জাতীয়

ভিন্ন আঙ্গিকে প্রাণের বইমেলার বিদায়

সাধারণত প্রতিবছর অমর একুশে বইমেলা হয় ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে। কিন্তু এবারের বইমেলা ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি শুরু হয়ে শেষ হয় চলতি মাসের ১৭ মার্চ। আর মার্চ মাসের এইদিনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন। এ কারণে ভিন্ন আঙ্গিকে পাঠকদের থেকে বিদায় নিয়েছে প্রাণের বইমেলা-২০২২। এদিন সন্ধ্যায় ১০২টি কেক কেটে মেলা প্রাঙ্গণে বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন পালিত হয়। এসময় হাজারো দর্শনার্থী জন্মদিন উদযাপন এবং মেলার সমাপনী অনুষ্ঠান উপভোগ করেন।

ক‌রোনা সংক্রমণের কার‌ণে এবারের বইমেলা নিয়ে শুরুতেই ছিল দোটানা। বইমেলা হবে কী হবে না, হ‌লে ফেব্রুয়ারিতে না মা‌র্চে; এসব নিয়ে প্রকাশক, লেখক, পাঠক ও আয়োজকদের মধ্যে ছিল অনিশ্চয়তা। এসবেই মধ্যেই কেটে যায় অনেকগুলো দিন। শেষ পর্যন্ত ধী‌রে ধী‌রে ক‌রোনা সংক্রমণ কম‌তে থাক‌লে সিদ্ধান্ত হয়, ১৫ ফেব্রুয়া‌রি বইমেলা শুরু হয়ে চলবে ২৮ তারিখ পর্যন্ত। ‌সে রকম প্রস্তুতি নি‌য়েই প্রকাশকরা শুরু ক‌রেন ১৪ দি‌নের বইমেলা। এরপর বইমেলা ভার্চুয়া‌লি উদ্বোধন ক‌রেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হা‌সিনা।

উদ্বোধনকা‌লে প্রধানমন্ত্রীকে প্রকাশক‌দের পক্ষ থে‌কে অনু‌রোধ জানা‌নো হয়, মেলার মেয়াদ ১৭ মার্চ পর্যন্ত করার জন্য। তাৎক্ষণিক সম্মতি না দি‌লেও প্রধানমন্ত্রী প্রকাশক‌দের আশ্বাস দি‌য়ে ব‌লেন, ‘ক‌রোনা সংক্রমণ না বাড়‌লে মেলা ১৭ মার্চ পর্যন্ত চল‌বে।’ এরপর বেলা তিনটা থে‌কে রাত নয়টা পর্যন্ত মেলার সময় নির্ধারণ করা হয়। আর ছু‌টির দি‌নে সকাল এগা‌রোটা থে‌কে রাত নয়টা।

পাঠক-দর্শনার্থীতে পরিপূর্ণ মেলা প্রাঙ্গণ। ছবি: রাইজিংবিডি

উদ্বোধ‌নের প্রথম দিন থে‌কেই মেলা পাঠক, দর্শনার্থীতে ছিল পরিপূর্ণ। আক্ষরিক অর্থে প্রথম দিন থে‌কেই মেলায় বেচাবি‌ক্রি শুরু হয় ব‌লে জানান প্রকাশকরা। এরপর থে‌কে দিনে দিনে ক্রেতা-দর্শনার্থীর সংখ্যা বাড়ার পাশাপা‌শি বাড়‌তে থা‌কে বেচাবি‌ক্রি। প্রকাশক‌দের মু‌খেও হা‌সি ফো‌টে।

প্রকাশকদের দেওয়া তথ্যের বরাত দিয়ে বাংলা একাডেমি জানিয়েছে, এবারের মেলায় নতুন বই প্রকাশিত হয়েছে ৩ হাজার ৪১৬টি। এর মধ্যে উপন্যাস ৮৯০টি, গল্প ও গল্প সংকলন ৬১০, কবিতার বই ১ হাজার ২০০, প্রবন্ধ ৪০, শিশুতোষ ১১০, সায়েন্স ফিকশন ২৫০, ভ্রমণ ৩৫ এবং অন্যান্য ২৮১টি।

২০২০ সালে সমগ্র মেলায় প্রায় ৮২ কোটি টাকার বই বিক্রি হয়েছিল। এবার ১৬ মার্চ পর্যন্ত স্টল মালিকদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য এবং ১৭ মার্চের সম্ভাব্য বিক্রি যুক্ত করে বলা যায়, এবার বইমেলায় ৫২ কোটি ৫০ লাখ টাকার বই বিক্রি হয়েছে।

মেলা প্রসঙ্গে অন্য প্রকাশের কর্ণধার মাজহারুল ইসলাম বলেন, এবারের মেলায় যা বিক্রি হয়েছে, তা একজন প্রকাশক হিসেবে আমি খুশি। কারণ গত বছর প্রচুর টাকা লগ্নী করার পর মেলার যে অবস্থা গেছে, তাতে আমার মতো অনেকের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। এবছর খানিকটা পুষিয়ে নিয়েছি।

