জাতীয়

চার সংগ্রামী নারীর গল্প

কঠিন জীবন সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে যেতে হয় অনেক নারীকে।  প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলা করে এগিয়ে যাচ্ছেন নারীরা।  আজ সোমবার (৮ মার্চ) আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে রাইজিংবিডির পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো চার সংগ্রামী নারীর গল্প।

বিদিশা সিদ্দিক চেয়ারম্যান, বিদিশা ফাউন্ডেশন পড়াশোনার চেয়ে হৈ-চৈ আর খেলাধুলা করেই কাটত বেশিরভাগ সময়। অন্য দশজন মেয়ের মতো নিজেকে নিয়ে ভাবেননি তিনি। ছোট থেকেই ছিলেন পররোপকারী।  সব সময় দুঃখী মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন তিনি। 

বাবা কবি আবু বকর সিদ্দিক ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। বাগেরহাটে জন্ম নেওয়া দীনা নামের মেয়েটি, বা-মায়ের দেওয়া ‘দীনা’ নামটি নিজেই পরিবর্তন করে স্কুলে ভর্তি হন বিদিশা নামে।  প্রয়াত সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদকে বিয়ে করে পরিচিতি পান বিদিশা এরশাদ নামে।

রাইজিংবিডিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বিদিশা সিদ্দিক বলেন, বাবা ছিলেন কবি এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। সে কারণে আমার বেড়ে উঠা সাহিত্যমনার মধ্য দিয়ে। তবে আমি ছোটবেলা থেকে ডানপিটে স্বভাবের। তাই আমার কোনো কাজে পরিবারের কেউ বাধা দিতো না। কবিতা ভালোবাসতাম। বাবা যখন কবিতা আবৃতি করতেন আমি বসে শুনতাম। জীবনানন্দ দাশের বনলতা সেনের ‘চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা...’ এই লাইন থেকেই আমার বিদিশা নামটি নেওয়া।  ক্রমে পরিবারের লোকজনসহ সবাই আমাকে বিদিশা  নামেই ডাকা শুরু করে।  এভাবেই আমার বিদিশা নামটি পরিচিতি পায়।

বিদিশার শৈশব আর কৈশোর কেটেছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে।  মাত্র ১৪ বছর বয়সে বাবার পছন্দ করা ইংল্যান্ডের নাগরিক পিটার উইসনের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। তিনি চলে যান ইংল্যান্ডে।  বিয়ের পর তার লেখাপড়া চলে ইংল্যান্ড ও সিঙ্গাপুরে।  তিনি ফ্যাশন ডিজাইনের  ওপর ডিগ্রি নেন লা-সাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সিঙ্গাপুর শাখা থেকে।

হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের সঙ্গে একটা অ্যাম্বাসিতে তার প্রথম দেখা হয় বলে জানান তিনি। এরপর দুজনের ভালো লাগা, প্রেম এবং বিয়ে। সে সময় তিনি তার স্বামী পিটারের সঙ্গে সিঙ্গাপুরে বসবাস করতেন। এসব ঘটনা ১৯৯৮ সালের।

এরপর অনেক কিছু ঘটে তার জীবনে। রাজনীতিতে আসেন তিনি। তার এবং পিটারের দুটো সন্তান ছিল। এরশাদের ছিল এক ছেলে-এরিক এরশাদ। তারপরও বিদিশা একটি মেয়ে শিশুকে দত্তক নেন। সেই মেয়েটি এবং বিদিশার দুই ছেলে-মেয়ে এখন ইংল্যান্ডে।  এরশাদের সন্তান এরিক আছে বিদিশার সঙ্গে।

এরশাদের মৃত্যুর পর আবারও নানা ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েন বিদিশা। যদিও প্রবল মানসিক শক্তি দিয়ে সেসব বাধা পেরিয়ে আবারও উঠে দাঁড়ান তিনি। বারিধারার দূতাবাস রোডের এরশাদের বাড়িতেই বর্তমানে মা আর ছেলের বসবাস। দিনের বেশিরভাগ সময় তিনি কাজ করেন ‘বিদিশা ফাউন্ডেশন’ নিয়ে।  নির্যাতিত, অবহেলিত, লাঞ্ছিত নারীদের নিয়ে কাজ করে এ ফাউন্ডেশন। বিদিশা এরশাদ এই ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

তানিয়া ওয়াহাব ম্যানেজিং পার্টনার, কারিগর, স্বত্বাধিকারী, ট্যান তানিয়া ওয়াহাবের জন্ম ও বেড়ে ওঠা ঢাকায়।  বাবার বাড়ি ফেনীতে।  লেদার টেকনোলজিতে ফাইনাল ইয়ারে পড়ার সময় কয়েক বন্ধু মিলে ২০০৫ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ‘কারিগর’। কয়েক বছর পর নিজস্ব একটা ব্র্যান্ড তৈরির প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন।  আর এই ব্র্যান্ড তৈরির প্রস্তুতি নিতে সময় লেগে যায় ১১ বছর।  ২০১৬ সালে কারিগর থেকে তৈরি হয় নতুন ব্র্যান্ড ‘ট্যান’।

