জাতীয়

শ্রমিক-মালিক নির্বিশেষ, মুজিববর্ষে গড়বো দেশ: মহান মে দিবস আজ

আজ ১ মে, শনিবার। শ্রম শোষণের বিরুদ্ধে শ্রমিকের আত্মত্যাগের সংগ্রামের দিন আজ। এই বছর যথাযোগ্য মর্যাদায় ‘শ্রমিক-মালিক নির্বিশেষ, মুজিববর্ষে গড়বো দেশ’কে প্রতিপাদ্য ধরে দিবসটি পালিত হচ্ছে।

১৮৮৬ সালের এই দিনে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে শ্রমের মর্যাদা, শ্রমের মূল্য ও দৈনিক আট ঘণ্টা কাজের দাবিতে আন্দোলনে নেমেছিলেন শ্রমিকরা। আন্দোলনে বেশ কিছু শ্রমিক আত্মাহুতিও দিয়েছিলেন সেদিন। তাদের সেই আত্মত্যাগের স্মরণে বিশ্বের অন্যান্য দেশের পাশাপাশি বাংলাদেশও দিবসটি ‘মে দিবস’ হিসেবে যথাযথ মর্যাদার সঙ্গে পালিত হয়ে আসছে। বিশেষ করে, ১৮৮৯ সালের ১৪ জুলাই ফ্রান্সে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক শ্রমিক সম্মেলনে ১ মে শ্রমিক দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। পরের বছর থেকে ১ মে বিশ্বব্যাপী পালন হয়ে আসছে ‘মে দিবস বা ‘আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস’ হিসেবে।

স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে ১৯৭২ সালে ১ মে’কে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ‘মে দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি দেন। একইসঙ্গে সরকারি ছুটিও ঘোষণা করেন।

এবার বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও শনিবার ‘মে দিবস’ পালিত হচ্ছে। তবে করোনার কারণে এ বছর জনসমাগম-সংশ্লিষ্ট বাইরের সব কর্মসূচি স্থগিত করা হয়েছে। 

দিবসটি উপলক্ষে আজ সরকারি ছুটি। ‘শ্রমিক-মালিক নির্বিশেষ, মুজিববর্ষে গড়বো দেশ’ প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখেই সীমিত পরিসরে সারাদেশে পালিত হচ্ছে মহান মে দিবস। এই উপলক্ষে বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের পক্ষ থেকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সীমিত কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে শ্রমিক সমাবেশ, শোভাযাত্রা, আলোচনা সভা, সেমিনার ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।

দিবসটির গুরুত্ব ও তাৎপর্য তুলে ধরে রাষ্টপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ, বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদেরসহ রাজনৈতিক শীর্ষ নেতারা পৃথক বাণী দিয়েছেন।

শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জাতীয় ও আঞ্চলিক পত্রিকাগুলোতে বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করা হয়েছে। দিবসটি উপলক্ষে গুরুত্বপূর্ণ সরকারি ভবন, গুরুত্বপূর্ণ সড়ক দ্বীপগুলো সুসজ্জিত করা হয়েছে। দিবসের গুরুত্ব তুলে ধরে বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বিভিন্ন বেসরকারি টিভি চ্যানেলে বিশেষ অনুষ্ঠানমালা প্রচার করবে।

‘মহান মে দিবস ২০২১’ উপলক্ষে দেওয়া বাণীতে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ বলেন, ‘মে দিবসের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে পারস্পরিক সুসম্পর্ক বজায় রেখে শ্রমিক ও মালিকের উৎপাদন বৃদ্ধিতে নিবেদিত হতে হবে।’

