জাতীয়

পদ্মা সেতুর এক বছর: যোগাযোগ-জনজীবনে ইতিবাচক প্রভাব

বাংলাদেশের সবচেয়ে বৃহৎ এবং অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প হিসেবে ঠিক এক বছর আগে উদ্বোধন করা হয় পদ্মা সেতু। ২০২২ সালের ২৫ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে মাওয়া প্রান্ত দিয়ে টোল দিয়ে প্রথমবারের মতো আনুষ্ঠানিকভাবে পদ্মা সেতু পার হন এবং এর মধ্য দিয়ে দক্ষিণের জেলাগুলোর সঙ্গে সড়কপথে যোগাযোগ উন্মোচিত হয়। পদ্মা সেতু নির্মাণ বর্তমান সরকারের একটি বড় সাফল্য।

রাজধানী থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলায় একবছর আগে যেতে পার হতে হতো ফেরি। দুই ঈদে অতিরিক্ত যানবাহনের চাপে যানজট লেগেই থাকতো, এতে প্রচণ্ড ভোগান্তি পোহাতে হতো জনসাধারণকে। বিপদ ছিল শীতেও, ঘন কুয়াশায় সারারাত বন্ধ থাকতো ফেরি। এছাড়া বর্ষায় ছিল লঞ্চ দুর্ঘটনার শঙ্কা।

সব শঙ্কা আর দুর্ঘটনার পথ মাড়িয়ে পদ্মা সেতু চালুর পর বৃহত্তর যশোর, খুলনা, কুষ্টিয়া, বরিশাল আর ফরিদপুরের ২১ জেলার মানুষ ১ থেকে ৪ ঘণ্টার পৌঁছে যাচ্ছেন রাজধানীর বুকে।

আগে যেখানে ঢাকায় কোনো কাজ করতে গেলে যাওয়া-আসা মিলিয়ে সময় লাগতো তিনদিন, সেখানে এখন ভোরে ঢাকায় রওয়ানা দিয়ে দিনের কাজ শেষ করে সন্ধ্যার গাড়িতে বাড়ির উদ্দেশ্যে পথ দেওয়া যায়। রাতে বাড়ি ফিরে খেতেও পারেন দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষরা। যা এক সময় ছিল শুধুমাত্র কল্পনা।

পদ্মা সেতুর মাধ্যমে রাজধানী ঢাকার সঙ্গে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চল, মোংলা বন্দরের সরাসরি সড়ক যোগাযোগ তৈরি হয়েছে। রাজধানী এবং দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের মধ্যে যাতায়াতের সময় এক-চতুর্থাংশ কমে এসেছে। এমনকি প্রস্তাবিত এশিয়ান হাইওয়ের এবং ট্রান্স-এশিয়ান রেলওয়ে নেটওয়ার্কের অংশ হওয়ায় পদ্মা সেতু আঞ্চলিক সংযোগকে সহজতর করেছে।

এই সেতু নির্মাণ খাতে, কৃষি খাতে এবং উৎপাদন ও পরিবহন খাতের প্রবৃদ্ধিতেও অবদান রাখছে।

গত এক বছরে পদ্মা সেতুতে টোল আদায় হয়েছে প্রায় ৮০০ কোটি টাকার বেশি। সেতু বিভাগের একটি দায়িত্বশীল সূত্র এ তথ্য জানিয়েছে। সূত্র জানায়, ২০২২ সালের ২৬ জুন ভোর ৬টা থেকে শুরু হওয়া পদ্মা সেতুতে চলতি বছরের ৩১ মার্চ পর্যন্ত ৯ মাসে ৬০৩ কোটি টাকা টোল আদায় হয়েছে। এর পরের (এপ্রিল-মে ও জুনের প্রথম ২০ দিন) তিন মাসে টোল আদায়ের পরিমাণ প্রায় ২০০ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে এ পর্যন্ত পদ্মা সেতুতে টোল আদায়ের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮০০ কোটি টাকার কিছুটা বেশি।

অন্যদিকে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, পদ্মা সেতু কর্তৃপক্ষ এ পর্যন্ত চার কিস্তিতে মোট ঋণের ৬৩২ কোটি ৯০ লাখ ৯৭ হাজার টাকা পরিশোধ করেছে।

সূত্র আরও জানিয়েছে, সেতু কর্তৃপক্ষ আলাদাভাবে ঋণের প্রথম ও দ্বিতীয় কিস্তির মোট ৩১৬ কোটি ৯০ লাখ ৯৭ হাজার টাকা এবং তৃতীয় ও চতুর্থ কিস্তির ৩১৬ কোটি টাকার চেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে তুলে দিয়েছে। প্রথম দফায় দুই কিস্তির টাকা পরিশোধ করা হয়েছে চলতি বছরের ৫ এপ্রিল। তৃতীয় ও চতুর্থ কিস্তির অর্থের চেক হস্তান্তর করা হয়েছে গত ১৯ জুন। এ পর্যন্ত পদ্মা সেতু নির্মাণে অর্থ বিভাগ থেকে নেওয়া ঋণের মোট চার কিস্তির অর্থ পরিশোধ করেছে সেতু বিভাগ।

এদিকে, আবারও বাড়ছে পদ্মা সেতুর নির্মাণ ব্যয়। এ দফায় নির্মাণ ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে ১ হাজার ১১৮ কোটি টাকা। ব্যয় বাড়ার কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ নকশা প্রণয়নে অতিরিক্ত সময় লাগা, ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমে যাওয়াসহ ৭টি কারণকে চিহ্নিত করেছে। এজন্য বৈদেশিক মুদ্রায় ৯ কোটি ৫০ লাখ ৩১ হাজার ডলার অতিরিক্ত খরচ করতে হবে।

উল্লেখ্য, এর আগেও আরও কয়েকবার পদ্মা সেতুর নির্মাণ ব্যয় বাড়ানো হয়েছিল।

জানা গেছে, পদ্মা সেতু নির্মাণে মোট খরচ করা হয়েছে ৩০ হাজার ১৯৩ দশমিক ৩৯ কোটি টাকা। এসব খরচের মধ্যে রয়েছে-সেতুর অবকাঠামো তৈরি, নদীশাসন, সংযোগ সড়ক, ভূমি অধিগ্রহণ, পুনর্বাসন ও পরিবেশ, বেতন-ভাতা ইত্যাদি। বাংলাদেশের অর্থ বিভাগের সঙ্গে সেতু বিভাগের চুক্তি অনুযায়ী-সেতু নির্মাণে ২৯ হাজার ৮৯৩ কোটি টাকা ঋণ দেয় সরকার। ১ শতাংশ সুদ হারে ৩৫ বছরের মধ্যে সেটি পরিশোধ করবে সেতু কর্তৃপক্ষ। ২০০৫ সালে পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য প্রাথমিক প্রাক্কলন ধরা হয়েছিল ১২ হাজার কোটি টাকা।

২০০৭ সালের আগস্ট মাসে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে একনেক-এর সভায় পদ্মা সেতুর চূড়ান্ত প্রাক্কলন ১০ হাজার ১৬১ কোটি অনুমোদন করা হয়। পরবর্তীকালে বিভিন্ন সময়ে প্রাক্কলন ব্যয় বাড়ানো হয়েছে। সর্বশেষ অনুমোদিত প্রাক্কলনের পরিমাণ ৩০ হাজার ১৯৩ দশমিক ৩৯ কোটি টাকা, যা মূল প্রাক্কলনের তুলনায় ২০ হাজার ৩২ কোটি টাকা বেশি। বলা হয়, বাস্তবায়ন বিলম্বিত হওয়াই প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ার মূল কারণ।