জাতীয়

দেশ উন্নয়নশীল হলেও উদ্যোক্তায় নারীরা পিছিয়ে 

স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বাংলাদেশ এখন উন্নয়নশীল দেশের সূচকে অবস্থান করছে। জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভলপমেন্ট পলিসির সুপারিশের ভিত্তিতে এটি হয়েছে। একে দেশের সার্বিক উন্নয়নের স্বীকৃতি হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা। এই উন্নয়নে নারীদের অবদান থাকলেও ব্যবসা-বাণিজ্য এবং কর্মক্ষেত্রে নারীরা এখনও পিছিয়ে রয়েছেন। গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো এ জন্য সমাজ ব্যবস্থা, আইনি সুবিধা না পাওয়া ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে দায়ী করছেন। 

বিশ্বব্যাংক, মাস্টারকার্ড, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি), পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই), বাংলাদেশ উইমেন চেম্বার অব কর্মাস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (বিডব্লিউসিসিআই) এবং ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) বিভিন্ন প্রতিবেদনে ব্যবসায় নারীদের সাফল্য ও প্রতিবন্ধকতা তথ্য উঠে এসেছে। 

বিশ্বে নারী উদ্যোক্তাবান্ধব অর্থনীতির দেশের মধ্যে ইসরায়েল, যুক্তরাষ্ট্র, সুইজারল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড, পোল্যান্ড, যুক্তরাজ্য, কানাডা, সুইডেন, অস্ট্রেলিয়া ও স্পেন পর্যায়ক্রমে শীর্ষ অবস্থান করছে। 

উদ্যোক্তাবান্ধব ও গতিশীল পরিবেশ, শক্তিশালী ব্যবসায়িক যোগাযোগ, কার্যকর সহায়তা ব্যবস্থা, সৃজনশীলতা এবং উদ্ভাবনের জন্য তারা শীর্ষে অবস্থান করছে। (মাস্টারকার্ড গবেষণা প্রতিবেদন ২০২০)।

বাংলাদেশে ব্যবসায়ী সংগঠনে মাত্র ১৫ শতাংশ নারী নেতৃত্ব রয়েছে। আর যেসব নারীরা বড় উদ্যোক্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন বা আছেন, তাদের বেশিরভাগ পারিবারিক ব্যবসার মাধ্যমে এসেছেন। সাধারণত বাংলাদেশের নারী উদ্যোক্তারা কৃষি ও মৎস্য চাষের মতো এসএমই খাতে কাজ করছেন। এখাতে নারী উদ্যোক্তার সংখ্যা প্রায় ২১ শতাংশ। আর কর্মক্ষেত্রে নারীরা শ্রমিক হিসেবে বিভিন্ন পেশায় নিয়জিত রয়েছেন। যার সিংহভাগ তৈরীপোশাক শিল্পে।

গবেষণা দেখা গেছে, বাংলাদেশে করোনা মহামারির এ সময়ে পুরুষ উদ্যোক্তাদের তুলনায় নারী উদ্যোক্তারা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। নারী উদ্যোক্তাদের ৮৭ শতাংশ দাবি করছেন করোনার কারণে তাদের ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।    সম্প্রতি প্রকাশিত ‘মাস্টারকার্ড ইনডেক্স অব উইমেন এন্ট্রাপ্রেনিউরস’ প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, বাংলাদেশের কর্মক্ষম নারীর মধ্যে ৩৬ শতাংশ কর্মে রয়েছেন। আর পুরুষদের অংশগ্রহণ ৮১ শতাংশ। কর্মে নারীদের অংশগ্রহণ কমথাকা এবং নেতৃত্বে পিছিয়ে থাকার জন্য অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ও সমাজ ব্যবস্থা নারীবান্ধব না হওয়াকে কারণ হিসেবে দেখছে প্রতিষ্ঠানটি। 

তবে প্রতিবেশী দেশ ভারতের থেকে ভালো অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশে কর্মক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ। ভারতে নারীদের মধ্যে কর্মক্ষম ২০ শতাংশ কর্মে যুক্ত আছেন, আর পুরষের হার ৭৬ শতাংশ।

