চলতি বছরের জানুয়ারির শুরু থেকে হু হু করে বাড়ছে করোনা সংক্রমণ। এই ঊর্ধ্বমুখী সংক্রমণ ঠেকাতে সরকার ১১ দফা বিধিনিষেধ দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। প্রথমে বাস’সহ সবধরনের গণপরিবহনে ভাড়া না বাড়িয়ে অর্ধেক যাত্রী বহনের কথা বলা হলেও পরে পরিবহন মালিক সমিতির নেতাদের দাবির মুখে ‘যত আসন তত যাত্রী’ বহনের বিষয়টি মেনে নেয় বিআরটিএ কর্তৃপক্ষ।
মালিক সমিতির নেতাদের দাবি মানা হলেও রাজধানীর বাসগুলোতে স্বাস্থ্যবিধির সেই নিয়ম মানা তো হচ্ছেই না, বরং অন্য সময়ের মতোই গাদাগাদি করেই চলাচল করছেন যাত্রীরা। তবে বাড়তি ভাড়া নিচ্ছে, এমন অভিযোগ পাওয়া যায়নি কোন যাত্রীর কাছে।
মঙ্গলবার (১৮ জানুয়ারি) সকালে রাজধানীর আজিমপুর, নিউমার্কেট, শাহবাগ, ফার্মগেট এলাকা ঘুরে দেখা গেছে- বাসের সব আসন পূর্ণ থাকার পরও দাঁড়িয়ে যাত্রীরা যাচ্ছেন গন্তব্যে। আবার কোনও কোনও বাসে দরজায় ঝুলেও যাত্রীদের চলাচল করতে দেখা গেছে। সরকারি নির্দেশনা মোতাবেক হ্যান্ড স্যানিটাইজার দেখা যায়নি অধিকাংশ পরিবহনেই।
গণপরিবহনগুলোতে যে স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে না তার প্রমাণ মিলছে বিআরটিএ ভ্রাম্যমাণ আদালতের কাছেও। সোমবার (১৭ জানুয়ারি) রাজধানীর মহাখালী এলাকায় অভিযান চালিয়ে বাসে হ্যান্ড স্যানিটাইজার না থাকা ও যাত্রীদের মাস্ক না পরায় বেশ কিছু যাত্রী-পরিবহনকে জরিমানা করা হয়েছে।
একই ঘটনা ঘটেছে আজও। রাজধানীর কাকরাইলে দুপুর পর্যন্ত অভিযান চালিয়ে পৃথক ২৬টি মামলায় ১৭ হাজার টাকা জরিমানা করেছে বিআরটিএ’র নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ইয়াসমিন মনিরা।
এদিকে দেশে গত কয়েকদিনে করোনার নতুন ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রন সংক্রমণ ১৮ শতাংশ বেড়েছে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক। সোমবার তিনি বলেন, ‘এভাবে সংক্রমণ বাড়তে থাকলে আগামী এক থেকে দেড় মাসের মধ্যে হাসপাতালে করোনা রোগীদের জায়গা হবে না।’ এই সংক্রমণ নিয়ে সরকার চিন্তিত ও আতঙ্কিত বলেও জানান মন্ত্রী।
অপরদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় করোনা শনাক্ত হয়েছে ৬ হাজার ৬৭৬ জনের এবং মারা গেছেন ১০ জন। এ নিয়ে এখন পর্যন্ত মারা গেলেন ২৮ হাজার ১৫৪ জন এবং শনাক্ত হলেন ১৬ লাখ ২৪ হাজার ৩৮৭ জন। এ সময়ে করোনা শনাক্তের হার ২০ দশমিক ৮৮ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
এমন পরিস্থিতিতেও সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে নেই তেমন সচেতনতা। দেখা যাচ্ছে, গণপরিবহনে স্বাস্থ্যবিধি একপ্রকার গায়েব। যাত্রীদের অধিকাংশই মাস্ক পরছেন না। যারা পরছেন তারাও ঠিকঠাক পরছেন না। এ বিষয়ে সোমবার স্বাস্থ্যমন্ত্রী সতর্ক করে সবাইকে মাস্ক পরার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, ‘সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে। ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের পুরো সময়েও সংক্রমণ এত দ্রুতগতিতে বাড়েনি যতটা ওমিক্রনের কারণে বর্তমানে বাড়ছে। মানুষ যেভাবে বেপরোয়া চলাচল করছে, এটা বাড়তেই থাকবে।’
সরকারের ১১ দফা বিধিনিষেধ জারির পর স্বাস্থ্যবিধি মেনে ‘যত আসন, তত যাত্রী’ পরিবহনের জন্য অনুরোধ জানিয়েছিল বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি। পরে সমিতির নেতারা জানান, তাদের অনুরোধের প্রেক্ষিতে বিআরটিএ মৌখিকভাবে তাদেরকে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত এ নিয়ে কোনো গেজেট প্রকাশিত হয়নি।
সকালে আজিমপুর বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে দেখা গেছে, এখান থেকে ছেড়ে যাওয়া ভিআইপি এবং বিকাশ পরিবহনের প্রতিটি বাস আসনভর্তি হওয়ার পরেও দাঁড়িয়ে যাত্রী নিচ্ছে। নারায়ণগঞ্জ থেকে আজিমপুর হয়ে চলাচলকারী বাস মৌমিতাতেও একই অবস্থা দেখা গেছে।
অধিক যাত্রী নেওয়া, স্বাস্থ্যবিধি না মানা, সেনিটাইজার ব্যবহার না করাসহ সরকারি নিয়ম ভাঙার কারণ হিসেবে একে-অপরকে দোষারোপ করছেন যাত্রী এবং পরিবহন শ্রমিকরা। সাভার পরিবহনের চালকের সহকারী মিজান রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘প্রতিটি স্টপেজে অনেক মানুষ বাসের জন্য দাঁড়িয়ে থাকে। এদের না নিতে চাইলেও জোর করে বাসে উঠে যান। বাধা দিলেও শোনেন না। আমাদের কিছুই করার থাকে না।’
কিন্তু যাত্রীরা বলছেন ভিন্ন কথা। সাভারের যাত্রী ইকরাম বলেন, ‘গাড়িতে সিটের পরিমাণ যাত্রী ওঠার পরও বিভিন্ন স্টপেজে গাড়ি থামিয়ে ওরা যাত্রী তোলে। এমনকি দাঁড়িয়েও যাত্রী নেয়। আমরা বাস শ্রমিকদের কাছে জিম্মি হয়ে আছি।’
নিউমার্কেটের সামনে অপেক্ষমাণ যাত্রী রশিদুন নবী যাবেন তেজগাঁও নাবিস্কোতে। তিনি বলেন, ‘তেজগাঁও রুটে একটাই বাস চলে, উইনার ট্রান্সপোর্ট। যাত্রীর তুলনায় বাসের সংখ্যা কম বলে বেশিরভাগ সময় দাঁড়িয়ে যেতে হয়। এছাড়া কিছুই করার নেই।’
আরেক যাত্রী দিদার হোসেন। যাবেন সাভারের হেমায়েতপুর এলাকায়। বললেন, ‘প্রায় ৩০ মিনিট ধরে দাঁড়িয়ে আছি। সবগুলো বাস ভরে আসছে। তাই বাধ্য হয়ে বেশিরভাগ দিন দাঁড়িয়ে যাই। এতটা রাস্তা দাঁড়িয়ে যেতে কষ্ট হয়, কিন্তু কী করবো? আমরা যারা যাচ্ছি, তারা অসহায়। চাইলেও স্বাস্থ্যবিধি মানা সম্ভব হয় না।’