জাতীয়

করোনায় দিশেহারা অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিকরা

বর্তমানে করোনাভাইরাস মহামারির কারণে দেশজুড়ে এক ধরনের লকডাউন চলছে। প্রায় সবকিছু বন্ধ রয়েছে। এ অবস্থায় সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছেন অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকরা। করোনার শুরু থেকে দুই দফায় মোট ৯২ দিন এদের অধিকাংশই কর্মহীন ছিল। করোনা পরিস্থিতিতে দেশব্যাপী সরকার বিভিন্ন খাতে প্রণোদনার ঘোষণা দিয়েছিল। কিন্তু সঠিক তালিকার অভাবে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের কাছে সহায়তা পৌঁছায়নি। এই অবস্থায় অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিকরা বেশি সমস্যায়।

গত বছরের মার্চে দেশে করোনা সংক্রমণ শুরু হয়। এরপর সরকার সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে, যা একটানা ৬৬ দিন ছিল। এ সময় জরুরি সেবা ছাড়া সবকিছুই বন্ধ রাখা হয়।  এই সময়ে এই খাতের প্রায় শতভাগ শ্রমিক কর্মহীন ছিলেন। চলতি বছর করোনাভাইরাসের ঊর্ধ্বমুখী সংক্রমণ মোকাবিলায় গত ৫ এপ্রিল থেকে সারা দেশে লকডাউন ঘোষণা করে সরকার।  এরপর দুই দফায় লকডাউনের মেয়াদ বাড়ানো হয়।  এখনো লকডাউন চলছে।  ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত গত ২৬ দিনেও এ খাতের শ্রমিকরা কর্মহীন।

শ্রমিকরা সরকারের নিম্নতম মজুরি বোর্ডের ন্যূনতম মজুরি কাঠামোর মধ্যেও নেই।  তাদের কোনো শ্রম অধিকার রাষ্ট্রের শ্রম আইনে স্বীকৃত নয়।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ জরিপে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত শ্রমিকের সংখ্যা ৫ কোটি ১৭ লাখ ৩৪ হাজার। এর মধ্যে ১ কোটি ৭১ লাখ ২১ হাজার নারী এবং ৩ কোটি ৪৬ লাখ ১৩ হাজার পুরুষ। এছাড়া প্রতিবেদনে শহর ও গ্রামকেন্দ্রিক তথ্য বিশ্লেষণের পাশাপাশি বিভাগওয়ারি অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিকের পরিসংখ্যানও তুলে ধরা হয়েছে।

বস্তুত অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করা শ্রমশক্তির কোনো নিয়োগপত্র থাকে না বেশির ভাগ ক্ষেত্রে। ফলে অধিকার লাভের কোনো বৈধ ডকুমেন্ট তাদের থাকে না। বর্তমান পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি বঞ্চনার শিকার হতে হচ্ছে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের এসব শ্রমিকদের।  কাজ হারিয়ে বেকার হয়ে পড়ছে প্রান্তিক এ জনগোষ্ঠীর অধিকাংশ জন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ অবস্থায় সরকার পরিসংখ্যান ব্যুরোসহ বিভিন্ন স্বীকৃত সংস্থার তথ্য কাজে লাগিয়ে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের কল্যাণে বিভাগ অনুযায়ী আলাদা আলাদা ব্যবস্থা নিতে পারে।  সরকারের পাশাপাশি বিত্তবানদেরও এগিয়ে আসতে হবে এ খাতের শ্রমিক, দুস্থ ও নিম্ন আয়ের মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য। অন্যথায় পরিস্থিতি খারাপ হবে এবং সমাজে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।

শ্রমিক নিরাপত্তা ফোরামের (এসএনএফ) নির্বাহী পরিচালক সেকেন্দার আলী মিনা বলেন, অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের ভাগ্যোন্নয়নে সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ যথেষ্ঠ নয়। এ বিষয়ে আরও বেশি পরিকল্পিত কর্মসূচির প্রয়োজন রয়েছে।  পাশাপাশি শ্রমের সাথে সংশিষ্ট অংশীজনদের মত-পথ-কৌশল ভিন্ন হতে পারে কিন্তু মূল লক্ষ্য অর্জনে পরষ্পরের প্রতি আস্থা থাকতে হবে।

তিনি বলেন, করোনাকালীন সময়ে শ্রমিকের সামাজিক সুরক্ষাসহ পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা জরুরি।

শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদ (স্কপ) প্রতিনিধি কামরুল আহসান বলেন, করোনায় সবচেয়ে বেশি সমস্যা পড়েছে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকরা।  লকডাউনে সবকিছু বন্ধ থাকলেও স্বাস্থ্য বিধি মেনে কারখানা খোলা রাখার ঘোষণা দেওয়া হলেও শ্রমিকদের স্বাস্থ্য বিধি মানা বা যাতায়াতের জন্য পরিবহনের ব্যবস্থা করা হয়নি। ক্রাইসিস কমিটির মাধ্যমে শ্রমিকদের সমস্যা সমাধানে সরকারকে উদ্যোগী হওয়া খুব জরুরি।

