জাতীয়

ফের ভয়াবহ হচ্ছে করোনা সংক্রমণ?

দেশে দীর্ঘদিন করোনার সংক্রমণের হার নিয়ন্ত্রণে থাকলেও গত দুই সপ্তাহ ধরে ফের বাড়ছে সংক্রমণের হার। এক সপ্তাহের ব্যবধানে শনাক্তের হার বেড়েছে ৩৮৩ শতাংশ।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনার চতুর্থ ঢেউ এটি। এসময় সংক্রমণ দ্রুত গতিতে বাড়বে। তাই সবাইকে সচেতন হওয়ার পাশাপাশি সরকারের তরফ থেকে মাস্ক পরা, স্বাস্থ্যবিধি মানা, জনসমাগম নিয়ন্ত্রণে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য মতে, আগের সপ্তাহের তুলনায় চলতি মাসের ৬ থেকে ১২ তারিখ পর্যন্ত শনাক্তের হার বেড়েছে ১১৮ দশমিক ১ শতাংশ। আর গত ১৩ থেকে ১৯ জুন সংক্রমণের হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৮৩ শতাংশ।

অধিদপ্তরের হিসাব বলছে, গত ২৩ থেকে ২৯ মে দেশে করোনা শনাক্ত নিম্নমুখী ছিল। সে সপ্তাহে মাত্র ২১৪ জনের করোনা শনাক্ত হয়। এর পরের সপ্তাহে সংক্রমণ আরো কমে আসে। ৩০ মে থেকে ৫ জুন ২১০ জন করোনায় আক্রান্ত হন। এর পরের সপ্তাহ থেকেই করোনা সংক্রমণ দ্রুত বাড়তে থাকে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেব অনুযায়ী, করোনা সংক্রমণের হার ৫ শতাংশের নিচে নেমে এলে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে বলা যায়। অন্যদিকে সংক্রমণের হার পাঁচের নিচ থেকে ওপরের দিকে উঠতে থাকলে তাকে ‘পরবর্তী ঢেউ’ আঘাত হেনেছে ধরা হয়। সেই হিসেবে গত ২১ জুন দেশে শনাক্তের হার ছিল ১৩ দশমিক ৩০ শতাংশ।

সাম্প্রতিক করোনা সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতির বিষয়ে আইইডিসিআর’র উপদেষ্টা ও সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, ‘সংক্রমণের হার দেখে বোঝা যাচ্ছে, করোনা সংক্রমণ এখন নতুন ঘরে প্রবেশ করেছে। তবে আশা করছি, সংক্রমণ এখনো কমিউনিটি ট্রান্সমিশন পর্যায়ে যায়নি। মূলত ঢাকা শহরকে ঘিরেই সংক্রমণের হার বাড়ছে। তবে এভাবে বাড়তে থাকলে, সারা দেশে এটি ছড়িয়ে পড়বে। সতর্ক না হলে হয়তো কিছুদিনের মধ্যেই কমিউনিটি ট্রান্সমিশন পর্যায়ে যাবে।’

করোনা সংক্রমণ বাড়লেই নতুন ভ্যারিয়েন্টের অস্তিত্ব জানা যায়। বর্তমানেও তেমন কিছু হয়েছে কি না— জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম বলেন, ‘নতুন ভ্যারিয়েন্টের আবির্ভাব না হলেও বিএ- ৪, বিএ- ৫ নামের দুটি উপ-ভ্যারিয়েন্ট মিলে এখন সংক্রমণ ছড়াচ্ছে। উত্তর কোরিয়া, ভারত, ইউরোপে ওমিক্রনের পর যে ঢেউটা এসেছে, সেটি ওমিক্রনেরই সাব-ভ্যারিয়েন্ট। যা ওমিক্রনের মূল ভ্যারিয়েন্টের চেয়ে আরো দ্রুত গতিতে ছড়ায়। আশঙ্কা করছি, আমাদের দেশেও বর্তমানে এমনটিই হচ্ছে। জিনোম সিকোয়েন্স করলেই বিষয়টি জানা যাবে।’

