জাতীয়

কোথায় পাবো তারে

শেখ হারুন অর রশিদ : ফাগুনের হাওয়ায় কেন যেন অমেলার মন দোলে না! বিয়ে বাড়িতে সবাই আনন্দ উল্লাসে বেয়ারাদের পালকি নাচ দেখতে ব্যস্ত ৷ এ দিকে ঘরের মধ্যে অমেলাকে বধূ বেসে সাজানো হয়েছে ৷ ছোট, বড় বোন ও ভাবিরা নেচে গেয়ে একই সুরে গলা মিলিয়ে গাইছে - আলতা সাবান মেখে বুবু যাবে শ্বশুর বাড়িতে,  কি ভাব লেগেছে তার মনেতে ৷ অমেলাকে ভাবিরা এপাশ ওপাশ থেকে আকার ইঙ্গিতে কত কথা বলে যায় কিন্তু তাতেও অমেলার মন কিছুই বোঝে না ৷ কি এক অতৃপ্ত জ্বালায় তার বুকটা তুষের আগুনের মত  ধিকিধিকি করছে ৷ বারবার  অমেলার হৃদয় পটে ভেসে ওঠে আহমদ ফকিরের দু গন্ড দিয়ে অশ্রু বেয়ে পড়ার দৃশ্য ৷ কেন যেন তার বুকের যন্ত্রণা বেড়ে যায় ৷ খোপায় গাদা ফুলের মালা,  হাতে আহমদ ফকিরের দেওয়া বুচ ফলের মালা,  লাল পেড়ে গোলাপি রংয়ের শাড়ি,  ঠোটে রক্তবর্ণ লিপস্টিক এই সাজে অমেলাকে উঠানো হয় পালকিতে ৷ পালকিতে উঠে দাদির গলা জড়িয়ে কেদে যায় অমেলা ৷ চার বেয়ারা নেচে গেয়ে অমেলাকে নিয়ে চলতে থাকে গ্রামের মেঠোপথে দিয়ে ৷ অমেলা পালকির পর্দা উচু করে শেষবারের জন্য দেখে নেয় সেই কৃষ্ণচূড়া গাছকে,  তাকিয়ে থাকে অপলক দৃষ্টিতে ৷ তার হৃদয় যেন বৈশাখী ঝড়ে চুরমার করে দিয়ে যায় ৷ প্রচণ্ড এই দাবদাহে পালকি যতদূর যায় তার মনব্যাথাও তত বেড়ে যায় ৷ এতদিন পর আজ তার বারবার মনে হতে থাকে আহমদ ফকির মনে হয় তাকে ভালোবাসে ৷ কেন সেদিন চলে আসার সময় বারবার আকাশ বাতাস থেকে সে ‘অমেলার রূপ,  অমেলার রূপ’ চিৎকার শুনতে পেয়েছিল ৷ এটা কি আহমদের ডাক নাকি তার মনের ভুল? কেন সে মুখ ফুটে একটিবার বলেনি - অমেলা, আমি তোমাকে ভালোবাসি ৷ বলতে বলতে ততক্ষণে সে পালকির মধ্যে দাদির বুকে মাথা রেখে বলে- দাদি,  তুমি আহমদের কোনো খোজ খবর জানো? কোথায় আছে, কেমন আছে?  দাদি অমেলার মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে বলে- তোর বর কেমন আছে সেটা শোন ৷ আহমদের খোজ নিয়ে তোর কি হবে? দাদি পরক্ষণই বলে - আহমদের সাথে তোর ইটিশ পিটিশ আছে নাকি? দাদির কথা শুনে অমেলা ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাদতে থাকে ৷ দীর্ঘদেহী আহমদ ফকিরের খাড়া চুল,  লম্বা চিকন নাক,  সাদা দাত , লালচে চোখের সেই চাহনি যেন অমেলাকে বিমর্ষ করে তোলে ৷ সূর্যটা  আলোর আভা ছেড়ে যখন অন্ধকারকে ডেকে আনে তখনই অমেলার পালকি জামাইনগর পৌঁছায় ৷ অমেলাকে বরন করে শ্বশুর বাড়ির লোকজন বাসর ঘরে নিয়ে যায় ৷ সারাদিনের ক্লান্তিতে অমেলার দেহ নেতিয়ে পড়ে ৷ মাথায় বালিশ নিয়ে দুহাত চোয়ালে