জাতীয়

রেকর্ড গড়ে স্বগর্বে দাঁড়িয়ে স্বপ্নের পদ্মা সেতু

গত ৩০ বছরে পদ্মা একাধিকবার আড়াআড়ি প্রায় ১৫ থেকে ২০ কিলোমিটার গতিপথ পরিবর্তন করেছে। খরস্রোতা নদীটির স্বাভাবিক গভীরতা প্রায় ১৫ থেকে ২৫ মিটার, যা বর্ষায় সর্বোচ্চ ৬০ মিটার পর্যন্ত হয়। এসব প্রতিকূলতার কথা বিবেচনায় রাখার পাশাপাশি পৃথিবীর সবচেয়ে খরস্রেতা নদীর ভয়ঙ্কর চেহারাও চ‌্যালেঞ্জ জানিয়েছে আধুনিক ইঞ্জিনিয়ারি সিস্টেমকে। কারণ পানি প্রবাহের দিক দিয়ে পৃথিবীতে আমাজন নদীর পরই অবস্থান পদ্মার। 

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, পদ্মা সেতু কয়েকটি ক্ষেত্রে বিশ্বে রেকর্ড করেছে। নদীশাসন, পাইল ও বিয়ারিংয়ের ব্যবহারে পদ্মা সেতুর রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। 

বিশ্বে পদ্মা সেতুর চেয়ে দীর্ঘ অনেক সেতু আছে। তবে কিছু কারিগরি দিক থেকে এটি অন্যগুলোর চেয়ে আলাদা। প্রথমত, এটি একই সঙ্গে সড়ক ও রেল সেতু। এতে বিশ্বের গভীরতম (১২২ মিটার) পাইল ফাউন্ডেশন ব্যবহার করা হয়েছে। দ্বিতীয়ত, ভূমিকম্পের ঝুঁকি কমাতে এতে বিশ্বের সবচেয়ে বড় পেন্ডুলাম বিয়ারিং ব্যবহার করা হয়েছে। তৃতীয়ত, বিশ্বের সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং নদীশাসন–ব্যবস্থা এই প্রকল্পে বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এছাড়া, প্রায় ৩ হাজার ৬০০ টন উত্তোলন ক্ষমতার বৃহৎ ভাসমান ক্রেন ব্যবহার করে স্টিলের স্প্যান বসানো হয়েছে। শুধু এই প্রকল্পের জন্য বিশ্বের বৃহত্তম ও সবচেয়ে শক্তিশালী হ্যামার জার্মানি থেকে বানিয়ে আনা হয়েছে। এসব কারণে সারা বিশ্বের প্রকৌশলীদের মধ্যে এই সেতুর একটা বিশেষ অবস্থান আছে।

পাইলিং থেকে শুরু করে পদ্মা সেতু নির্মাণে বিশ্বের সেরা টেকনোলজি ব্যবহার করার কথা জানিয়ে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, বিভিন্ন দিক দিয়ে পদ্মা সেতু বিশ্বের রেকর্ড করেছে। শুধু ভু‌মিকম্প বেয়া‌রিং টে‌স্টিং করার জন‌্য চীন থে‌কে আমে‌রিকায় নি‌য়ে যে‌তে এবং আস‌তে শুধু প্লেন ভাড়াই খরচ হ‌য়ে‌ছে ২ কো‌টি টাকা। 

পাইলের গভীরতা: খরস্রোতা পদ্মার মাটির ১২০-১২৭ মিটার গভীরে গিয়ে বসানো হয়েছে পদ্মা সেতুর পাইল। এর আগে পৃথিবীর অন্য কোনো সেতুর জন্য এত গভীরে গিয়ে পাইল বসাতে হয়নি। যা একটি রেকর্ড।

১০ হাজার টনের বিয়ারিং: পদ্মা সেতুতে ব্যবহৃত ‘‘ফ্রিকশন পেন্ডুলাম বিয়ারিং’’ এর সক্ষমতা ১০ হাজার টন। এখন পর্যন্ত কোনো সেতুতে এমন সক্ষমতার বিয়ারিং লাগানো হয়নি। ফলে রিখটার স্কেলে ৮ মাত্রার ভূমিকম্পে টিকে থাকার মতো সক্ষমতা রয়েছে এ সেতুর। এছাড়া, এই সেতুতে ব্যবহৃত একেকটি বিয়ারিংয়ের ওজন ১০ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন। পৃথিবীতে এর আগে কোনো সেতুতে এমন বড় বিয়ারিং ব্যবহার করা হয়নি।   সর্ববৃহৎ ক্রেন: পদ্মা সেতু নির্মাণে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ক্রেন ব্যবহার করা হয়েছে। পিলারের ওপর স্প্যান বসাতে যে ক্রেনটি ব্যবহৃত হয়েছে সেটি এসেছিল চীন থেকে। প্রতি মাসে এর ভাড়া বাবদ গুণতে হয়েছে ৩০ লাখ টাকা। ক্রেনটি বাংলাদেশে ছিল প্রায় সাড়ে তিন বছর। এজন্য মোট খরচ হয়েছে ১২ কোটি ৬০ লাখ টাকা। বিশ্বে প্রথম কোনো সেতু তৈরিতে এত দীর্ঘদিন ক্রেনটি ভাড়ায় থেকেছে। এই ক্রেনটির দাম দুই হাজার ৫০০ কোটি টাকা।

ব্যবহৃত হয়েছে কংক্রিট ও স্টিল: পৃথিবীতে এই প্রথম কোনো সেতু নির্মাণে কংক্রিট এবং স্টিল উভয়ই ব্যবহৃত হয়েছে। বিশ্বে আর কোনো সেতু নির্মাণে কংক্রিট এবং স্টিলের ব্যবহার একসঙ্গে দেখা যায়নি। অর্থাৎ সেতুগুলো হয় কংক্রিটে নির্মিত, না হয় স্টিলের।

সেতু রক্ষায় নদীশাসন: পদ্মা সেতুর সুরক্ষায় নদীতীরের ১৪ কিলোমিটার (১.৬ কিলোমিটার মাওয়া প্রান্তে ও ১২.৪ কিলোমিটার জাজিরা প্রান্তে) এলাকা নদীশাসনের আওতায় আনা হয়েছে। এ কাজে ব্যয় হয়েছে ৯ হাজার ৪০০ কোটি টাকারও বেশি। পদ্মা সেতু প্রকল্প তিন জেলায় বিস্তৃত। মুন্সিগঞ্জের মাওয়া, শরীয়তপুরের জাজিরা এবং মাদারীরপুরের শিবচর।