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. ফরহাদ মনজুর বলেন, ‘শনাক্তের হার প্রায় ১৩ তে উঠেছে- এটা যেমন ঠিক তেমনি আমাদের প্রতিদিন নমুনা পরীক্ষাও হচ্ছে কম। এই কম সংখ্যক নমুনা পরীক্ষা দিয়ে এখুনি শনাক্তের হার বিবেচনা করা ঠিক হবে না। যখন প্রতিদিন আমরা হাজার বিশেক নমুনা পরীক্ষা করতে পারবো, তখন যে পরিমাণে শনাক্তের হার হবে, সেটিই হবে আসল হার। বর্তমানের শনাক্তের হার দিয়ে সামগ্রিক চিত্র বোঝা যাবে না।’

অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, ‘বর্তমানে সংক্রমণের যে ঊর্ধ্বগতি তাতে মনে হচ্ছে, ঈদুল আজহার পর সংক্রমণ চূড়ায় উঠতে পারে। এসময় লাখ লাখ মানুষ শহর ছেড়ে গ্রামে যাবে। স্বাস্থ্যবিধির তোয়াক্কা করবে না কেউ। তবে ঈদের পর সংক্রমণ বাড়লেও আশা করছি খুব দ্রুত তা নেমেও যাবে। সম্ভবত আগামী দুই সপ্তাহ এভাবে সংক্রমণ বেড়ে তারপর কিছুদিন স্থিতিশীল থাকবে। এরপর আবার নেমে যাবে।’

এ অবস্থায় করণীয় সম্পর্কে অধ্যাপক ডা. নাজমুল বলেন, ‘যারা এখনও টিকা নেননি, দ্রুত নিতে হবে। যারা দুই ডোজ নিয়েছেন, তাদের বুস্টার ডোজ নিতে হবে। আবার টিকা নিয়েও করোনায় আক্রান্ত হতে পারেন। সেক্ষেত্রে জটিলতার শঙ্কাটা কমে যাবে।’

ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, ‘বয়স্কদের মধ্যে যারা বুস্টার ডোজ নেননি তাদের অবশ্যই তা নিতে হবে। একইসঙ্গে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। ঘরের বাইরে গেলেই মাস্ক পরতে হবে।’

করোনার সাম্প্রতিক সংক্রমণ নিয়ে উদ্বিগ্ন না হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন করোনাবিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম।

তিনি বলেন, ‘বর্তমানে যে হারে সংক্রমণ হচ্ছে, তাতে বলা যায় আমরা করোনার নতুন ঢেউয়ে প্রবেশ করেছি। এর আগে, সংক্রমণের হার আমাদের নিয়ন্ত্রণে থাকলেও ৭ জুন থেকে আবারো তা বাড়তে শুরু করেছে। সবাইকে নিয়মিত স্বাস্থ্যবিধি মেনে, মাস্ক পরে চলাফেরা করতে হবে।’

উল্লেখ্য, গত বছরের জুনের তৃতীয় সপ্তাহে দেশে করোনা সংক্রমণের হার অনেক বেশি ছিল। এই বছর সংক্রমণ কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় তা এখনো নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। তবে, চলমান সংক্রমণ পরিস্থিতি নিয়ে আতঙ্কিত না হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।

তারা বলছেন, দেশের বিশাল সংখ্যক মানুষ টিকার আওতায় চলে এসেছে। তাছাড়া ইতোমধ্যে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মানুষের মধ্যে অ্যান্টিবডিও তৈরি হয়েছে। ফলে সংক্রমণ ততটা বড় আকারে ছড়াবে না। তবে বেশিরভাগ জনগোষ্ঠীকে টিকার আওতায় আনতে না পারলে অবস্থা অনেক ভয়াবহ হতো।

সংক্রমণের বিস্তার রোধ প্রসঙ্গে অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম আরো বলেন, মানুষ এখন সংক্রমণকে একদমই ভয় পায় না। মাস্ক পরা তো প্রায় ছেড়েই দিয়েছে। মনে রাখতে হবে, মাস্কই আমাদের করোনার সংক্রমণ থেকে বাঁচাতে পারে। এর পাশাপাশি জনসমাগম এড়িয়ে চলারও পরামর্শ দিয়েছেন এই বিশেষজ্ঞ।