জাতীয়

ভুল চিকিৎসায় মৃত্যুর অভিযোগ: ইউনাইটেড হাসপাতালে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি?

১৫ বছর আগে চিত্রনায়ক আসলাম তালুকদার মান্নার মৃত্যুর পর ইউনাইটেড হাসপাতালের বিরুদ্ধে ‘ভুল’ চিকিৎসার অভিযোগ উঠেছিল। ২০০৮ সালে বুকে ব্যথা নিয়ে মান্না বেসরকারি ওই হাসপাতালে গিয়েছিলেন। ভর্তির কয়েক ঘণ্টা পর সেখানেই তার মৃত্যু হয়। মান্নার স্ত্রীর ভাই রেজা কাদের তখন মামলা করেছিলেন। তাতে ছয় চিকিৎসকের বিরুদ্ধে বিচারও শুরু হয়েছিল। পরে উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশে মামলাটি ঝুলে যায়।

একই ঘটনার যেন ‘পুনরাবৃত্তি’ হলো গত বছরের ১৪ ডিসেম্বর। যুক্তরাষ্ট্র ও জর্ডা‌নের দ্বৈত নাগ‌রিক ক্যাপ্টেন ইউসুফ আলহেন্দি গালফ এয়ারের ফ্লাইট নিয়ে বাংলাদেশে এসেছিলেন। ১৪ ডিসেম্বর ভোরে তার ফ্লাইট নিয়ে ঢাকা ছাড়ার কথা ছিল। ওই দিন ভোর ৪টা ২০ মিনিটে শাহজালাল বিমানবন্দরে তিনি হঠাৎ পড়ে যান। বিমানবন্দরে তাকে পাঁচ মিনিট কার্ডিওপালমোনারি রিসাসিটেশন (সিপিআর) দেওয়া হয়। তার রক্তচাপ ক্রমশ কমতে থাকলে নেওয়া হয় ইউনাইটেড হাসপাতালে। কয়েক ঘণ্টা পর সেখানে তিনি মারা যান। 

ইউসুফের মৃত্যুর প্রায় দেড় মাস পর (৩০ জানুয়ারি) জর্ডান থেকে ঢাকায় এসে সেগুনবাগিচায় ডিআরইউ মিলনায়তনে সংবাদ সম্মেলন করেন ওই পাইলটের বোন তালা আলহেন্দি জোসেফানো। তিনি সেখানে অভিযোগ করে জানান, গালফ এয়ারের পাইলট ক্যাপ্টেন মোহান্নাদ ইউসুফ আলহেন্দি ফ্লাইট নিয়ে বাংলাদেশে আসার পর অসুস্থ হয়ে ঢাকার ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তি হন। কিন্তু সেখানে ভুল চিকিৎসা ও অবহেলায় তিনি মারা গেছেন। এটি এক‌টি অবহেলাজনিত হত্যাকাণ্ড।

অভিযোগে তালা আলহেন্দি জানান, ২০২২ সালের ১৪ ডিসেম্বর ঢাকার মেরিডিয়ান হোটেলে ছিলেন ইউসুফ হাসান আলহেন্দি। গালফ এয়ারের ফ্লাইট পরিচালনার জন্য ইউসুফ ভোর সাড়ে ৩টায় হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে গে‌লে ভোর ৪টা ১০ মিনিটের দিকে তিনি জ্ঞান হারান। বিমানবন্দ‌রে তা‌কে সিপিআর দেওয়া হয়। এরপর ভোর সাড়ে ৫টায় তাকে ইউনাইটেড হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নেওয়া হয়। 

ইউনাইটেড হাসপাতালের জরু‌রি বিভা‌গে ইউসুফকে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দেওয়া হয়নি দাবি করে তি‌নি বলেন, সকাল ৬টা ২৫ মিনিটে দ্বিতীয়বার তার কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়। এরপর তাকে ১০ মিনিট সিপিআর দেওয়া হয়। সকাল পৌনে ৭টায় তার তৃতীয়বার কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হলে আরওএসসির সঙ্গে ১৫ মিনিট সিপিআর দেওয়া হয়। বেলা সোয়া ১১টায় ইউনাইটেড হাসপাতালের চিকিৎসা কার্যক্রমের মধ্যেই আমার ভাইয়ের চতুর্থ কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়। তাকে ৪৫ মিনিট সিপিআর দেওয়া হয় এবং টেম্পোরারি পেসমেকার (টিপিএম) বসানো হয়। দুপুর ১২টা ৮ মিনিটে আমার ভাই মারা যান।

