জাতীয়

বাবাকে মনে পড়লে দেয়ালে ছবি আঁকে মেয়ে

একমাত্র কন্যা আওন, ছেলে সামি আর স্ত্রীকে নিয়ে সুখেই কাটছিল গরীবের ডাক্তার আহমেদ মাহি বুলবুলের। সাত বছরের আওনের বাবার সঙ্গেই ছিল সবচেয়ে বেশি সখ্যতা। তার মিষ্টি হাসিতে বাবাও হারিয়ে যেতেন সুখের সমুদ্রে। বাবা-মেয়ের এই সম্পর্ক ঘাতকের ছুরিকাঘাতে ছিন্ন হয়ে যায়। অবুঝ আওন এখন বেশ বুঝতে পারে বাবা আর ফিরবে না। বাবার জন্য ‘ড্যাডি ওয়াল’ তৈরি করেছে আওন। বাবার কথা যখনই মনে পড়ে তখনই ঘরের দেয়ালে ছবি আঁকতে থাকে।

এদিকে ঘাতকের ছুরিকাঘাতে ডা. বুলবুলের হঠাৎ মৃত্যুতে তার পরিবার যেমন অসহায় হয়ে পড়েছে, তেমনি অনেক অসহায় মানুষও হারিয়েছে অবলম্বন। কারণ তিনি ছিলেন গরীব-পথশিশুদের ডাক্তার। তার কাছে কেউ কখনো চিকিৎসা না পেয়ে ফিরে যেতেন না। তার উদ্দেশ্যে ছিলো মানুষের সেবা করা। তার মৃত্যুতে অসহায় মানুষের কান্না এখনো থামেনি। বিশেষ করে অবুঝ পথশিশুরা তাকে এখনো খুঁজে-ফেরে। তারা তাদের চিকিৎসক অভিভাবককে হারিয়েছে। এখনো অনেক গরীব মানুষ তার কাছে আসে। যখন জানতে পারে তিনি আর নেই, তখন তারা কান্নায় ভেঙে পড়ে।

গত ২৭ মার্চ ভোরে মিরপুরে ছিনতাইকারীদের ছুরিকাঘাতে খুন হন দন্ত চিকিৎসক বুলবুল। এ ঘটনায় তার স্ত্রী শাম্মী আক্তার মামলা করেন। প্রথমে মামলাটি তদন্ত করে মিরপুর থানা পুলিশ। এরপর মামলার তদন্তভার ডিবি পুলিশকে দেওয়া হয়। গত অক্টোবর মাসে ডিবি পুলিশ ৫ জনকে অভিযুক্ত করে ঢাকার সিএমএম আদালতে চার্জশিট দাখিল করে। পরবর্তী বিচারের জন্য মামলাটি সম্প্রতি ঢাকার সিএমএম আদালত থেকে মহানগর দায়রা জজ আদালতে পাঠানো হয়েছে।

মামলা সম্পর্কে ডা. বুলবুলের স্ত্রী শাম্মী আক্তার বলেন, ডা. বুলবুলকে হারিয়ে আমাদের তো সবই শেষ। যাকে হারিয়েছি তাকে তো আর ফিরে পাবো না। এখন মামলার দিকে তাকিয়ে আছি। আমরা এর সুষ্ঠু বিচার চাই। দোষীদের সর্বোচ্চ সাজা চাই।

মেয়েকে মিরপুরের একটি স্কুলে ভর্তি করেছিলাম বুলবুল দম্পতি। তবে বুলবুল খুনের পর ছেলে-মেয়েকে নিয়ে ঢাকা ছেড়েছেন শাম্মী আক্তার। ঢাকা ছাড়ার বিষয়ে জানতে চাইলে শাম্মী আক্তার বলেন, গার্ডিয়ান ছাড়া আমি একা ওদের নিয়ে কিভাবে থাকবো। আবার ঢাকায় থাকার অ্যাফোর্ড দিবে কে। এজন্য ঢাকা ছেড়ে চলে এসেছি।

বুলবুলের মেয়ের বয়স সাত বছর এবং ছেলের বয়স দুই বছর। ছেলে এখনো অবুঝ হলেও মেয়ে ঘুরেফিরে বাবাকে খোঁজে। 

শাম্মী আক্তার বলেন, ‘ছেলেটা তো ছোট। ও তো কিছু বুঝে না। তবে মেয়েটা সারাক্ষণ বাবাকে খোঁজে। বাবাকে খুব মিস করে। ওকে শান্ত করতে অনেক সময় আমাদের হিমশিম খেতে হয়। বাসায় রুমে একটি ‘ড্যাড ওয়াল’ করেছে। বাবা কথা যখনই মনে পড়ে, তখনই ড্যাড ওয়ালে বাবার ছবি আঁকে।’

