জাতীয়

পঙ্গু হাসপাতালে ভ‌র্তি বেশিরভাগই বাইক দুর্ঘটনার শিকার

ঈদের ছু‌টি‌তে খা‌লি রাস্তায় তরুণ‌দের বেপ‌রোয়া মোটরসাইকেল চালা‌নো কার‌ণে বেড়েছে দুর্ঘটনা। রোগীতে ভ‌রে আছে রাজধানীর পঙ্গু হাসপাতাল। সড়ক দুর্ঘটনার গত ৬ দিনে রাজধানীর পঙ্গু হাসপাতালে এক হাজার ২৫০ জনেরও বেশি রোগী ভর্তি হয়েছেন।

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এই সময়ে হাসপাতালে আসা রোগীদের মধ্যে ৩০ শতাংশেরও বে‌শি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার শিকার। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় আহত এসব মানুষ‌দের অনেকেরই হাত-পা কেটে ফেলতে হয়েছে।

সোমবার (৯ মে) স‌রেজ‌মিন পঙ্গু হাসপাতা‌লে গি‌য়ে চিকিৎসকদের স‌ঙ্গে কথা ব‌লে জানা গে‌ছে, এক হাজার শয্যার ম‌ধ্যে কোনোটিই খালি নেই। পুরো হাসপাতালই রোগীতে ভরা। জরু‌রি বিভা‌গের কো‌নো সিট খা‌লি নেই। এমনকি, অনেক রোগী‌কে শয্যা না পেয়ে বাধ্য হয়ে হাসপাতা‌লের মেঝেতে বিছানা বি‌ছি‌য়ে চিকিৎসাসেবা নিতে দেখা গে‌ছে।

দা‌য়িত্বরত চি‌কিৎসক মাহবুব হো‌সেন জানান, হাসপাতালে আসা রোগী‌দের বড় একটা অংশ মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় আহত। এরপর বে‌শি আহত রোগী এসেছেন সিএনজিচালিত অটোরিকশা দুর্ঘটনায়। মোটরসাইকেল ও সিএন‌জিচা‌লিত অটোরিকশার তুলনায় এবার ঈদের সময় বাস ও ট্রাক দুর্ঘটনায় আহত হ‌য়ে হাসপাতালে আসা রোগী তুলনামূলক কম। বাইক দুর্ঘটনায় যারা আহত হ‌য়ে‌ছেন, তা‌দের অধিকাংশই তরুণ এবং এদের আঘাত গুরুতর ব‌লে জা‌নি‌য়ে‌ছেন দা‌য়িত্বরত এই চি‌কিৎসক।

ডা. মাহবুব জানান, স্বাভাবিক সময়ে হাসপাতালে দৈনিক দেড়শর মতো রোগী এলেও ঈদের সময় এসেছে ২০০ থেকে ২৫০ জন।

হাসপাতাল সূত্রে জানা গে‌ছে, গত ২ মে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে ১৯৭ জন পঙ্গু হাসপাতালে এসেছেন। তাদের মধ্যে সংকটাপন্ন অবস্থায় ৬৫ জনের অস্ত্রোপচার করে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। বাকি ১৩২ জনকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে বাসায় পাঠানো হয়। এরপর ৩ মে (ঈদের দিন) ১৭৯ জন হাসপাতালে আসেন, তাদের মধ্যে ৮২ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়। ৪ মে দুর্ঘটনায় আহত হয়ে ২৫২ জন হাসপাতালে আসেন। তাদের মধ্যে গুরুতর আহত ৮৫ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে ছেড়ে দেওয়া হয় ১৬৭ জনকে।

এরপর গত ৫ মে ২৩৬ জন হাসপাতালে আসেন, তাদের মধ্যে ১০৮ জনকে অস্ত্রোপচার শেষে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। বাকি ১২৮ জনকে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে ছেড়ে দেওয়া হয়। ৬ মে সড়ক দুর্ঘটনার শিকার আরো ১৮৩ জন হাসপাতালে আসেন। তাদের মধ্যে ৬৪ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। 

