জাতীয়

বৈধ যে পণ্যটি মৃত্যু ঘটাচ্ছে লাখো মানুষের

তামাক এমন একটি পণ্য, যা আইনগতভাবে বৈধ হলেও মৃত্যু ঘটাচ্ছে লাখ লাখ মানুষের। তামাকের ক্ষতি কেবল ব্যবহারের মধ্যেই সীমিত নয়- চাষ, প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং বিপণন প্রতিটি ধাপই বিপজ্জনক। সবই জনস্বাস্থ্য, পরিবেশ এবং সমাজকে অপূরণীয় দুর্দশার দিকে ঠেলে দেয়।

প্রতিবছর বিশ্বে ৮০ লাখ মানুষ প্রাণ হারায় একটি বিশেষ পণ্য ব্যবহারজনিত রোগে। এরমধ্যে শুধু বাংলাদেশেই বছরে মারা যায় ১ লাখ ২৬ হাজার মানুষ। দেশে এটি ব্যবহারের অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ বছরে ৩০ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা। এই বাস্তবতায় বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও আজ (৩১ মে) পালিত হচ্ছে  বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস।  

সাম্প্রতিক কোভিড-১৯ মহামারিতে ধূমপায়ীদের গুরুতর অসুস্থ হওয়ার ঝুঁকি ৪০–৫০ শতাংশ বেশি বলে জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।  

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, শ্বাসতন্ত্র এবং হৃদরোগের অন্যতম প্রধান কারণ তামাক। তামাক ব্যবহারে করোনারি হার্ট ডিজিজ এবং স্ট্রোক হওয়ার ঝুঁকি ২ থেকে ৪ গুণ বেড়ে যায় এবং মুখ গহ্বর, ফুসফুস, খাদ্যনালীসহ প্রায় ২০ ধরনের ক্যানসার হয়। অধূমপায়ীর তুলনায় ধূমপায়ীর ফুসফুস ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে ২৫ গুণ। এছাড়া দীর্ঘমেয়াদি ফুসফুস সংক্রমণে (সিওপিডি) ধূমপায়ীদের মৃত্যুঝুঁকি অধূমপায়ীদের তুলনায় ১৩ গুণ পর্যন্ত বেশি।  

আবার তামাক ছাড়ার অনেক সুফল রয়েছে। যদি কোন ব্যক্তি টানা ১ বছর তামাকমুক্ত থাকতে পারেন, তবে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি ধূমপায়ীদের তুলনায় অর্ধেক কমে আসে। ধূমপান ছাড়ার দশ বছরের মধ্যে ফুসফুসের ক্যানসারের ঝুঁকি ধূমপায়ীর তুলনায় অর্ধেক কমে যায়৷ এছাড়া ৩০ থেকে ৪০ বছর বয়সের মধ্যে তামাক ছাড়লে তার প্রত্যাশিত আয়ু তামাক ব্যবহারকারীর তুলনায় প্রায় ১০ বছর বেড়ে যায়।

গ্লোবাল অ্যাডাল্ট টোব্যাকো সার্ভে (গ্যাটস), ২০১৭ অনুযায়ী বাংলাদেশে ১৫ বছর তদূর্ধ্ব জনগোষ্ঠির মধ্যে তামাক ব্যবহারের হার ৩৫.৩ শতাংশ (৩ কোটি ৭৮ লাখ)। উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে হতদরিদ্র জনগোষ্ঠির মধ্যে তামাক ব্যবহারের হার ৪৮ শতাংশ, যেখানে অতি উচ্চবিত্ত জনগোষ্ঠির মধ্যে এই হার মাত্র ২৪ শতাংশ।

গ্যাটস ফলাফলে দেখা গেছে, তামাক ব্যবহারের অর্থনৈতিক ক্ষতির (চিকিৎসা ব্যয় এবং উৎপাদনশীলতা হারানো) পরিমাণ বছরে ৩০ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা। বাংলাদেশে হতদরিদ্র জনগোষ্ঠির মধ্যে তামাক ব্যবহারের হার ৪৮ শতাংশ, যেখানে অতি উচ্চবিত্ত জনগোষ্ঠির মধ্যে এই হার মাত্র ২৪ শতাংশ।