নারী দিবস উপলক্ষে রাইজিংবিডিকে তিনি বলেন, সবার সমর্থন আর ভালোবাসায় ব্যস্ততায় দিন কাটছে।  বিভিন্ন ফ্যাশন হাউজের সঙ্গে কাজ করছি।

তিনি বলেন, করপোরেট গিফট, মানিব্যাগ, কম্পিউটার ব্যাগ, অফিসিয়াল ব্যাগ, ফ্যাশনেবল লেডিস ব্যাগ, বেল্ট, ডায়েরি ও জ্যাকেট নিয়মিত তৈরি হচ্ছে আমার প্রতিষ্ঠান থেকে। বর্তমানে ৪০ জন কাজ করছেন কারখানায়। অনেক সময় চাহিদা অনুযায়ী ২০০ জনও কাজ করেন।

দেশি অনেকগুলো স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তার প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। এর মধ‌্যে- বাটা, এপেক্স, আড়ং, কে ক্রাফট, বাংলাদেশ আমেরিকান ট্যোবাকো, গ্রামীণফোন, ওরিয়ন গ্রুপ, আমিন মোহাম্মদ গ্রুপ, জর্ডান অ্যাম্বাসি, বাহরাইন অ্যাম্বাসি, মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক, ইস্টার্ন ব্যাংক, বেসিক ব্যাংক, বিশ্বাস বিল্ডার্স, হেলথ কেয়ার ফার্মা, ইবনে সিনা ফার্মাসহ অনেক কোম্পানি।

তিনি জানান, নারী উদ্যোক্তা হিসেবে কাজ করতে গিয়ে বিভিন্ন সমস্যায় পড়তেন প্রথমদিকে।  এখন সে সমস্যা কমেছে। কঠিন পরিশ্রমের ফলে আজ সাফল্যের কাছে পৌঁছেছেন বলে জানান তানিয়া ওয়াহাব।

কাজের স্বীকৃতি হিসেবে তিনি ২০০৮ সালে এসএমই ফাউন্ডেশন অ্যাওয়ার্ড, ২০১১ সালে বেস্ট এসএমই নারী উদ্যোক্তা অ্যাওয়ার্ড, ২০১৪ সালে ডিএইচএল- ডেইলি স্টার ওমেন ইন বিজনেস অ্যাওয়ার্ড, ২০১৫ সালে জাতীয় মহিলা পরিষদের সেরা নারী উদ্যোক্তা অ্যাওয়ার্ড, ২০১৮ সালে সিটি-আলো-কালার্স ম্যাগাজিন অ্যাওয়ার্ডসহ বেশ কয়েকটি অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন।

একজন সফল নারী উদ্যোক্তা হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফরসঙ্গী হয়ে ২০১১ সালে ভারত এবং ২০১৮ সালে অস্ট্রেলিয়া ভ্রমণ করেছেন। ২০১১ সালে আমেরিকা সরকারের আমন্ত্রণে প্রথমবার সেখানে যান।  দ্বিতীয়বার গেছেন ২০১৮ সালে। ২০১৬ সালে অস্ট্রেলিয়ান সরকারের ফেলোশিপ এবং ২০১৮ সালে সরকারের আমন্ত্রণে অস্ট্রেলিয়া গেছেন।  এছাড়া সরকারি আমন্ত্রণে বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেছেন। এর মধ্যে রয়েছে- জাপান, ইটালি, জার্মানি, মালয়েশিয়া, পাকিস্তান, দুবাই, চীন, থাইল্যান্ড ইত্যাদি।

শাহনাজ শারমীন প্রধান প্রতিবেদক, নাগরিক টিভি শাহনাজ শারমীন।  পড়াশোনা শেষ করে প্রদায়ক হিসেবে ১৯৯৯ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত কাজ করেছেন দেশের দুই শীর্ষস্থানীয় দৈনিক জনকণ্ঠ এবং প্রথম আলোতে। ২০০১ থেকে ২০০২ সাল কাজ করেছেন এসিড সারভাইভারস ফাউন্ডেশনে।  ২০০২-২০০৩ সাল কাজ করেছেন চ্যানেল আইতে ট্রেইনি রিপোর্টার হিসেবে।  সিআরপিতে কাজ করেছেন ২০০৪ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত।