এ ছাড়া গত রোববার (৮ মে) নতুন করে আরো ২০৩ জন হাসপাতালে আসেন। তাদের মধ্যে ৮৯ জনকে অস্ত্রোপচার শেষে ভর্তি করা হয়। বাকি ১১৪ জনকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে বাসায় পাঠানো হয়।

মানিকগঞ্জের সাটু‌রিয়ায় বাইক দুর্ঘটনার শিকার মিনহাজ চিকিৎসা নিতে পঙ্গু হাসপাতালে এসেছেন তার ভাইকে সা‌থে ক‌রে। তার ভাই সোহাগ জানান, ঈদের পরদিন ক‌য়েকজন বন্ধু মিলে এলাকায় মোটরসাইকেলে ঘুরতে বের হন। সবার সামনে থাকা মোটরসাইকেলের যাত্রী ছিল তার ভাই মিলন। দুর্ঘটনায় পড়ে তার একটি পা কেটে ফেলতে হয়েছে। তার আরেক বন্ধুর অবস্থাও আশঙ্কাজনক ব‌লে জানান সোহাগ।

জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম জানান, ঈদের দিন ও তার পরবর্তী ক‌য়েক‌দি‌নে দুর্ঘটনায় আহত হ‌য়ে হাসপাতালে রেকর্ড সংখ্যক রোগী এসেছেন। তাদের প্রায় অর্ধেক রোগীকেই ছোট-বড় অস্ত্রোপচার করতে হয়েছে। এখন পর্যন্ত হাসপাতালে আসা রোগীদের ম‌ধ্যে তরুণ‌দের সংখ্যাই বে‌শি। এদের প্রায় সবাই ঈদের সময় রাস্তা ফাঁকা পে‌য়ে বেপ‌রোয়া গ‌তি‌তে বাইক চা‌লি‌য়ে দুর্ঘটনায় প‌ড়ে‌ছে।

তি‌নি জানান, এসব তরুণ-যুবক‌দের অনেকেরই হাত বা পা কে‌টে ফেল‌তে হ‌য়ে‌ছে। এটি খুবই দুঃখজনক। অনেকের মাথা ফে‌টে গভীর ক্ষত হ‌য়ে‌ছে। এদের মাথায় ৫ থে‌কে ১০টি পর্যন্ত সেলাই দি‌তে হ‌য়ে‌ছে।  

এদি‌কে, হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগী এবং তা‌দের স্বজন‌দের অভি‌যো‌গের শেষ নেই। মো. ইমরান নামের এক ভ‌র্তি রোগী জানান, মোটরসাইকেলে ঈদের দিন তিনি একটা ছোট ছে‌লে‌কে রক্ষা কর‌তে গি‌য়ে রাস্তার বাইরে ছিট‌কে প‌ড়েন। বাম পা ও বাম হা‌তে মারাত্মক চোট নি‌য়ে তিনি ঈদের দিন রা‌তে নারায়ণগঞ্জ থে‌কে স্বজনদের সঙ্গে এসে এখা‌নে ভ‌র্তি হন। 

ইমরান বলেন, এখন পর্যন্ত কোনো সিট না পেয়ে হাত আর পা‌য়ে ব্যান্ডেজ নি‌য়ে মেঝেতে শুয়েই চিকিৎসা নিতে হচ্ছে। চিকিৎসকরা ব‌লে‌ছেন, আরো ১২-১৫ দিনের মতো এখা‌নে থেকে চিকিৎসা নিতে হবে। ক‌বে সিট পা‌বো জা‌নি না। দালাল ধর‌লে না‌কি সিট পাওয়া যা‌বে। দালাল পা‌বো কোথায়?