তিনি বলেন, ডা. বুলবুল সিম্পল লাইফ লিড করতেন। তার মধ্যে কোনো বিলাসিতা ছিলো না। তিনি যথেষ্ট স্ট্যাগেল করেছেন। পরিবারের জন্য যতটুকু অর্থ প্রয়োজন অতটুকুই রাখতেন। গরীব-পথশিশুদের তনি বিনামূল্যে চিকিৎসা দিতেন। ওর (বুলবুলের) সহকর্মীরা এখনো জানায়, বুলবুল যাদের বিনামূল্যে চিকিৎসা দিতো সেই সব গরীব-পথশিশুরা এখনো এসে তাকে খোঁজে। ওর সুযোগ থাকলে গরীব-পথশিশু-অসহায় মানুষদের হেল্প করতো। নানাভাবে উপকার করার চেষ্টা করতো। বেঁচে থাকলে সে দেশের সেবা করতো। আমাদের এখন প্রত্যাশা মামলার বিচার যেন দ্রুত হয় এবং দোষীদের যেন দৃষ্টান্তমূলক সাজা হয়।

জানা যায়, শেওড়াপাড়ার একটি বাসায় স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে থাকতেন দন্ত চিকিৎসক বুলবুল। রাজধানীর মগবাজারে রংপুর ডেন্টাল নামে তিনি একটি ডেন্টাল ক্লিনিকের মালিক ছিলেন তিনি। এছাড়া তিনি সাব কন্ট্রাক্টর হিসেবেও কাজ করতেন। ২৭ মার্চ ভোরে তিনি নোয়াখালী যাওয়ার উদ্দেশ্যে বাসা থেকে বের হন। ভোর সাড়ে ৫টার দিকে শেওড়াপাড়া এলাকায় তাকে রাস্তায় ছুরিকাঘাত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে একজন রিকশাচালক ও পথচারী মিলে উদ্ধার করে স্থানীয় আল হেলাল হাসপাতালে নিয়ে যায়। হাসপাতালে নেওয়ার আগেই তার মৃত্যু হয়।

এ ঘটনায় তার স্ত্রী শাম্মী আক্তার অজ্ঞাতনামা ৩ জনকে আসামিকে করে মামলা করেন।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবি পুলিশের পরিদর্শক মুহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন পাঁচ ছিনতাইকারীর বিরুদ্ধে পেনাল কোডের ৩৯৬ ধারায় চার্জশিট দাখিল করেন। চার্জশিটভুক্ত ৫ আসামি হলেন ছিনতাইকারী চক্রের হোতা মো. রায়হান ওরফে সোহেল আপন, রাসেল হোসেন হাওলাদার, আরিয়ান খান হৃদয়, সোলায়মান ও রিপন।

চার্জশিটে তদন্ত কর্মকর্তা দেলোয়ার হোসেন বলেন, ডা. বুলবুল আহমেদ দন্তচিকিৎসক ও প্রথম শ্রেণির ঠিকাদার ছিলেন। তিনি ঠিকাদারি কাজের জন্য ২০২২ সালের ২৭ মার্চ ভোর ৫টা ১৫ মিানটের দিকে নোয়াখালী যাওয়ার উদ্দেশ্যে বাসা হতে বের হয়ে শেওড়াপাড়া বাসস্ট্যান্ড যাওয়ার জন্য রিকশাযোগে রওনা হন।’

পথশিশুদের সঙ্গে দন্ত চিকিৎসক বুলবুল। ছবি: সংগৃহীত

‘ভোর আনুমানিক সাড়ে ৫টার দিকে মিরপুর মডেল থানার পশ্চিম কাজীপাড়ার নাভানা ফার্নিচার শোরুমের সামনে মেইন রাস্তার ওপর পৌঁছালে মামলার আসামি রিপন ও রাসেল রিকশার গতিরোধ করে বুলবুল আহমেদকে যা যা আছে দিয়ে দিতে বলেন। না দিলে সঙ্গে থাকা ছুরি দিয়ে আঘাত করার ভয় দেখান। বুলবুল আহমেদ মোবাইল ফোন দিতে না চাওয়ায় রিপন তার উরুতে আঘাত করে রক্তাক্ত জখম করেন এবং মোবাইল ফোন নিয়ে পালিয়ে যান। বুলবুল আহমেদ গুরুতর জখম অবস্থায় রাস্তায় পড়ে যান। পরে তাকে উদ্ধার করে সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।