গ্যাটস ফলাফলে আরো দেখা গেছে, ২০০৯ সালের তুলনায় একজন বিড়ি ব্যবহারকারীর বিড়ি বাবদ মাসিক খরচ বেড়েছে প্রায় ৫০ শতাংশ। অন্যদিকে, সিগারেট ক্রয় করতে একজন ধূমপায়ীর গড় মাসিক ব্যয় হয় ১০৭৭.৭ টাকা। অথচ শিক্ষা ও চিকিৎসার জন্য একটি পরিবারের মাসিক গড় ব্যয় যথাক্রমে মাত্র ৮৩৫.৭ এবং ৭০০ টাকা (খানা আয়-ব্যয় জরিপ, ২০১৬)। তামাকের জন্য ব্যয়িত অর্থ শিক্ষা ও চিকিৎসা দারিদ্র্য তথা মানবদারিদ্র্য মোকাবেলায় ব্যয় করা গেলে পরিবারগুলোর জীবনমানে উন্নতি ঘটানো সম্ভব।

বাংলাদেশে গৃহস্থালী ব্যয়ের ক্ষেত্রে তামাকের পিছনে ব্যয়ের ক্রাউডিং আউট প্রভাব বিষয়ক গবেষণায় দেখা গেছে, তামাক ব্যবহারকারী পরিবারগুলোকে তামাকমুক্ত পরিবারের তুলনায় শিক্ষা, বস্ত্র, বাসস্থান, জ্বালানি এবং যাতায়াতের চেয়ে চিকিৎসায় অনেক বেশি ব্যয় করতে হয়। টোব্যাকো অ্যান্ড পোভার্টি, টোব্যাকোনোমিক্স পলিসি ব্রিফ, ২০১৮-তে আরো বলা হয়েছে, তামাকের ব্যবহার স্বাস্থ্য ব্যয় বৃদ্ধি, আয় ও উৎপাদনশীলতা  হ্রাস এবং একইসঙ্গে পুষ্টি ও শিক্ষার মতো মৌলিক চাহিদা পূরণের ব্যয় সীমিত করার মাধ্যমে পরিবারগুলোকে ক্রমশ দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর করে ফেলে।

গত কয়েক বছর ধরেই তামাক বিরোধী সংগঠনগুলো তামাক চাষ নিয়ন্ত্রণে জোরদার আন্দোলনে চালিয়ে আসছে।  তবে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর এ বিষয়ে উদ্যোগ এখনো সমন্বিত ও আশানুরূপ নয়। তাই প্রায় তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে দেশের বেশ কয়েকটি জেলায় খাদ্য শস্যের জমিতে তামাক চাষ করা হচ্ছে। ২০০৬-০৭ সালে তামাক উৎপাদন হয় ৭৫,৮৬০ একর জমিতে। ২০০৮-০৯ সালে ৭৩,৮০৮ একর জমিতে। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, তামাক চাষের জমি ক্রমে কমেছে, তবে তা এখনো যথেষ্ট কম নয়। তবে ২০১৪ সাল থেকে আবারো বাড়তে থাকে তামাক চাষ। জানা গেছে, ২০১৪ সালে ৬৮০ হেক্টর, ২০১৫ সালে ৭৬০ হেক্টর, ২০১৬ সালে ৮১০ হেক্টর, ২০১৭ সালে ৮৯০ হেক্টর, ২০১৮ সালে ৯৫০ হেক্টর, ২০১৯ সালে ১ হাজার ২০ হেক্টর জমিতে তামাক চাষ হয়েছে।

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন ধূমপান, তামাক ও ভ্যাপিং পণ্য ব্যবহারে করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি বেড়ে যায়। মানুষের জীবন বাঁচানোর পাশাপাশি জনস্বাস্থ্য সুরক্ষা ও ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ অর্জনের পথ সুগমে তামাকপণ্য নিয়ন্ত্রণ এবং তামাক কোম্পানির সব কারসাজি বন্ধে সরকারকে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