এরপর আবারও ফিরে আসেন গণমাধ্যমে। এবিসি রেডিওতে যোগ দেন ২০০৭ সালে। সেখানে কাজ করেছেন ২০১৫ পর্যন্ত। এরপর পত্রিকা, রেডিওর পরে এবার যোগ দেন টেলিভিশনে।  দীপ্ত টিভিতে কাজ করেছেন ২০১৫ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত। অতঃপর বর্তমান হাউজ। নাগরিক টিভি। এখানে কাজ শুরু করেন ২০১৮ সালে। বর্তমানে প্রধান প্রতিবেদন হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। রিপোর্টিং ছাড়াও শাহনাজ শারমীন বিভিন্ন শো উপস্থাপনা করেছেন এটিএন বাংলা, দীপ্ত টিভি এবং বর্তমান কর্মস্থল নাগরিক টিভিতে।

নিজের কাজের স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছেন বিভিন্ন পুরষ্কার। তার মধ্যে রয়েছে- ২০১১ সালে মীনা অ্যাওয়ার্ড, ২০১২ সালে অ্যান্টি ট্যোবাকো জার্নালিজম অ্যাওয়ার্ড, মীনা মিডিয়া অ্যাওয়ার্ড, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি অ্যাওয়ার্ড, ২০১৩ সালে প্রথম আলো অ্যান্টি ড্রাগস বেস্ট রিপোর্টার অ্যাওয়ার্ড, মীনা মিডিয়া অ্যাওয়ার্ড, ২০১৪ সালে বন্ধৃ-মিডিয়া ফেলোশিপ অ্যাওয়ার্ড, ডিআরইউ-গ্রামীণফোন রিপোর্টিং অ্যাওয়ার্ড এবং ২০১৫ সালে অ্যান্টি করোপশান কমিশন মিডিয়া অ্যাওয়ার্ড ও পিআইবি এটুআই মিডিয়া অ্যাওয়ার্ড।

 নাজ রহমান ওয়েনার ও পার্টনার, বারকোড রেস্টুরেন্ট গ্রুপ

নাজ রহমান। নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় শুরু করেন বুটিক শপ ই-বুটিক ডটকম।  এরপর পড়াশোনা শেষ করে ৪ বন্ধু মিলে বিদেশি আইসক্রিম ফ্রেঞ্ঝাইস নিউজিল্যান্ড চেইন শুরু করেন।  বনানীর ১১ নম্বর রোডে সেই আইসক্রিমের ব্যবসা শুরু করেন। 

কিন্তু গুণগতমান ঠিক রেখে, দেশীয় কোম্পানির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেশিদিন সেই ব্যবসা চালিয়ে যেতে পারেননি। বেশ বড় অংকের টাকা লোকসান দিয়ে ব্যবসা বন্ধ করে দেন। আইসক্রিমের ব্যবসা বন্ধ করলেও দমে যাননি বন্ধুরাসহ নাজ।  অন্য ব্যবসার পরিকল্পনা শুরু করেন।

চট্টগ্রামের খাবারের দোকান বারকোড রেস্টুরেন্ট গ্রুপের ৪টা রেস্টুরেন্ট চেইন এর একটা শুরু করেন ঢাকার গুলশানে। আবারও নতুন করে বিনিয়োগ। ব্যবসায়ী পরিবারের মেয়ে নাজ।  ছোটবেলা থেকে দেখে আসছেন, পরিবারের সবাই ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। অবচেতনভাবে সেভাবনাই মাথায় ঢুকে ছিল তার। তাই চাকরির দিকে না গিয়ে আবারও ব্যবসার পথে। পরিবারের সমর্থন পেয়েছেন এক্ষেত্রে। বারকোড ক্যাফে, গুলশানের ব্যবসা বেশ ভালো চলছিল। 

হঠাৎ আবার চরম বিপর্যয়ে পড়েন তারা। তিন বছরের মাথায় তাদের জমির মালিক সেই জমি বিক্রি করে দেন অন্য একজনের কাছে। বাধ্য হয়ে তাদের আবারও ব্যবসা গুটাতে হয়।  গুলশান ছেড়ে ‘বারকোড ক্যাফে’ চলে আসে বনানীর ২১ নম্বর রোডে। এখানে আছেন দুই বছর ধরে।

ইতোমধ্যে বনানীতে আরেকটি খাবারের দোকান খুলেছেন তারা। এটিও চট্টগ্রামের বিখ্যাত খাবার ‘মেজবানী’র দোকান।  নাম ‘মেজ্জান হাইলে আইয়ুন’। রয়েছে একই চেইনের আরও দুটি প্রতিষ্ঠান-‘বার্গউইচ টাউন ফিউশন ক্যাফে (ফুচকাবাজি)’ এবং 'তেহেরীওয়ালা'।

ব্যবসার পথ খুব সরল নয় বলে জানান নাজ রহমান।  তবে পারিবারিক সাপোর্ট আর নিজের একান্ত ইচ্ছের পাশাপাশি কঠোর পরিশ্রমের কারণে আস্তে আস্তে বেশ ভালো করছেন বলেও জানান তিনি। ব্যবসাসহ সমাজের বিভিন্ন পর্যায়ে নারীদের আরও বেশি করে সম্পৃক্ত হবার আহ্বান জানান তিনি।