জাতীয়

অবাস্তবায়িত শিশু অধিকার : পরিস্থিতি ও প্রতিকার

মোঃ মনির হোসাইন : প্রায় ২০০ বছর ধরে ব্রিটিশ শাসনের জাঁতাকলে নিষ্পেষিত হয়েছে আমাদের জাতি। ১৯৪৭ সালে সেই জাঁতাকল থেকে এই উপমহাদেশের মানুষ মুক্তি লাভ করলেও, আসেনি আমাদের আসল মুক্তি। বাঙ্গালী জাতির সেই কাঙ্খিত মুক্তির জন্য ১৯৭১ সালে সংগঠিত হয় মহান মুক্তিযুদ্ধ। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছিল পরাধীনতার শৃঙ্খল ছিঁড়ে শোষনমুক্ত একটি গনতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা। সেই সমাজের মানুষ পাবে মৌলিক অধিকার। লঙ্ঘিত হবে না মানবাধিকার।প্রতিটি মানুষের মৌলিক অধিকার বাস্তবায়নের লক্ষ্য যদি হয় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, তাহলে আজ আমরা বলতে পারি মুক্তিযুদ্ধের সেই চেতনা এখনো সম্পূর্ণভাবে বাস্তবায়িত হয়নি। যখন আমাদের চোখে ভেসে আসে সমাজে শিশুদের করুণ চিত্র।  তারা পায় না দু’বেলা দু-মুঠো ভাত, পায় না চিকিৎসা। তারা বঞ্চিত বাসস্থান ও শিক্ষার মতো মৌলিক অধিকারগুলো থেকেও।জাতিসংঘের শিশু সনদ ও আমাদের দেশের শিশু আইন ২০১৩ অনুযায়ী, ১৮ বছরের কম বয়সী শিশু-কিশোরদের শিশু বলা হয়েছে। বিভিন্ন তথ্যমতে, আমাদের দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪৫ভাগই শিশু। আবার এই শিশুদের ৪০ ভাগই দারিদ্র সীমার নিচে বসবাস করে। একটি দেশের মোট জনসংখ্যার এক বিরাট অংশ শিশু হলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই শিশুরা নানারকম অবহেলার শিকার।১৮ বছরের কম বয়সীদের দিয়ে যে কোনো ধরনের কাজ করানো আইনত অপরাধ। কিন্তু তা সত্ত্বেও দিন দিনই বেড়ে চলেছে শিশুশ্রম। দু’বেলা দু’মুঠো ভাতের জন্য জীবনের ঝুঁকি নেয় তারা। আর আমাদের সমাজের একটি শ্রেণী, এ শিশুদের ব্যবহার করে তৈরি করছে টাকার পাহাড়। যে বয়সে শিশুদের খাতা-কলম নিয়ে স্কুলে যাবার কথা, ঠিক সেই বয়সে অভাবের কারণে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে শ্রম বিক্রি করছে তারা। বিভিন্ন জরিপে দেখা যায়, শহরের তুলনায় গ্রামাঞ্চলে শিশু-শ্রমের প্রবণতা অনেক বেশি। ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত এইসব শিশুরা দৈনিক প্রায় ছয় থেকে আট ঘণ্টা কাজ করে, কিন্তু শ্রমের তুলনায় তাদের ন্যায্য পাওনা পায় না। এসব ঝুঁকিপূর্ণ কাজের মধ্যে রয়েছে মোটর ওয়ার্কশপের কাজ, ওয়েল্ডিং, গ্যাস কারখানা, লেদ মেশিন, রিকশা চালানো, মাদক বাহন, বিড়ি কারখানা, বাস-ট্রাকের হেলপার, নির্মাণ শ্রমজীবী, গৃহ শিশু শ্রমজীবী, সূচি কাজ, জাহাজ শিল্প, ইটভাটা শ্রমজীবী, হোটেল শ্রমজীবী, ট্যানারি এবং রংমিস্ত্রির কাজসহ আরো নানা ধরনের কাজ।জীবিকার তাগিদে আমাদের সমাজে শিশুদের আরেকটি বিরাট অংশ চলে যায় অন্ধকার জগতে। নামে মাদক আর অস্ত্র চোরাচালানেও। বিশেষ করে, অল্প বয়সী হওয়ায় সহজে তারা আইন-শৃংখলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দেওয়া সহজ হওয়ায় অপরাধ জগতের লোকেরা তাদের ব্যবহার করে। এক সময় কৌতূহল থেকেই নিজেরাও আসক্ত হয়ে পড়ে মাদকে। আর যখন মাদকের কুফল জানতে পারে, তখন আর স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার কোনো পথ থাকে না।