তামাকবিরোধী সংগঠনগুলো বলছে, প্রধানমন্ত্রী ২০৪০ সালের আগেই ‘তামাকমুক্ত বাংলাদেশ’ গড়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করলেও নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে তামাক কোম্পানির ক্রমাগত হস্তক্ষেপ, জটিল ও দুর্বল কর-কাঠামো, তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের দুর্বলতা এবং আইন বাস্তবায়নে শিথিলতা প্রভৃতি কারণে তামাক ব্যবহার হ্রাসে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য পাচ্ছে না বাংলাদেশ। এক্ষেত্রে নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলো এখন থেকেই গ্রহণ করা হলে তামাকের ব্যবহার উল্লেখযোগ্য মাত্রায় কমবে, তামাকজনিত অসুস্থতা ও মৃত্যু হ্রাস পাবে এবং একইসাথে তা ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ অর্জনে ভূমিকা রাখবে।

এক্ষেত্রে তামাকবিরোধী সংগঠন প্রজ্ঞা (প্রগতির জন্য জ্ঞান) দুটি সুনির্দিষ্ট দাবি জানানো হয়েছে। কর ও মূল্য পদক্ষেপ গ্রহণ এবং তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন। প্রথম দাবির অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে- সুনির্দিষ্ট করারোপের মাধ্যমে সিগারেটসহ সকল তামাকপণ্যের দাম বৃদ্ধি করে জনগণের বিশেষ করে তরুণ ও দরিদ্র মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে নিয়ে যাওয়া, মধ্যমেয়াদে (২০২১-২২ থেকে ২০২৫-২৬) সিগারেটের ব্রান্ডসমূহের মধ্যে দাম ও করহারের ব্যবধান কমিয়ে মূল্যস্তরের সংখ্যা ৪টি থেকে ২টিতে নামিয়ে আনা এবং একটি সহজ এবং কার্যকর তামাক কর নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন (৫ বছর মেয়াদি) করা, যা তামাকের ব্যবহার হ্রাস এবং রাজস্ব বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখবে। দ্বিতীয় দাবির অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে- ‘ধূমপানের জন্য নির্ধারিত স্থান’ বিলুপ্তসহ সকল পাবলিক প্লেস, কর্মক্ষেত্র ও পাবলিক পরিবহনে ধূমপান নিষিদ্ধ করার মাধ্যমে শতভাগ ধূমপানমুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করা, বিক্রয়স্থলে তামাকজাত দ্রব্য প্রদর্শন নিষিদ্ধ করা, তামাক কোম্পানির ‘সামাজিক দায়বদ্ধতা কর্মসূচি’ বা সিএসআর কার্যক্রম সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা, বিড়ি-সিগারেটের খুচরা শলাকা এবং প্যাকেটবিহীন জর্দা-গুল বিক্রয় নিষিদ্ধ করা, ই-সিগারেট এবং হিটেড টোব্যাকো প্রোডাক্টস (এইচটিপি) এর মতো ইমার্জিং টোব্যাকো প্রোডাক্টসমূহ আমদানি ও বিক্রয় নিষিদ্ধ করা এবং সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবার্তার আকার বৃদ্ধিসহ তামাকপণ্য মোড়কজাতকরণে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ।

প্রজ্ঞার (প্রগতির জন্য জ্ঞান) নির্বাহী পরিচালক এবিএম জুবায়ের বলেন, দরিদ্র জনগোষ্ঠী পণ্যের দামবৃদ্ধির প্রতি অধিক সংবেদনশীল। তামাকপণ্যের দাম বাড়লে দরিদ্র জনগোষ্ঠির মধ্যে তামাকের ব্যবহার, তামাকজনিত মৃত্যু ও অন্যান্য ক্ষয়ক্ষতি অধিকহারে হ্রাস পায়। তাই তামাকে বর্ধিত করারোপ একটি দরিদ্র-বান্ধব পদক্ষেপ।