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হাসপাতালের জরুরি বিভাগের এক কর্মচারী জানান, ঈদের এক‌দিন পর থে‌কেই রোগীর চাপ সামলাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। হাসপাতালে আসা একের পর এক রোগীকে সেবা দিতে গিয়ে তারা ঠিকম‌তো খাওয়া ও বিশ্রামেরও সুযোগও পা‌চ্ছেন না। সব বেড রোগী‌তে ভরা। মে‌ঝে‌তেও রোগী র‌য়ে‌ছে। ত‌বে কিছু স্পেশাল সিট আছে, যেগুলো ‌পে‌তে হ‌লে ‘ওপ‌রে লাইন’ থাক‌তে হ‌বে ব‌লে জানান তি‌নি। 

হাসপাতালের জরুরি বিভাগের ইনচার্জ ও সিনিয়র স্টাফ নার্স রহিমা আক্তার বলেন, স্বাভাবিক সময়ে হাসপাতালটিতে দৈনিক দেড়শ জনের মতো রোগী আসলেও ঈদের সময় রোগীর সংখ্যা পৌঁছে গে‌ছে ২০০-২৫০ জনে। ঈদে অনেক স্বাস্থ্যকর্মীর ছুটির কারণে বাকি যারা আছেন, তা‌দের ওপর অনেক চাপ পড়‌ছে। সবদিক সামলা‌তে হ‌চ্ছে। ফ‌লে সব রোগী‌কে ইচ্ছে থাক‌লেও সমান সেবা দি‌তে পার‌ছি না। 

প্রতি ঈদেই হাসপাতা‌লে ডিউটি‌তে থাকা সবার কা‌জের চাপ বে‌ড়ে যায়। বা‌জে অবস্থার মু‌খোমু‌খি হ‌তে হয় এসময়। তবে অন্য বারের তুলনায় এবার দুর্ঘটনায় আসা রোগীর সংখ্যা অনেক বেশি। এদের বে‌শিরভাগই আবার বাইক এক্সিডেন্ট ক‌রে এসেছে ব‌লে জানান হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. আবদুল গণি মোল্লাহ।

তিনি বলেন, রোগী যতই আসুক; অনেক কষ্ট হ‌লেও আমরা পরিস্থিতি ম্যানেজ করার চেষ্টা ক‌রি। সবাইকে সাধ্যম‌তো চি‌কিৎসাসেবা ‌দেওয়ার চেষ্টা ক‌রি। আমা‌দের এখা‌নে দুর্ঘটনায় হাত-পা ভাঙা যেসব রোগী আসেন; তা‌দের তো আর ফেরত দিতে পারি না। হাসপাতা‌লের সব স্বাস্থ্যকর্মীরা নির্ধারিত সময়ের বাইরেও রোগী‌দের সেবা দিচ্ছেন। সিনিয়র চিকিৎসকরাও নিয়‌মিত রোগী‌দের খোঁজখবর নিচ্ছেন। তারপরও সকল‌কে খু‌শি করা আস‌লে সম্ভব না।

প‌রিচালক আরো ব‌লেন, ঈদ ও ঈদ পরবর্তী সময়ে হাসপাতালে রেকর্ড সংখ্যক রোগী এসেছে। তাদের প্রায় অর্ধেক রোগীকেই ছোট-বড় অস্ত্রোপচার করতে হয়েছে। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনাই আহত এসব রোগী‌দের জরুরি ওয়ার্ডে জায়গা না হওয়ায়, অনেককে বারান্দায় রে‌খেও চি‌কিৎসা দেওয়া হ‌চ্ছে। এ ছাড়া কো‌নো উপায়ও নেই আমা‌দের।

সড়কে মোটরসাইকেলসহ অন্যান্য যানবাহন চলাচলের নিয়ম না মানা এবং তরুণ‌দের বেপরোয়া গ‌তি‌তে বাইক চালা‌নোর কারণেই এত দুর্ঘটনা ঘটছে বলে অভিমত ব্যক্ত করেন এই চিকিৎসক।