তালা আলহেন্দি বলেন, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলেছে, আমার ভাইয়ের চিকিৎসা প্রক্রিয়ায় ছিলেন ডা. কায়সার নাসির। কিন্তু আমার ভাইয়ের চিকিৎসার যে কাগজপত্র দেওয়া হয়েছে, তাতে এই চি‌কিৎসকের নাম পাওয়া যায়নি। ভোর সা‌ড়ে ৫টা থেকে ১২টা পর্যন্ত সময় পেয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এ সময়ের মধ্যে তারা আমার ভাইয়ের জীবন বাঁচাতে ব্যর্থ হয়েছেন। 

কার্ডিয়াক এরেস্টের রোগীর চিকিৎসার ধরন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের চিকিৎসকদের কাছ থেকে ধারণা নিয়েছেন বলেও জানিয়েছেন তালা এলহেন্দি জোসেফানো। 

কোনও কার্ডিওলজিস্টের পরামর্শ ছাড়াই তারা ইউসুফকে আইসিইউ‌তে স্থানান্তর করেন— এমন দা‌বি করে তিনি বলেন, সেসময় কোনও কার্ডিওলজিস্ট তার ভাইকে দে‌খেন‌নি। এমনকি রোগী‌কে আইসিইউতে স্থানান্তরের ৪০ মিনিট পরেও চিকিৎসায় পরামর্শ দেওয়ার জন্য কোনও কার্ডিওলজিস্ট ছিলেন না। দুই ঘণ্টার ব্যবধানে তার ভাইয়ের তিন বার কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়। তৃতীয়বার কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট করলে সোয়া দুই ঘণ্টা পর্যন্ত তাকে কোনও চিকিৎসাসেবা ছাড়াই ফেলে রাখা হয়েছিল। অর্থাৎ তিনি সঠিক চিকিৎসাবঞ্চিত ছিলেন।

তিনি বলেন, কাগজপত্রের কোথাও লেখা নেই যে সেখানে কোনও কার্ডিওলজিস্ট ছিলেন। আমি যখন হাসপাতালের কাছে মেডিক্যাল ফাইল চাই, তারা সেটি আমাকে দিতে অস্বীকৃতি জানায়। আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বললে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, মেডিক্যাল ফাইল আমার ভাইয়ের মেয়েকে দেওয়া হয়েছে, যা সত্য নয়।

তিনি আরও অভিযোগ ক‌রে বলেন, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ দাবি করেছে, কার্ডিওলজিস্টের মতামত নেওয়া হয়েছে। কনজারভেটিভ ম্যানেজমেন্ট ট্রিটমেন্ট বেছে নিয়েছেন কার্ডিওলজিস্ট, যার পরিচয় অজ্ঞাত। কনজারভেটিভ ম্যানেজমেন্ট ট্রিটমেন্টের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর চিকিৎসক আমার ভাইকে হেপারিন সোডিয়াম ৫০০০ আইইউ ইনজেকশন দিয়েছেন। রক্ত জমাট বাঁধা বন্ধ করতে এটা দেওয়া হয়। এতে আরও পরিষ্কার যে, রোগীর চিকিৎসায় সেখানে কোনও কার্ডিওলজিস্ট ছিলেন না। 

তালা আলহেন্দি বলেন, সিসিটিভি ফুটেজ ও হাসপাতালের কাগজপত্রে কারসাজি করা হয়েছে। আমাকে ভয় দেখানো হয়েছে। ২০২৩ সালের ২৬ জানুয়ারি ইউনাইটেড হাসপাতালের কাছে আমি চিকিৎসার কাগজপত্র ও সিসিটিভির ফুটেজ দেখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু প্রমাণাদি কারসাজি করতে তারা এসব দিতে তিন দিন সময় নিয়েছিল। আমার সঙ্গে ঠাট্টা ও রুঢ় আচরণ করা হয়েছে। আইনগত পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলায়, তারা আমাকে বিস্তারিত কাগজপত্র দিয়েছেন। কিন্তু এজন্য তিন দিন সময় নিয়েছেন। এ সময়ে সব কাগজপত্রে কারসাজি করা হয়েছে।  

ক্যাপ্টেন ইউসুফের বোনের ধারণা, রোগীর বিল বাড়ানোর জন্য এসব করেছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এমনকি, গালফ এয়ারও তার ভাইয়ের চিকিৎসায় অবহেলা করেছে বলে অভিযোগ করেছেন জোসেফানো। 

তিনি বলেন, তিনি (ইউসুফ) গালফ এয়ারের একটি ফ্লাইটে ওঠার সময় এটা হয়েছে। আর ১০ মিনিট পর তিনি উড়োজাহাজে ওঠার পর এটা হলে ৩০০ লোকের জীবন ঝুঁকিতে পড়ত। কাজেই গালফ এয়ার কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব ছিল তিনি যাতে সঠিক চিকিৎসা পান, তা নিশ্চিত করা। কিন্তু তারা তা করেননি। পরিবারের অনুপস্থিতিতে অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করতে কোনও কর্মকর্তাকে হাসপাতালে পাঠায়নি গালফ এয়ার।