দিয়ে চোখ বন্ধ করে থাকে সে ৷ একটা সময় অমেলার স্বামী ঘরে প্রবেশ করে ৷ অমেলা ইতস্তত বোধ করতে থাকে ৷ তার স্বামী বলে - অমেলা,  তুমি একটু অপেক্ষা করো ৷ আমি এখনই ফিরে আসবো ৷ অন্ধকার ভেদ করে জানালা দিয়ে চাদের আলো প্রবেশ করে ঘরে ৷ এমন মুহূর্তে অমেলার স্বামী অপরূপা অমেলাকে ঘরে রেখে বেরিয়ে পড়ে একটা আংটি নিয়ে আসার জন্য ৷ যেটা বাসর রাতে দেবার জন্য বানাতে দেওয়া ছিল ৷ অমেলা ঊর্ধ্বশ্বাসে অপেক্ষা করতে থাকে ৷ কিন্ত রাতের গভীর হওয়ার সাথে সাথে অমেলার অপেক্ষাও যেন শেষ হয় না ৷ অমেলার স্বামী কোথায় যেন নিরুদ্দেশ হয়ে গেলো ৷ রাত শেষ হলেও সে আর ঘরে ফেরে না ৷ অমেলা বিমর্ষ মুখ যেন চাদের কলঙ্ক হয়ে ধরা দেয় ৷ সকাল বেলা আর বিয়ের জোড়ে স্বামীর সাথে বাবার বাড়ি ফেরা হয় না ৷ তার সঙ্গী হয় শূন্য নৌকা ৷ অবুঝ মানুষের মন ৷ নৌকা থেকে নেমে অমেলা পাগলের মত ছুটে যায় আহমদ ফকিরের বাড়ি ৷ উঠানে দাড়িয়ে সে চিৎকার করে- আহমদ,  আমি ফিরে এসেছি ৷ তোমার বুচ ফলের মালা এবার পরিয়ে দাও ৷ তোমাকে ফেলে আর কোথাও যাবো না ৷ আমি তোমাকে ভালোবাসি ৷ আহমদের শূন্য ঘর কোনো সাড়া দেয় না,  অমেলা কে ফিরিয়ে দেয় রিক্ত হাতে ৷ আহমদ আর নেই সে ঘরে,  পড়ে আছে কেবল তার একটা লাল গেঞ্জি ৷ অমেলার চোখের পানি যেন ভাসিয়ে দিতে পারে লক্ষ কনক্রিটের বাধ! অমেলা সারাবেলা খুজে ফেরে আহমদকে ৷ কিন্তু প্রতিটি দিন শেষে ভাগ্য  তাকে উপহার দেয় একরাশ শূন্যতা ৷ আস্তে আস্তে মানসিক বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়ে সে ৷ রাস্তাঘাটে অমেলাকে দেখা যায় একটা মাটির বাসন হাতে নিয়ে ঘুরে ঘুরে পায়চারি করতে ৷ তার মুখ দিয়ে একটা কথাই বের হয়- কোথায় পাবো তারে? কোথায় পাবো তারে? এভাবেই কেটে যায় অনেক বছর ৷ মনের অজান্তে কোনো এক ভরদুপুরে জীর্নশীর্ন শরীরের কাচা পাকা চুলের অমেলা উপস্থিত হয় জামাইনগরের এক বটতলায় ৷ সেখানে কে যেন উদাস ভঙ্গিতে বসে আছে ঠিক যেন অমেলার মত দিকভ্রান্ত কেউ ৷ আহমদের কেন জানি মনে হতে থাকে এই বুঝি অমেলা তার সামনে ৷ সে বিড় বিড় করে বলতে থাকে-   অমেলা, এত কিছু বোঝো কিন্তু আমার মন বোঝো না ৷ তোমার রূপের আগুনে পুড়ে আমি শেষ হয়েছি ৷ যখন তুমি এলে তখন আমি ফুরিয়ে গেলাম! ফিরে যাও অমেলা তোমার গন্তব্যে! তখনও অমেলা হাতে মাটির বাসন ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বলে যায়- কোথায় পাবো তারে, আমি কোথায় পাবো তারে ৷ লেখক : সিনিয়র অ্যাডভোকেট জর্জকোর্ট, খুলনা ৷

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৮ জুন ২০১৪/শামসুল