সময় প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী ফরিদ আহমেদ বলেন, মেলা পরিচালনার দু’চারটি বিষয় বাদ দিলে মোটের ওপর এবারের অবস্থা ভালোই বলা যায়। অনেক বই যেমন প্রকাশিত হয়েছে, তেমনি বেচাবিক্রিও মোটামুটি ভালো হয়েছে। তবে প্রতিদিন মেলা প্রাঙ্গণে পানি ছিটালে পাঠক-লেখক-বিক্রয়কর্মী-দর্শনার্থীদের ধুলোয় কষ্ট হতো না। 

ভাষাচিত্রের স্বত্বাধিকারী খন্দকার মনিরুল ইসলাম সোহেল বলেন, এবারের বইমেলা যে প্রত্যাশা নিয়ে শুরু করেছিলাম, তার অনেকটাই পূরণ হয়েছে। পাঠক-ক্রেতা-লেখকরা মেলায় আসতে পেরেছেন। পছন্দের বই কিনেছেন। মেলার পরেও আশা করছি যেসব পাঠক আসতে পারেননি, তারা অনলাইন শপের মাধ্যমে তাদের পছন্দের বইগুলো সংগ্রহ করবেন।

শিশু চত্বর। ছবি: রাইজিংবিডি

মেলায় আসা কয়েকজন পাঠক-দর্শনার্থী বলেন, বইমেলার অপর নাম প্রাণের মেলা। গত দুই বছরের তুলনায় এবারের মেলায় প্রাণ ছিল। পাঠক, লেখক, প্রকাশক সবাই মোটামুটি খুশি। গত বছরগুলোর প্রকাশকদের আর্থিক ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারবেন এবার। মেলার পরে প্রকাশকদের উদ্যোগে সারা বছরব্যাপী অনলাইনেও বই বিপণনের ব্যবস্থা করতে হবে। 

লেখক, সাংবাদিক গিয়াস আহমেদ বলেন, ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি শুরু হলেও এবারের মেলা আয়োজন সফল বলেই আমার ধারনা। মেলার সময়সীমাটা ভালো ছিল। বিশেষ করে রাত নয়টা পর্যন্ত খোলা থাকাতে অনেক পাঠক অফিস শেষে মেলায় এসে পছন্দের বই কিনতে পেরেছেন। গত দুই বছরে প্রকাশনা শিল্পের অর্থনীতিতে যে বিশাল নেতিবাচক প্রভাব পড়েছিল, এবার সেটা অনেকটাই কাটিয়ে উঠতে পারবেন বলে মনে করি।

এবার বাংলা একাডেমি ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যান মিলে ৫৩৮টি প্রতিষ্ঠানকে ৭৯৫ ইউনিটের স্টল বরাদ্দ দেওয়া হয়। বাংলা একাডেমিসহ ৩৫টি প্রতিষ্ঠান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্যাভিলিয়ন বরাদ্দ পায়। এবার এক ইউনিটের ৩১০টি, দুই ইউনিটের ১২১টি, তিন ইউনিটের ৪৫টি এবং চার ইউনিটের ২৭টি স্টল বরাদ্দ দেওয়া হয়। শিশুদের জন্য ৬০টি প্রতিষ্ঠান ৯২টি ইউনিটের স্টল বরাদ্দ পায়।

এবার লিটিলম্যাগ চত্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের কেন্দ্রীয় চত্বরে নেওয়া হয়। এবার ১০৭টি লিটল ম্যাগাজিনকে স্টল দেওয়া হয়। লিটলম্যাগ চত্বর এবার কেবল ভালো স্থানে, উন্মুক্ত পরিসরে হয়নি, এই চত্বরে প্রবেশের জন্য প্রসারিত ও খোলা পথ থাকায় বিশেষভাবে আকর্ষণীয়ও ছিল। এখানে দেশের তরুণ ও সম্ভাবনাময় সাহিত্যকর্মীরা প্রকাশিত ম্যাগাজিন বিক্রয় এবং তাদের প্রতিভা-সৃষ্টিশীলতা প্রদর্শনের সুযোগ পেয়েছেন।

১০২টি কেক কেটে বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন উদযাপন। ছবি: রাইজিংবিডি

মেলার শেষ দিনে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জাতীর জনক বঙ্গবন্ধুর ১০২তম জন্মদিন ১০২টি কেক কেটে পালন করা হয়। এরপর বঙ্গবন্ধুর জন্ম থেকে তার রাজনৈতিক জীবন, ১৯৫২ ভাষা আন্দোলন; ’৬৯ এর গণ অভ্যুত্থান, ’৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধসহ বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরা হয় লেজার শো’র মাধ্যমে। এসময় মেলার মাঠে কয়েক হাজার দর্শনার্থী বঙ্গবন্ধুর ১০২তম জন্মদিন উদযাপন এবং বইমেলার সমাপনী অনুষ্ঠান উপভোগ করেন। 

এসময় অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ, বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি নূরুল হুদা, বইমেলা কমিটির সদস্য সচিব ড. জালাল আহমেদ এবং প্রকাশনা শিল্পের সঙ্গে জড়িত দুটি সংগঠনের নেতারা।