এ রকম অপরাধের পুনরাবৃত্তি রোধে দৃষ্টান্তমূলক জরিমানা কিংবা ক্ষতিপূরণের দাবি তুলে জোসেফানো বলেন, অভিযুক্তদের জেলে না ঢুকিয়ে আমি নড়ছি না। তারা মূলত আমার ভাইকে হত্যা করেছেন।

ইউনাইটেড হাসপাতালের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকি দিয়েছেন তিনি। হাসপাতালটির লাইসেন্স বাতিল করার দাবিও জানান তিনি।

ইউনাইটেড হাসপাতালের ভাষ্য

এসব অভিযোগের বিষয়ে ইউনাইটেড হাসপাতালের জনসংযোগ ব্যবস্থাপক আরিফুল হক ব‌লেন, রোগী ইউসুফ হাসান‌কে অজ্ঞান অবস্থায় হাসপাতা‌লে আনা হয়। তার শারীরিক অবস্থা দে‌খে কা‌র্ডিয়াক অ্যা‌রেস্ট হ‌য়ে‌ছে ব‌লে ধারণা ক‌রেন জরু‌রি বিভাগের ডাক্তাররা। এসময় প্রাথমিকভা‌বে তা‌কে ৪/৫ মি‌নিট সি‌পিআর দেওয়া হয়। তারপরও অবস্থার অবন‌তি হ‌লে তা‌কে দ্রুত আইসিইউতে স্থানান্তর করা হয়। সেখা‌নে চি‌কিৎসারত অবস্থায় তি‌নি দুপুর ১২টার পর মারা যান।

কোনও কা‌র্ডিওল‌জিস্ট রোগী‌কে চি‌কিৎসা‌সেবা দেন‌নি— রোগীর বো‌নের এই অভি‌যো‌গের প্রেক্ষি‌তে আরিফ বলেন, ইউনাইটেডের ম‌তো বিশ্বমা‌নের এক‌টি হাসপাতা‌লে কা‌র্ডিওল‌জিস্ট ছি‌লেন না, এ অভি‌যোগ নিতান্তই ভিত্তিহীন ও মনগড়া। আমা‌দের হাসপাতা‌লে ২৪ ঘণ্টা জরু‌রি বিভাগে কা‌র্ডিওল‌জিস্টসহ বি‌ভিন্ন ডি‌সি‌প্লি‌নের চি‌কিৎসকরা উপ‌স্থিত থা‌কেন।

তিন দিন অতিক্রান্ত হওয়ার পর চি‌কিৎসা—সংক্রান্ত কাগজপত্র পাইল‌টের বো‌নকে হাসপাতাল থে‌কে সরবরাহ করা হ‌য়ে‌ছে। তিন দিন কে‌ন লাগ‌লো? এই প্রস‌ঙ্গে প্রতিষ্ঠানটির পাবলিক রিলেশন বিভা‌গের ওই কর্মকর্তা ব‌লেন, প্রথম‌ দিন রাত নয়টার প‌রে, দ্বিতীয় দিন রাত আটটায় পাইল‌টের বো‌ন হাসপাতা‌লে গে‌লে তা‌কে অফিস টাইমে আসতে বলা হয়। তৃতীয়‌ দিন তি‌নি দুপুর তিনটার দি‌কে গে‌লে, তি‌নি যে পাইল‌টের বোন সেই প্রমাণ দেখা‌তে বলা হয়। তার আইডেন্টিটি প্রমাণ হওয়ার পর, মৃত পাইল‌টের মে‌ডি‌ক্যাল কাগজপ‌ত্রের জন্য তাকে একটা ফরম ফিলাপ কর‌তে বলা হয়। তি‌নি সেটা সম্পন্ন কর‌লে, হাসপাতাল থে‌কে সব কাগজপ‌ত্রের ক‌পি সরবরাহ করা হয়।

সব‌শে‌ষে এই কর্মকর্তা ব‌লেন, যেকো‌নও মানু‌ষের মৃত্যুই দুঃখজনক। তেম‌নি, বিদে‌শি এই পাইল‌টের মৃত্যুও অনাকাঙ্ক্ষিত। আমরা তার আত্মার শা‌ন্তি কামনা কর‌ছি। পাশাপা‌শি আমা‌দের হাসপাতাল এবং চি‌কিৎসার ব্যাপা‌রে তার বোন যে অভি‌যোগ ক‌রে‌ছেন, তারও প্রতিবাদ জানা‌চ্ছি।