষণ কমিটিতে মালিক-শ্রমিক প্রতিনিধিত্ব ছাড়াও যাত্রী প্রতিনিধিত্বের বিধান অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব করা যাচ্ছে। এ ছাড়াও মহাসড়কে চালক ও পরিবহন শ্রমিকদের জন্য প্রয়োজনীয় বিশ্রামাগার নির্মাণ সংক্রান্ত আইনি কাঠামো প্রণয়ন করা। এদিকে দুর্ঘটনা তদন্ত ব্যবস্থাপনার আধুনিকায়নের বিষয়ে সংগঠনটির প্রস্তাবনাগুলো হল-দুর্ঘটনা মামলার ক্ষেত্রে বিশেষায়িত তদন্ত। কারণ এই তদন্ত প্রক্রিয়া অন্যান্য ফৌজদারি মামলার তদন্ত থেকে ভিন্ন। এখানে কারিগরি ও বৈজ্ঞানিক সহায়ক যন্ত্রপাতি, বিশেষায়িত পদ্ধতি ও দক্ষতা গুরুত্বপূর্ণ। সড়ক পরিবহন আইনের ওপর প্রণিতব্য বিধিমালায় দুর্ঘটনা মামলা তদন্ত প্রক্রিয়া অন্তর্ভুক্ত। ক্ষতিপূরণ বিষয়াবলী-দ্রুত ক্ষতিপূরণ আদায়ের লক্ষ্যে একটি ক্ষতিপূরণ ট্রাইব্যুনাল গঠনের বিধান এই আইনে অন্তর্ভুক্ত করা। ক্ষতিপূরণ নির্ধারণের ক্ষেত্রে ট্রাইব্যুনাল নিম্নলিখিত বিষয়াবলী বিবেচনায় নেওয়া। এর মধ্যে ক) ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির বয়স খ) ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির আয় গ) ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির ক্ষতির পরিমাণ। এ ছাড়াও ট্রাইব্যুনাল গঠনের নিমিত্তে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ নিশ্চিতকল্পে এই আইনে বিধান অন্তর্ভুক্ত করা। পরোপকারীর সুরক্ষা বিধান অন্তর্ভুক্তকরণ-দুর্ঘটনায় আহতদের সাহায্যকারীদের আইনগত সুরক্ষা করে একটি পৃথক আইন প্রণয়ন। বিধি তৈরিতে সকল অংশীজনের অন্তর্ভুক্তিকরণ-বিধিমালা প্রস্তুতপর্বে সংশ্লিষ্ট অংশীজনের অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণে সুনির্দিষ্ট বিধান এই আইনে সংযুক্ত করা। জেন্ডার পরিপ্রেক্ষিত-পরিবহন সেক্টরে নারীদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি জন্য আইনে ইতিবাচক পদক্ষেপ মূলক বিধান অন্তর্ভুক্তকরণ, পরিবহন কমিটিসহ সকল কমিটিতে নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্য আইনে নারী সদস্যের জন্য কোটার বিধান রাখা, সকল পরিবহন স্থাপনা নারী, শিশু ও প্রতিবন্ধীবান্ধব করার বিধান রাখা, সংশ্লিষ্ট সকলের আচরণ বিধিতে যৌন হয়রানি প্রতিরোধের বিষয়াবলী অন্তর্ভুক্ত করার বিধান রাখা, প্রণিত (প্রণিতব্য) সকল ফর্মে পুরুষ ও নারী ছাড়াও তৃতীয় লিঙ্গের উল্লেখ করার বিধান রাখা। পরিবহন কমিটি-সংশ্লিষ্ট সবার অধিকার ও মতামত প্রতিফলনের স্বার্থে সড়ক ব্যবহারকারী, সড়ক নিরাপত্তা সংগঠন, কর্মী, এনজিও, যাত্রীদের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন এবং অন্যান্য অংশীজন স্টেইকহোল্ডারদের এই কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা। সড়ক নিরাপত্তা কমিটি-জাতীয়, বিভাগীয়, জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে সড়ক নিরাপত্তা কমিটি গঠন করার স্পষ্ট বিধান আইনে অন্তর্ভুক্ত করা এবং সংশ্লিষ্ট অংশীজনের অংশগ্রহণমূলক প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার বিধান প্রণয়ন করাও সুপারিশ জানানো হয়। রাইজিংবিডি/ঢাকা/৫ আগস্ট ২০১৮/নাসির/সাইফ