জাতীয়

যেভাবে কূটনীতিক হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর খুনিরা

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর তার অনেক খুনিকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আত্মীকরণ করা হয় এবং বিদেশে বাংলাদেশি দূতাবাসগুলোয় লোভনীয় পদে তাদের বসানো হয়। এদের মধ্যে কেউ কেউ পরবর্তীতে রাষ্ট্রদূত পদেও পদোন্নতি লাভ করে। কূটনীতিক হিসেবে বিভিন্ন দেশে জাতির জনকের খুনিরাই জাতির প্রতিনিধিত্ব করেছেন।

জানা গেছে, ১৯৭৬ সালের ৮ জুন বঙ্গবন্ধু হত্যায় অভিযুক্তরা তৎকালীন সরকারের সহযোগিতায় বিভিন্ন দেশের দূতাবাসে নিয়োগ পায়। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পঁচাত্তর-পরবর্তী সময়ের তথ্যানুযায়ী, ১৯৭৬ সালের ৮ জুন বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত থাকার দায়ে অভিযুক্ত হত্যাকারী গোষ্ঠীর ১২ জনকে বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দেওয়া হয়েছিল।

শরিফুল হক ডালিম: মেজর ডালিম নামেই বেশি পরিচিত শরিফুল হক ডালিম। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার সাথে তিনি জড়িত ছিলেন। বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর মেজর ডালিম বাংলাদেশে বেতারে নিজেই হত্যার সাথে জড়িত থাকার ঘোষণা দেন। তিনি বর্তমানে পলাতক রয়েছেন।

শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর শরিফুল হক ডালিমকে সেনাবাহিনীতে পুনঃনিয়োগ করা হয় এবং লে. কর্নেল পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়। ১৯৭৬ সালে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে নিয়োজিত হবার পর গণচীনে তাকে কূটনীতিক হিসাবে প্রেরণ করা হয়। বাংলাদেশের বেইজিং দূতাবাসে প্রথম সচিব পদে নিয়োগ পান তিনি। ১৯৮০ সালে লন্ডন হাইকমিশনের সাথে তিনি এ্যটাচ্ড হন। ১৯৮২ সালে হংকংয়ের বাংলাদেশ মিশনে চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স হিসেবে নিয়োগ পান। ১৯৮৮ সালে তিনি কেনিয়ায় বাংলাদেশের হাইকমিশনার হিসেবে নিয়োগ পায়। সে সঙ্গে তিনি তানজানিয়ার অনাবাসী দূত হিসেবে দায়িত্বও পালন করে।

ইউনেপ (UNEP) এবং হেবিটাটে (HABITAT) বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেন। তিনি সোমালিয়ায় যুদ্ধকালীন সময়ে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা বাহিনীর অংশ হিসাবে প্রেরিত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যদের সার্বিক তত্ত্বাবধানের বিশেষ দায়িত্বও পালন করেন। ১৯৯৫ সালে তিনি সরকারি চাকরি থেকে অবসরে যান।

এস এইচ এম বি নূর চৌধুরী: নূর চৌধুরী শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মস্বীকৃত ও মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি। বর্তমানে তিনি কানাডায় অবস্থান করছেন।

বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর নূর চৌধুরী ইরানে দ্বিতীয় সচিব পদে নিয়োগ পায়। এরপর তিনি আলজেরিয়া ও ব্রাজিলের বাংলাদেশ দূতাবাসে চাকরি করেন। ১৯৯৪-৯৬ সালে তিনি হংকংয়ে বাংলাদেশ মিশনের কনসাল জেনারেল ছিলেন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর তিনি যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়ে যান। পরে যুক্তরাষ্ট্র থেকে কানাডায় আশ্রয় নেয়। এখনো তিনি কানাডায় অবস্থান করছেন।

রাশেদ চৌধুরী: মেজর এম রাশেদ চৌধুরী শেখ মুজিবুর রহমান হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডাদেশ প্রাপ্ত আসামি। সাবেক বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা। তিনি বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেসে অবস্থান করছেন।

মেজর রাশেদ চৌধুরীকে ১৯৭৬ সালে সৌদি আরবে দ্বিতীয় সচিব পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। এরপর নাইরোবি, থাইল্যান্ড, লিবিয়া, জার্মানি, কুয়ালালামপুর, ব্রাসিলিয়া, নাইজেরিয়া ও কানাডায় বাংলাদেশ দূতাবাসে চাকরি করে তিনি। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার সময়ে টোকিওতে কূটনৈতিক নিযুক্ত ছিলেন। তখন তাকে ঢাকায় ফেরত আসার নির্দেশ দেওয়া হয়৷ কিন্তু তিনি দেশে ফিরে না এসে যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান। পরে তাকে বরখাস্ত করা হয় ২০১০ সালে শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যাকাণ্ডের বিচার প্রক্রিয়া শেষ হয় এবং সেখানে রাশেদ চৌধুরীর মৃত্যুদণ্ডের রায় দেওয়া হয়।

