জাতীয়

ফরহাদ খানের একগুচ্ছ কবিতা

হতভাগার দল

এতো লাশএতো মৃত্যুযন্ত্রণাএতো অশ্রুএতো আহাজারিএতো বেদনাএতো দীর্ঘশ্বাসকখন দেখেনি কেউ তবুও যথাযথ ক্ষতিপূরণ পায়নি কেউ সাহায্য মেলেনিহাহাকার যায়নিপুর্ণবাসন হয়নিনিহত-আহত শ্রমিকদের সন্তান আর স্বজনআছেন বেশ! দু’মুঠো ভাতের আশায়কাটছে দিন চরম অবহেলায়  ধ্বংসস্তূপের চারপাশে কাটাতারে ঝুলে আছে হাজারো দীর্ঘশ্বাস মেটেনি লাশের দাবি তাতে কী? এখন সবকিছুই ঠিকঠাকআছেন যে যার মতনশুধু অবহেলিত হতভাগা শ্রমিকের দল। বস্ত্রবালিকাকারও নাম শিউলি, কারও নাম শিল্পী কারও নাম ইতি, কারও নাম বিথিকারও নাম রোকেয়া, কারও নাম রুবিয়া...।ওদের এখন একটি নাম-লাশ আর লাশওরা এখন সারিবদ্ধ লাশ। কেউবা পা হারাকেউ হারা হাতকেউবা নিখোঁজ, বেওয়ারিশ লাশ। কারোর আবার চিড়েচ্যাপ্টা বিকৃত মুখ দেখেও যায় না চেনা সেই প্রিয় মুখ! ওরা আমার লহ্মীবোন, জনম দুঃখী মা,  প্রাণের চেয়ে প্রিয়, আমার প্রিয়তমা। ওরা বস্ত্রবালিকা, ওরা দক্ষবালিকা,ওরা জীবনসংগ্রামী যোদ্ধা,ওরা অধিকার বঞ্চিত পোশাককন্যা।  ওদের জীবন সস্তা!ওদের নিয়ে রসিকতা!! ওদের নিয়ে ছিনিমিনি খেলা!!!ওরা আমাদের বস্ত্রবালিকা,ওরা আমেনা, জমিলা, রাহেলা...ওরা রানা প্লাজায় হত্যাযজ্ঞের (!) শিকার বস্ত্রবালিকা।

 

ভাই আমাকে বাঁচান

ভাই আমাকে বাঁচান, ভাই আমাকে বাঁচান আমার জন্য না হলেও, ওর জন্য বাঁচান।আমার যদি মৃুত্যু হয় কী হবে ওরকার কাছে থাকবে মানিক, কী হবে ওর?কে করবে আদর যত্ন, কে করবে শাসনকে বলবে সোনামানিক, আমার রবিন কই? বছরখানেক আগে  ওর বাবা (আহসান উল্লাহ) চলে গেছেন না ফেরার দেশে।   এখন আমি কী করবো, কী হবে আমারআমারও যদি মরণ হয় কে থাকবে আর।কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে আমার নাড়িছেড়া ধনমা, মা...বলে ডাকলেও কে শুনবে আর।কে পড়াবে আদর্শলিপিকে শোনাবে গান।কে দেবে ঈদের জামা, কে খাওয়াবে পোলাও কোরমাকে খাওয়াবে ভাত।কে দেবে ঘুম পাড়িয়ে, কে তুলবে ডেকেওর (রবিন) জীবন পড়বে ঢাকা কষ্টের পাহাড়ে।পথে পথে ঘুরবে রবিন স্বপ্ন যাবে মরে। রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপ সব নিয়েছে কেড়েপাঁচদিন ধরে লড়ছি আমি ধ্বংসস্তূপের নিচে...।

 

 

(রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপে নিহত কুষ্টিয়ার গার্মেন্টকর্মী শাহানার একমাত্র শিশুপুত্র রবিনকে ‘মানিক’ বলে সম্বোধন করা হয়েছে)।

 