২০০৭ সালে বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরাম, টিএইচ নেদারল্যান্ডস ও পদক্ষেপ মানবিক উন্নয়ন কেন্দ্রের যৌথ উদ্যোগে জরিপে দেখা যায়, ঢাকা শহরে কমপক্ষে ২২৯টি স্পট রয়েছে, যেখানে ৯-১৮ বছরের শিশুরা মাদক সেবন করে। ২১ টি স্থানে সূচের মাধ্যমে মাদকগ্রহন, ৭৭টি স্থানে হেরোইন সেবন এবং ১৩১ টি স্থানে গাঁজা সেবন করা হয়। ঢাকা শহরের ২৮টি থানায় ৪১০ জন মাদকসেবী শিশুকে চিহ্নিত করে নির্দিষ্ট প্রশ্নমালার আলোকে এইসব তথ্য উঠে আসে।সম্প্রতিকালে রাজনৈতিক কাজে শিশুদের ব্যবহারের ঘটনাও ঘটছে। বড় ধরনের সভা-সমাবেশ এমনকি সহিংস কর্মকাণ্ডে শিশুদের ব্যবহার লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সম্প্রতি কয়েকটি ধর্মীয় নামধারী রাজনৈতিক দলে শিশুদের সহিংস কর্মকান্ডে অংশগ্রহন নিয়ে গণমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে। সংবিধানের আইন উপেক্ষা করে শিশুদের দিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এবং সম্প্রতিকা সময়ে রাজনৈতিক কাজ করানো হচ্ছে। অথচ এখন পর্যন্ত শিশু শ্রমের দায়ে বাংলাদেশে কাউকে শাস্তি পেতে হয়েছে, এমন নজির কোথায়?নতুন প্রণীত শিশু আইন, ২০১৩ এর ৭৯ ধারায়, শিশুদের আগ্নেয়াস্ত্র বা অবৈধ বস্তু বহন এবং সন্ত্রাসী কাজে সর্বোচ্চ তিন বছরের কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। একই ধারায় আরো বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি শিশুর প্রকৃত দায়িত্বসম্পন্ন বা তত্ত্বাবধায়নকারী হোক বা না হোক, শিশুকে সন্ত্রাসবিরোধী আইন, ২০০৯ এর ৬ ধারায় উল্লেখিত কোনো সন্ত্রাসী কাজে নিয়জিত করলে বা ব্যবহার করলে তিনি স্বয়ং ওই সন্ত্রাসী কাজ করেছেন বলে গণ্য হবেন এবং ওই ধারায় উল্লেখিত দন্ডে দন্ডিত হবেন।নতুন আইনে শিশুদের রাজনৈতিক কর্মকান্ডে ব্যবহার বন্ধ করতে শাস্তির বিধানও রাখা হয়েছে। শিশুকে মাদক বা বিপদজ্জনক ওষুধ সরবরাহ কাজে নিয়োজিত করলে, তিন বছরের জেল এবং এক লাখ টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। আইন রয়েছে কিন্তু বাস্তবায়নেরে কেউ নেই। প্রবাদের কথায়, ‘কাজীর গরু খাতায় আছে, গোয়ালে নেই।’সম্প্রতি, ইউনিসেফের এক জরিপে উঠে এসেছে, শিশুদের বিনা পয়সায় শিক্ষা ও চিকিৎসার দাবি। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে প্রকাশিত ইউনিসেফের এই জরিপের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাজনৈতিক দলগুলো শিশুর অধিকার রক্ষায় সচেষ্ট নয়। শিশুরা ভোটার নয়, তাই রাজনৈতিক দলগুলো তাদের অধিকার আদায়ে সচেষ্ট নয় বলে মত দিয়েছে উক্ত জরিপে অংশ নেওয় শিশুরা। জরিপে শিশুরা বিনামূল্যে চিকিৎসা ও মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করার দাবি জানায়। জরিপে অংশ নেওয়া ৭১ ভাগ শিশুর অভিযোগ ছিল রাজনৈতিক সহিংসতায় তাদের পড়াশুনা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। জরিপে আরো বলা হয়, দুর্নীতি ও ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডের কারণে শিশুরা রাজনীতির ব্যাপারে আগ্রহ হারাচ্ছে। অধিকাংশ শিশুরাই ভবিষ্যৎ রাজনীতির হাল ধরার প্রতি অনীহা প্রকাশ করেছে।