রাষ্ট্রপতি মহান মে দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশসহ বিশ্বের সকল শ্রমজীবী মানুষকে আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানান। রাষ্ট্রপতি এবারের মে দিবসের প্রতিপাদ্য ’শ্রমিক-মালিক নির্বিশেষ, মুজিব বর্ষে গড়বো দেশ’অত্যন্ত যথার্থ হয়েছে বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ‘‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আজীবন মেহনতি মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য সংগ্রাম করেছেন। তিনি ছিলেন শ্রমজীবী মানুষের অকৃত্রিম বন্ধু। স্বাধীনতার পরপরই ১৯৭২ সালে জাতির পিতার উদ্যোগ ও বলিষ্ঠ নেতৃত্বে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার সদস্যপদ লাভ করে। একইসঙ্গে আইএলও’র ৬টি কোর কনভেনশনসহ ২৯টি কনভেনশন অনুসমর্থন করে। এটি শ্রমজীবী মানুষের জীবনমান উন্নয়ন ও তাদের অধিকার রক্ষায় এক অনন্য মাইলফলক। ১৯৭৩ সালে আলজিয়ার্সে অনুষ্ঠিত জোট নিরপেক্ষ শীর্ষ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘বিশ্ব আজ দুই ভাগে বিভক্ত, একদিকে শোষক আর অন্যদিকে শোষিত; আমি শোষিতের পক্ষে।’ তিনি রাজনৈতিক স্বাধীনতার পাশাপাশি অর্থনৈতিক মুক্তির স্বপ্ন দেখেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর সেই স্বপ্ন পূরণে শ্রমজীবী মানুষের কল্যাণে সবাইকে দলমত নির্বিশেষে একাত্ম হতে হবে। এই অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনে শ্রমিক-মালিক সমপ্রীতি দেশের উন্নয়নের পথকে তরান্বিত করবে।’’    মে দিবস উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার বাণীতে বলেন, ‘সরকার দেশের শ্রমজীবী মানুষের জীবন-মান উন্নয়ন ও কল্যণে বিভিন্ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। বিশ্বব্যপী করোনা সংক্রমণের ভয়াল পরিস্থিতি মোকাবিলায় আমাদের সরকার শ্রমজীবী মানুষের পাশে থেকে ত্রাণ বিতরণসহ সর্বাত্মক কার্যক্রম পরিচালনা করছে। সরকার সংকট মোকাবিলায় শ্রমিকদের বেতনের জন্য ৮ হাজার ৬০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে।’ তিনি বলেন, ‘রপ্তনিমুখী তৈরি পোশাক, চামড়াজাত পণ্য ও পাদুকা শিল্পে কর্মহীন হয়ে পড়া ও দুস্থ শ্রমিকদের জন্য সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রম বাস্তবায়ন নীতিমালা, ২০২০ বাস্তবায়নের জন্য শ্রম অধিদপ্তরের অনুকূলে ৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। করোনা পরিস্থিতিতে দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে কল-কারখানা চালু রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সেক্ষেত্রে অবশ্যই শ্রমিকদের স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার বিষয়টি সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিশ্চিতকরতে হবে।’

দিবসের প্রাক্কালে শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ান শ্রমজীবী মেহনতি মানুষকে মহান মে দিবসের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। মে দিবস উপলক্ষে আজ আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া স্বাক্ষরিত এক বার্তায় দেশের চলমান সংকটে কর্মহীন, খেটে খাওয়া, শ্রমজীবী মেহনতি মানুষের পাশে দাঁড়াতে সমাজের সব বিত্তবান ও সচ্ছলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ।

বিরোধী দল জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের তার বাণীতে বলেন, ‘করোনা মোকাবিলা এখন সারা বিশ্বের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ। প্রতিবছর আমরা নানা আয়োজনে মহান মে দিবস উদযাপিত করি। কিন্তু এবারের বাস্তবতা একেবারেই ভিন্ন। তাই কোনো আয়োজন ছাড়াই ঘরে বসে এই দিনটি পালন করতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘করোনাকালে খেটে-খাওয়া শ্রমজীবী মানুষের প্রতি সবাই সদয় থাকুন।’ ঈদকে সামনে রেখে শ্রমিকদের বেতন ও বোনাস সময়মতো পরিশোধ করুন। যেকোনো ন্যায্য দাবি আদায়ে শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহবান জানান তিনি ।