মর্জিনা তুমি আমায় ক্ষমা করো না মর্জিনা মর্জিনা মর্জিনা...  তুমি আমায় ক্ষমা করো না!তুমি জানতে চেয়েছিলেতোমার আলিফ কেমন আছে?জানাতে পারিনি আমিতুমি বলেছিলে-আলিফের কাছে নিয়ে যেতেনিতে পারিনি আমিমর্জিনা, তুমি আলিফকে একবার দেখতে চেয়েছিলে  দেখাতে পারিনি আমিমর্জিনা,তুমি বলেছিলে-আলিফকে একবার দুধ খাইয়ে আসিসন্তানের জন্য মায়ের এমন আকুতিও পূরণ করতে পারিনি আমিমর্জিনা,ধ্বংস্তূপের কঠিন পরিবেশে নিঃশ্বাস নিতে পারছিলে না তুমি, তবুও তোমার মুখে শুধু আলিফ, আলিফ আর আলিফ...মর্জিনা,মৃত্যুর সঙ্গে পাঁচদিন লড়াই করেও বাঁচার আকুতি জানিয়েছিলে তুমিমর্জিনা,তোমার জীবন যন্ত্রণা তুচ্ছ করে শুধুমাত্র আলিফের জন্য বাঁচতে চেয়েছিলে তুমি মর্জিনা,তোমার জন্য, তোমার আলিফের জন্য কিছুই করতে পারলাম না আমি মর্জিনা,তোমাকে, তোমার আলিফের কাছে নিয়ে যেতে পারলাম না আমিমর্জিনা,তোমার আকুতি ও আবেদনের মূল্যায়ন করতে পারলাম না আমিমর্জিনা,তুমি ওঠো, তোমার আলিফ তোমাকে ডাকছেমর্জিনা,তুমি দেখো, তোমার আলিফ তোমার দিকে কীভাবে তাকিয়ে আছে!মর্জিনা,তুমি ওঠো, তোমার আলিফকে একটু আদর করো।মর্জিনা,তোমাকে ছাড়া তোমার আলিফ কিছুই বুঝতে চায় নামর্জিনা, তুমি আর অভিমান করো না মর্জিনা,তুমি ওঠো, তোমার আলিফকে আদর করো...।

 

১৬ কোটি মানুষের কান্নানারী-পুরুষের কান্না দেখেছি শিশু-কিশোরের কান্না দেখেছি। গরিব-দুঃখীর কান্না দেখেছিকুলি-মজুরের কান্না দেখেছি।নিষ্ঠুর প্রাণের কান্না দেখেছি পাষাণ মনের কান্না দেখেছি। উদ্ধারকর্মীর কান্না দেখেছিপ্রচারকর্মীর কান্না দেখেছি।১৬ কোটি মানুষের কান্না দেখেছিবিশ্ববাসীর কান্না দেখেছি।

 

 

শাহানার জন্য...  

আমি রুদ্ধশ্বাস অভিযান দেখেছি আমি উদ্ধারের শত চেষ্টা দেখেছি। আমি মৃত্যুর সঙ্গে লড়তে দেখেছিআমি হার না মানা যুদ্ধ দেখেছি। আমি বেঁচে থাকার আকুতি শুনেছি নিয়তির কাছে হারতে দেখেছি।  আমি উদ্ধারকর্মীদের বিলাপ শুনেছিশিশুর মতো কাঁদতে দেখেছি। আমি হাজারো চোখের কান্না দেখেছিআমি শোকাহত জাতিকে দেখেছি। আমি সুলভ মূল্যের মৃত্যু দেখেছি আমি শাহানার জন্য কাঁদতে দেখেছি।

(রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপের নীচে মৃত্যু বরণকারীদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে এবং আহত ও পঙ্গুত্ববরণকারী শ্রমিক ভাইবোনদের স্বাভাবিক জীবনে ফেরার প্রত্যাশায়।)

 

 

রাইজিংবিডি/রাশেদ শাওন/২৪ এপ্রিল ২০১৪