আবদুল আজিজ পাশা: আবদুল আজিজ পাশা শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার জন্য দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলেন। ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর জেলহত্যাকাণ্ডেরও অভিযুক্ত তিনি। বলা হয়ে থাকে আবদুল আজিজ পাশা ২০০১ সালের ২ জুন জিম্বাবুয়েতে মারা যান। তবে তার মৃত্যু নিয়ে ধোঁয়াশা রয়েছে।

বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর আজিজ পাশা আর্জেন্টিনায় প্রথম সচিব হিসেবে নিয়োগ পায়।

মেজর এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদ: লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি। ২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে তিনি সহ ৫ জনের ফাঁসির রায় কার্যকর করা হয়।

বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর তিনি লিবিয়ায় ত্রিপোলিতে একটি কূটনৈতিক মিশনে পদোন্নতি পান। আলজেরিয়ায় প্রথম সচিব হিসেবেও নিয়োগ পেয়েছিলেন মেজর এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদ। ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়ে যান। রাজনৈতিক আশ্রয় চান। ২০০২ সালে যুক্তরাষ্ট্র সরকার তার আবেদন প্রত্যাখ্যান করেন। ২০০৭ সালের ১৮ জুন দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে বহিষ্কার করা হয়। একই বছর মার্কিন ইমিগ্রেশন এবং কাস্টমস এনফোর্সমেন্ট তাকে আটক করে। পরে দেশে ফেরত পাঠায়।

মেজর বজলুল হুদা: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যার দায়ে দোষী সাব্যস্ত করে মোহাম্মদ বজলুল হুদার ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছিল। তিনি ১৯৮৮ সালের চতুর্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ ফ্রিডম পার্টির হয়ে মেহেরপুর-২ আসন থেকে সংসদ সদস্যও নির্বাচিত হয়েছিলেন। মেজর বজলুল হুদা পাকিস্তানে দ্বিতীয় সচিব হিসেবে নিয়োগ পায়।

মেজর আহমেদ শরিফুল হোসেন: বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর মেজর আহমেদ শরিফুল হোসেন কুয়েতে দ্বিতীয় সচিব পদে নিয়োগ পায়।

ক্যাপ্টেন কিসমত হাশেম: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যা মামলার খালাসপ্রাপ্ত আসামি। তবে তিনি কেন্দ্রীয় কারাগারে জাতীয় চার নেতাকে হত্যায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত ছিলেন। ২০১৫ সালের ২৬ মার্চ কানাডার মন্ট্রিলে তিনি মারা যান।

বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর তিনি আবুধাবিতে তৃতীয় সচিব পদে নিয়োগ পায়। এছাড়া কানাডার অটোয়ায়ও তিনি কূটনৈতিক পোস্টে নিযুক্ত হন।

নাজমুল হোসেন আনসার: তিনি বর্তমানে কানাডায় অবস্থান করছেন। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর তিনি কানাডায় তৃতীয় সচিব পদে নিয়োগ পান।

ক্যাপ্টেন (অব.) আবদুল মাজেদ: বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর তিনি সেনেগালের দূতাবাসে তৃতীয় সচিব হিসেবে নিয়োগ পান। ১৯৮০ সালে বাংলাদেশে ফিরে এসে যোগদান করেন বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন করপোরেশনে। সে সময়ে সেনাবাহিনী থেকে অবসরে যান এবং উপসচিব পদমর্যাদায় চাকরি করতেন, পরবর্তিতে তিনি সচিব পদে পদোন্নতি পান। বিআইডব্লিউটিসিতে চাকরির পরবর্তিতে তিনি যুব উন্নয়ন মন্ত্রণালয়ে পরিচালক পদে যোগদান করেন। সেখান থেকে তিনি জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের পরিচালক হন। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার পর আবদুল মাজেদ আত্মগোপন করেন। ২০২০ সালের ১২ এপ্রিল ফাঁসিতে ঝুলিয়ে আবদুল মাজেদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।

লে. কর্নেল সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান: ২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে তিনিসহ ৫ জনের ফাঁসির রায় কার্যকর করা হয়। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর তিনি ইন্দোনেশিয়ায় দ্বিতীয় সচিব পদে নিয়োগ পান।

লে. কর্নেল খায়রুজ্জামান: খায়রুজ্জামান একজন অবসরপ্রাপ্ত বাংলাদেশ সেনা কর্মকর্তা এবং সাবেক কূটনীতিক, তিনি মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি মিশরে তৃতীয় সচিব হিসেবেও নিয়োগ পান। ১৯৭৫ সালের জেল হত্যা মামলায় অভিযুক্ত তিনি। বর্তমানে পলাতক আছেন।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে নেতৃত্বদানকারী লেফটেন্যান্ট কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান ও লেফটেন্যান্ট কর্নেল খন্দকার আব্দুর রশীদ দূতাবাসের চাকরিতে যোগ দিতে রাজি হয়নি। তারা দুজন লিবিয়ার প্রেসিডেন্ট মুয়াম্মার আল গাদ্দাফির আশ্রয়ে সেখানে ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করে।