  মে দিবসের কর্মসূচি মহান মে দিবস উপলক্ষে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির উদ্যোগে শনিবার বেলা ১১টায় সেগুনবাগিচার সংহতি মিলনায়তনে করোনা দুর্যোগ ও বাংলাদেশের শ্রমিকশ্রেণী শীর্ষক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক ও কেন্দ্রীয় নেতারা শারীরিক দূরুত্ব রেখে এই আলোচনায় অংশ নেবেন।

এ উপলক্ষে ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন (ডিইউজে) কার্যালয়ে বিকাল ৩টায় আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। ডিইউজের সভাপতি কুদ্দুস আফ্রাদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিতব্য সভায় সাংবাদিকদের অংশ নেওয়ার জন্য সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ আলম খান তপু অনুরোধ জানিয়েছেন।

মে দিবস কী ও কেন ? আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস, যা মে দিবস নামেও পরিচিত। প্রতি বছর ১ মে বিশ্বব্যাপী উদযাপিত হয় দিবসটি। এটি আন্তর্জাতিক শ্রমিক আন্দোলনের উদযাপন দিবস। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে শ্রমজীবী মানুষ এবং শ্রমিক সংগঠনগুলো রাজপথে সংগঠিতভাবে মিছিল ও শোভাযাত্রার মাধ্যমে দিবসটি পালন করে থাকে। বিশ্বের প্রায় ৮০টি দেশে ১ মে জাতীয় ছুটির দিন। আরও অনেক দেশে এটি বেসরকারিভাবে পালিত হয়।

১৮৮৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের শ্রমিকরা দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজ করার জন্য আন্দোলন শুরু করেন। তাদের এ দাবি কার্যকর করার জন্য তারা সময় বেঁধে দেন ১৮৮৬ সালের পহেলা মে পর্যন্ত। বারবার মালিকপক্ষের কাছে দাবি জানানো হলেও কোনো সাড়া না পাওয়ায় শ্রমিকদের প্রতিবাদ চরমে ওঠে।

৪ মে, ১৮৮৬ সাল। ঘড়িতে তখন সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা। চারদিকে হালকা বৃষ্টির সঙ্গে হিমেল হাওয়া বইছে। এরই মধ্যে শিকাগোর হে মার্কেট স্কয়ার নামের এক বাণিজ্যিক এলাকায় শ্রমিকরা মিছিল করতে জড়ো হন।

অগাস্ট স্পিজ নামে এক নেতা জড়ো হওয়া শ্রমিকদের উদ্দেশে কিছু কথা বলছিলেন। হঠাৎ দূরে দাঁড়ানো পুলিশ দলের কাছে এক বোমার বিস্ফোরণ ঘটে, এতে মেথিয়াস জে. ডিগান নামের একজন পুলিশ তৎক্ষণাৎ এবং আরও ছয়জন পরবর্তী সময়ে শহীদ হন। পুলিশ বাহিনী শ্রমিকদের ওপর অতর্কিতে হামলা শুরু করে।  যা পরে দাঙ্গায় রূপ নেয়। এই দাঙ্গায় ১১ জন শ্রমিক শহীদ হন।

শ্রমিকদিবস ঘোষণা ১৮৮৯ সালের ১৪ জুলাই ফ্রান্সে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক শ্রমিক সম্মেলনে ১ মে’কে ‘শ্রমিক দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। পরবর্তী বছর থেকে ১ মে বিশ্বব্যাপী পালন হয়ে আসছে ‘মে দিবস’ বা ‘আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস’।

তবে যে দেশে এ ঘটনার, জন্ম সেই যুক্তরাষ্ট্রই মে দিবস পালন করে না। একই কথা কানাডার ক্ষেত্রেও। এই দুটি দেশ সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সোমবার শ্রমিক দিবস পালন করে থাকে।