এদিকে, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে আইনি সুরক্ষায় পুরুষের তুলনায় বাংলাদেশের নারীরা অর্ধেক সুবিধা পেয়ে থাকে বলে দাবি বিশ্বব্যাংকের। ১৯০টি দেশে ব্যবসায় বা কর্মক্ষেত্রে নারীর আইনি সুরক্ষায় বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের ‘ওমেন বিজনেস অ্যান্ড দ্যা ল ২০২০’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এ দাবি করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্যবসা-বাণিজ্য এবং কর্মক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের থেকে খারাপ অবস্থানে আছে আফগানিস্তান। বিশ্বে বাংলাদেশের থেকে খারাপ অবস্থানে রয়েছে মাত্র ১৮টি দেশ।

আর বাংলাদেশ উইমেন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (বিডব্লিউসিসিআই) আয়োজিত ‘বাংলাদেশের নারী উদ্যোক্তাদের ওপর কোভিড-১৯ এর প্রভাব' শীর্ষক অনুষ্ঠানে সংগঠনের সভাপতি সেলিমা আহমাদ দাবি করেন, কোভিড-১৯ সময়কালে বাংলাদেশের বেশিরভাগ নারী উদ্যোক্তারা তাদের ব্যবসা হারিয়েছে, বা ব্যবসা ছোট হয়েছে। নারীদের কেউ কেউ মার্কেটের নিজস্ব শো-রুম ছেড়ে দিয়েছে এবং বাসায় নিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছে। এছাড়াও শ্রমিক ছাটাইয়ে পড়ে সঞ্চয় ভাঙতে বা সম্পদ ও মেশিন বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন। ফলে নারী উদ্যোক্তারা পারবারিক সংহিসতা, মানসিক চাপ এবং লোন পরিশোধের চাপের মধ্যে দিয়ে সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং মানসিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে। 

সংগঠনটি জানিয়েছে, সরকার ঘোষিত প্রণোদনায় আলাদা করে নারী উদ্যোক্তাদের সুবিধা নেই, যার ফলে নতুন এবং পুরাতন নারী উদ্যোক্তারা প্রণোদনা পাচ্ছে না বা সুবিধা নিতে সমস্যার মুখে পড়ছে। সমস্যা উত্তরণের জন্য উইমেন চেম্বার সুনির্দিষ্ট ১১টি সুপারিশ করেছে। 

গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘নারীদের সব ক্ষেত্রেই প্রতিবন্ধকতা করেছে। এটি সামাজিক এবং ধর্মীয় কারণে হয়ে আসছে। এই মূল্যবোধ পরিবর্তন না হলে নারীদের সামাজিক অবস্থান পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। তবে একেবারেই যে পরিবর্তন হচ্ছে না, তা বলছি না। যেসব খাতে পরিবর্তন হচ্ছে, তা হচ্ছে- শিক্ষায়। এতে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়ছে। দেখা যাচ্ছে, সরকারি চাকরিতে এবং বিভিন্ন পেশায় চাকরি হিসেবে নারীদের অংশগ্রহণ বেড়েছে।’ 

অর্থনীতির এ গবেষক বলেন, ‘কর্মে অর্থাৎ উদ্যোগে বা ব্যবসায় নারীদের তেমন অংশগ্রহণ তেমন বাড়েনি। এর প্রমাণ এসএমই খাত। দেশে নারী উদ্যোক্তা হওয়ার ক্ষেত্রে একমাত্র ভালো পথ হচ্ছে এসএমই। কিন্তু মোট এসএমই উদ্যোক্তাদের মধ্যে মাত্র ৩ শতাংশ নারী। এতে কী বুঝাচ্ছে? কী চিত্র উঠে আসছে? দেশে এখনো নারীরা ব্যবসায় তেমন অবদান রাখতে পারছে না। তারা নীতি সহায়তা পাচ্ছে না বা নিতে পারছে না।’ এছাড়াও সামাজিক মূল্যবোধের কারণে অনেকে ব্যবসায় আসতে চাচ্ছে না বা পারছে না বলে মনে করেন তিনি।