জাতীয়

এখনো ক্ষত শুকায়নি ওয়াহেদ ম্যানশনের

উপার্জনক্ষম ছেলে ওয়াসিরকে হারিয়ে দিশেহারা ব্যবসায়ী বাবা নাসির উদ্দীন। আগের মতো ব্যবসাও ঠিক যাচ্ছে না। বাসা-ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে যাতায়াতে প্রতিদিন যে সড়ক ব্যবহার করেন- সেই সড়কেই একদিন যমদূত হয়ে আগুন কেড়ে নিয়েছে ছেলের প্রাণ।

চুড়িহাট্টার ওয়াহেদ ম্যানশন, নিয়মিত এখানে আসেন তিনি। আগুন লাগা ভবনের দিক তাকিয়ে থাকেন আনমনে। এক দৃষ্টিতে ভবনটির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে এক সময় হয়তো সন্তানের স্মৃতি তাকে পারিপার্শ্বিকতা ভুলিয়ে দেয়। কেমন যেনো এলোমেলো হয়ে যান তিনি। নিঃশব্দে দুচোখে উপচে ওঠে শোক। সন্তান হারানোর বেদনায় ক্ষত বিক্ষত হয় অন্তর।

এক বছর আগে আগুন লেগেছিল এই ওয়াহেদ ম্যানশনে। চারতলা ভবনের দেয়ালে দেয়ালে এখনো আগুনের লেলিহান শিখার কালোশিটে দাগ স্পষ্ট হয়ে আছে। স্টিলের জানালাগুলোর অবস্থাও একই। তাকালেই ভুতুড়ে বাড়ির মতো মনে হয়।

ভবনের এক পাশে রাজমহল হোটেল, অন্যপাশে ফুড জাংশন নামে একটি রেস্তোরাঁ (অগ্নিকাণ্ডের আগে ফার্মেসি ছিল)। আশপাশে প্লাস্টিকের কাঁচামাল বিক্রির দোকান। চারপাশে ব্যস্ত মানুষের চলাফেরা। তবুও ভবনের দিকে তাকালেই মনে পড়ে যায় সেই ভয়ঙ্কর রাতের কথা। মনে পড়ে যায়, আগুনের সর্বগ্রাসী লেলিহান শিখা সেদিন কেড়ে নিয়েছিল ৭১টি তাজা প্রাণ।

সরেজমিনে ওয়াহেদ ম্যানশনে গিয়ে দেখা গেছে, আগুনের ভয়াবহতার ক্ষত এখনো শুকায়নি। তার মধ‌্যেই নিচতলায় সংস্কার কাজ চলছে। দ্বিতীয় তলা চারপাশ থেকে খোলামেলা। উপরে ওঠার সিড়িতে কলাপসিপল গেট। গেটে তালা দেওয়া।

দুর্ঘটনার পর এক বছর কেটে গেছে। কিন্তু সেখানে কোনো পরিবর্তন আসেনি। গেটে সব সময় তালা থাকায় ভবনের দ্বিতীয় তলায় মানুষের চলাফেরাও নেই। ভবনের নিচতলায় সংস্কার কাজ করে কয়েকটা দোকান প্রস্তুত করা হচ্ছে। এর মধ্যে একটি দোকান ভাড়াও হয়েছে। সেখানে প্লাস্টিক কাঁচামাল বিক্রি করা হচ্ছে। অন্যান্য দোকানগুলো প্রস্তুত হলে হয়তো প্লাস্টিক কাঁচামাল বা রাসায়নিক পদার্থের কনটেইনারই এখানে ঢুকবে আবারো।

সন্তান হারা বাবা নাসির উদ্দীন রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘আমার বড় ছেলে ২০১৩ সালে ক্যান্সারে মারা গেছে। চুড়িহাট্টার আগুন আমার ছোট ছেলেকেও কেড়ে নিল। এই ভবন আমার সব কেড়ে নিয়েছে।’

ঘটনার দিনে প্রাণে বেঁচে যান মো. আসলাম। নিজের চোখে সেদিন চাচাকে আগুনে পুড়ে মরতে দেখেছেন। অসহায়ের মতো শুধু তাকিয়ে দেখেছেন আর আক্ষেপে বুক চাপড়ে কেঁদেছেন।

তিনি বলেন, ‘আগুন লাগার পর পরই দোতলা থেকে আমি ছিটকে মসজিদের সামনে পড়ে যাই। ভাগ্য ভাল সেখানে আগুন ছিল না। পরে ফায়ার সার্ভিস এসে পানি দিলে আমি প্রাণে রক্ষা পাই। ওই সময় নড়তে পারছিলাম না। কিন্তু চাচাকে বাঁচাতে পারলাম না।’

তিনি আরো বলেন, ‘এই বিল্ডিং এতগুলো মানুষের জীবন নিয়া নিল, এখন দেখলেই ডর লাগে।’

প্রসঙ্গত, ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর চকবাজারের চুড়িহাট্টার ওয়াহেদ ম্যানশনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এতে ৭১ জন নিহত হন।

২০১০ সালে নিমতলী বস্তিতে আগ্নিকাণ্ডের পর কেমিক্যাল থেকে লাগা এ আগুন ছিল দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। নিমতলীতে আগুন লাগার পর পুরান ঢাকা থেকে কেমিক্যাল গোডাউন সরিয়ে নেওয়ার দাবি ওঠে। তবে প্রশাসন সেটি বাস্তবায়ন করতে পারিনি। ওয়াহেদ ম্যানশনে আগুন লাগার ফের এ দাবি জোরালো হয়। কিন্তু প্রশাসনিক ব্যর্থতায় এবারও সেটি সফলতার মুখ দেখেনি।

কথায় বলে সময় সবচেয়ে বড় চিকিৎসক। অনেক বড় ক্ষতও সময়ের প্রলেপে ভুলে যায় মানুষ। এক বছরের ব‌্যবধানে চুড়িহাট্টার ভয়াবহ আগুন ও প্রাণহানীর কথা মানুষ ভুলে গেছে। ভোলেনি কেবল স্বজন হারানো ব‌্যাথাতুর মানুষগুলো। তবে থেমে থাকেনি চলাচল বা কোলাহল। আগুনে পোড়া সেই ভয়াবহ ভবনটিকে ঘিরে আবারো গড়ে উঠেছে ব‌্যবসা প্রতিষ্ঠান, জমে উঠেছে বেচাবিক্রি-ব‌্যবসা। ঢাকা/নূর/সনি