করোনায় বাংলাদেশের শ্রমিকদের ক্ষতি নিয়ে সম্প্রতি একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট লেবার স্টাডিজ (বিলস) এবং সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি)। প্রতিবেদনে বিশ্বব্যাংক, আইএলও, বিবিএস এবং বিআইডিএসের তথ্য ব্যবহার করা হয়। প্রতিবেদনে শ্রমিকদের তিন স্তরের ঝুঁকির কথা বলা হয়েছে।  এর মধ্যে সুনির্দিষ্ট ৭টি খাতের শ্রমিক কাজ হারানোর উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছেন। খাতগুলো হলো শিল্পপ্রতিষ্ঠানের শ্রমিক, নির্মাণ, পরিবহন, বিক্রয়কর্মী, খাদ্য এবং ব্যক্তিগত সেবাকর্মীরা।  এক্ষেত্রে শহরাঞ্চলের মোট শ্রমশক্তির ৬৯ শতাংশই উচ্চ ঝুঁকিতে।  দেশের মোট অর্থনীতিতে এদের অবদান ৪৯ শতাংশ।  ৫০ শতাংশ প্রতিষ্ঠান তাদের ৭৬ থেকে শতভাগ শ্রমিককে ‘লে-অফ’ দিয়েছে।  মধ্যমানের ঝুঁকিতে আর্থিক খাত, গৃহকর্মী, আবাসন ও শিক্ষা খাতের শ্রমিক।  আর তুলনামূলক কম ঝুঁকিতে কৃষি, স্বাস্থ্য, তথ্য ও যোগাযোগ খাতের শ্রমিকরা।

প্রতিবেদনে বলা হয়, অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিকরা বেশি সমস্যায়। কারণ, সহায়তা পৌঁছানোর জন্য, তাদের তালিকাও সরকারের কাছে নেই।  শহরে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে ১০ লাখ ৮০ হাজার লোক কাজ হারিয়েছে। বেতনভুক্ত ৪৯ শতাংশ শ্রমিকের আয় কমেছে।  সার্বিকভাবে ৩৭ শতাংশ শ্রমিকের মজুরি কমেছে।  এর মধ্যে ৪২ শতাংশ ঢাকায়।  ৩৩ শতাংশ চট্টগ্রামে।  সরকারি প্রতিষ্ঠান বিআইডিএসের রিপোর্ট অনুসারে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের ৬৬ শতাংশ শ্রমিকের আয় কমেছে।

এ ছাড়াও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর রিপোর্ট অনুসারে ২০২০ সালে ২০ শতাংশ পরিবারের আয় কমেছে। সিপিডির তথ্যানুসারে, ২০১৭ সালে দেশে দারিদ্র্যের হার ছিল মোট জনসংখ্যার ২০ শতাংশ। ২০২০ সাল শেষে তা বেড়ে ৩৩ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। অর্থাৎ, করোনায় নতুন করে ১৩ শতাংশ মানুষ দরিদ্র হয়েছে।  সংখ্যার হিসাবে যা এক কোটি ৬৪ লাখ।  এর মধ্যে ৬৩ শতাংশ তাদের বাড়ি ভাড়া দিতে পারছে না।  ৩৯ শতাংশ ইউটিলিটি বিল দিতে অক্ষম। স্কুলের ফি দিতে পারেনি ৩৬ শতাংশ এবং ৫৭ শতাংশ শ্রমিক গ্রামে পরিবারকে টাকা পাঠাতে পারেননি। শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করা সংগঠন বিলসের তথ্যানুসারে শহরের বস্তিতে থাকা ৪৭ শতাংশ এবং মোট শ্রমিকের ৩২ শতাংশ তাদের খাবারের পরিমাণ কমিয়েছেন। এছাড়া শহরের বস্তিবাসীর ৬৭ শতাংশ এবং গ্রামের ৩২ শতাংশ মানুষ তাদের চাহিদা মেটাতে সঞ্চয় ভেঙে খেয়েছেন। ৫৯ শতাংশ নারী উদ্যোক্তা খরচ মেটাতে তাদের সঞ্চয় ভেঙেছেন।

প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, করোনা মোকাবিলায় এ পর্যন্ত এক লাখ ২৬ হাজার ৮৫৩ কোটি টাকার প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়।  এর মধ্যে শ্রমিক, এসএমই উদ্যোক্তা, নিম্ন আয়ের কৃষক, ছোট ব্যবসায়ী, প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, বেকার এবং দরিদ্র শ্রমিকদের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে মাত্র ৪৪ হাজার ৯৭৩ কোটি টাকা, যা মোট বরাদ্দের ৩৫ দশমিক ৪ শতাংশ।  আবার এই খাতগুলোর জন্য বরাদ্দের মধ্যে গত বছরের অক্টোবর পর্যন্ত বিতরণ হয়েছে ২৫ হাজার ৪৫৭ কোটি টাকা, যা মোট বরাদ্দের ৫৬ শতাংশ।  দরিদ্রদের মধ্যে শহরে নগদ সহায়তা পেয়েছেন ২৫ শতাংশ এবং গ্রামে তা ১৮ শতাংশ।  শুধু দেশে নয়, কাজ হারিয়েছেন প্রবাসীরাও। গত বছরের মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চার লাখ বিদেশি শ্রমিক ফেরত এসেছেন।