প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক হলেও আজও পিছিয়ে পড়া অঞ্চলের একটি বিরাট অংশ প্রাথমিক শিক্ষা হতে বঞ্চিত। অনেকেই ঝরে যাচ্ছে স্কুল থেকে। দেশের ৪৬ শতাংশ শিশুই অপুষ্টিতে ভোগে। গড়ে পাঁচজন শিশুর মধ্যে একজন ভিটামিন ‘এ’ এবং দু’জনের একজন রক্তস্বল্পতায় ভোগে। তবে ভালো সংবাদ ইউনিসেফের এক জরিপে দেখা গেছে, দেশে শিশু মৃত্যুর হার প্রায় ৭২% কমে গেছে।শিশুদের কথা ভেবে, ‘চাইল্ড পার্লামেন্ট’ নামে এক শিশু সংগঠনসহ বেশ কিছু সংগঠন সরকারের প্রতি আলাদা মন্ত্রনালয় করার দাবি জানিয়েছে। বর্তমানে ‘নারী ও শিশু মন্ত্রনালয়’ শিশুবিষয় দেখাশুনা করে। কিন্তু আলাদা মন্ত্রনালয়ের দাবি সম্পর্কে সরকার এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি। শিশুবিষয়ক আলাদা মন্ত্রনালয় হলে শিশুর প্রতি আরো নজর বাড়বে ও সরকার গোষ্ঠি আরো যত্নবান হবে বলে আশা করা যায়।জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদে বলা হয়েছে, শিশুরা যাতে সুস্থ ও পরিপূর্ণভাবে বেড়ে উঠতে পারে তার যাবতীয় ব্যবস্থা করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। এর মধ্যে সেবা প্রদান থেকে শুরু করে আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ, প্রশাসনিক পদক্ষেপ ও প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্ধ সবই আছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই নেই।অতি দারিদ্র শিশুদের পুষ্টিকর খাবার, আর্থিক সুবিধা দিয়ে স্কুলগামী করতে হবে। তাদের বোঝাতে হবে, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ানোর জন্য কোনো টাকা পয়সা লাগে না। বিশেষ করে, পল্লীবাসীদের মনে শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। পথশিশু বা শিশু শ্রমজীবীদের সেইফহোমের মাধ্যমে দিনে বা রাতে খন্ডকালীন শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। শিশুদের বিদ্যালয়মুখী করা এবং পূর্ণবাসন বিষয়ে সরকারের নীতি নির্ধারকদের ভাবতে হবে। শিশুদের অপরাধের সঙ্গে জড়িতকারী দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আইন প্রয়োগ করতে হবে। যেভাবে দিনে দিনে শিশুরা অপরাধের সঙ্গে জড়িত হচ্ছে, এটা অব্যাহত থাকলে আমাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার।।শিশু সাংবাদিক (hello.bdnews24.com), সিলেট।তথ্য সংগ্রহ : ইউনিসেফের বিভিন্ন জরিপ, গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য ও উইকিপিডিয়া।রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৫ জুন ২০১৪/শান্ত