জাতীয়

ক্ষোভের আগুন জ্বেলে এল সকাল

মৃত্যুর সঙ্গে কয়েক দিনের লড়াই শেষে না ফেরার দেশে চলে গেলেন ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র জুলাই অভ্যুত্থানের অগ্রণী নেতা শরিফ ওসমান বিন হাদি। সিঙ্গাপুর থেকে সেই খবর দেশে আসতেই শোকের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে ক্ষোভের আগুন। সেই আগুনে পোড়ে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহীসহ বিভিন্ন শহরের স্থাপনা ও প্রতিষ্ঠান। রাতভর ক্ষোভের বিস্ফোরণে গর্জে ওঠে ‘হাদিময় বাংলাদেশ’, যার রেশ নিয়ে এল একটি এমন সকাল, যে সকালটি রাতের মতোই উজ্জীবিত, বিক্ষুব্ধ ও উত্তেজনাপূর্ণ। এই ধারাবাহিকতায় দিনভর নানা কর্মসূচির মধ্যে বাদজুমা সারা দেশে ব্যাপক বিক্ষোভের স্পষ্ট আভাস রয়েছে।

বৃহস্পতিবার (১৮ ডিসেম্বর) রাতে ওসমান হাদির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজ ও ইনকিলাব মঞ্চের ফেসবুক পেজে তার মৃত্যুর মৃত্যুর খবর জানানো হয়। মুহূর্তেই সেই খবর তার ভক্ত-সমর্থক, সহযোদ্ধা, সহমর্মীদের রক্তে আগুন ধরায়। তুফান গতিতে তারা নেমে আসেন রাস্তায়, গর্জে ওঠে শাহবাগ। আগুন দেওয়া হয় জাতীয় দৈনিক প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার পত্রিকার কার্যালয়ে। প্রথম আলোর আগুন নিয়ন্ত্রণে এলেও পুরোপুরো নেভেনি সকাল পর্যন্ত; উড় দেখা যায় কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলী। 

তরুণ নেতা হাদির মৃত্যুতে দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যাপক বিক্ষোভ দেখা যায়। ক্ষোভের মশাল জ্বেলে রাতের ক্যাম্পাস জাগিয়ে রাখে তারা। 

ওসমান হাদির মৃত্যুর জন্য দায়ীদের গ্রেপ্তার, ভারতের পালিয়ে যাওয়া আসামিদের ফেরত আনা ও বিচার নিশ্চিত করা এবং ফ্যাসিবাদী শক্তির বিলোপসহ ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই জারি রাখার আহ্বানে জেগে ওঠে দেশ। ওসমান হাদি ভারতের আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে উচ্চকণ্ঠ ছিল।

জুলাইযোদ্ধা ওসমান হাদির মৃত্যুতে বৃহস্পতিবার (১৮ ডিসেম্বর) রাতেই জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। সেই ভাষণে তিনি শনিবার (২০ ডিসেম্বর) রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করেন। 

হাদির মৃত্যুর খবরে ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, নেত্রকোনা, ঝালকাঠিসহ সারা দেশে শোক, ক্ষোভ ও প্রতিবাদের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। বিভিন্ন স্থানে এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত (১৯ ডিসেম্বর সকাল সাড়ে ৬টা) ছাত্র-জনতার অবস্থান ছিল।

ওসমান হাদির মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একাধিক শোক মিছিল ও প্রতিবাদ সমাবেশ হয়। বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে টিএসসি ও হলপাড়া এলাকা থেকে শিক্ষার্থীরা শোক মিছিল বের করে রাজু ভাস্কর্যে জড়ো হন। এই কর্মসূচিতে ডাকসু ভিপি সাদিক কায়েম, জিএস এস এম ফরহাদসহ বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের নেতারা অংশ নেন। এ ছাড়া রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যাপক বিক্ষোভ হয়।

সন্ধ্যায় আসছে ওসমান হাদির মরদেহ সিঙ্গাপুর থেকে শুক্রবার বিকেল ৩টা ৫০ মিনিটে ওসমান হাদির মরদেহ নিয়ে রওনা হবেন তার স্বজনরা। সন্ধ্যা ৬টার দিকে তারা বাংলাদেশে অবতরণ করবেন। ইনকিলাব মঞ্চের পক্ষ থেকে এক ফেসবুক পোস্টে এ তথ্য জানানো হয়েছে।

হাদির মৃত্যুর পর রাতজুড়ে যা ঘটেছে শরিফ ওসমান হাদির মৃত্যুর খবর আসার পর বৃহস্পতিবার রাতভর দৈনিক প্রথম আলো, ডেইলি স্টার, ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে শেখ মুজিবের বাড়ি ও ছায়ানট সংস্কৃতি ভবনে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। হামলার কারণে কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাওয়ায় শুক্রবার (১৯ ডিসেম্বর) প্রকাশ হচ্ছে না প্রথম আলো ও দ্য ডেইলি স্টার পত্রিকা। গণমাধ্যম দুটির অনলাইন কার্যক্রম প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে বিবিসি বাংলাকে এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন পত্রিকা দুটির শীর্ষ কর্মকর্তারা।

এছাড়া প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার পত্রিকা অফিসে হামলার খবর শুনে সেখানে গিয়ে হামলাকারীদের হেনস্তার শিকার হয়েছেন সম্পাদক পরিষদের সভাপতি ও নিউ এজ পত্রিকার সম্পাদক নূরুল কবীর।

বৃহস্পতিবার রাত পৌনে ১২টার দিকে শাহবাগে মিছিলে যুক্ত হন জাতীয় নাগরিক পার্টির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম। এর আগে সাড়ে ১১টায় শাহবাগে আসেন সাবেক উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ।

শরিফ ওসমান হাদি

শাহবাগে উপস্থিত হয়ে নাহিদ ইসলাম মাইকে স্লোগান ধরেন। তিনি বলেন, “জান দিয়েছে আমার ভাই, খুনি তোমার রক্ষা নাই, ভারতীয় আগ্রাসন রুখে দাও জনগণ, দিয়েছি তো রক্ত, আরও দেব রক্ত, আপস না সংগ্রাম, ক্ষমতা না জনতা, তুমি কে আমি কে হাদি হাদি, এক হাদি রক্ত দেবে– লক্ষ হাদি জন্ম নেবে, গোলামি না আজাদি, দিল্লি না ঢাকা, লীগ ধর জেলে ভর” স্লোগান দেন।

ওসমান হাদিকে গুলি করে হত্যাকারীদের দ্রুত বিচারের দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল করেছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। রাত ১০টা ৪৫ মিনিটে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক থেকে শিক্ষার্থীরা এই বিক্ষোভ মিছিল করেন। মিছিলে ছাত্রদল, ছাত্রশিবির, ছাত্রশক্তি, বাম জোটের নেতাকর্মীসহ সাধারণ শিক্ষার্থীরা অংশ নেন। এ সময় ছাত্রী হলের শিক্ষার্থীরাও মিছিলে যোগ দেন।

রাজধানীর উত্তরায় শহীদ মুগ্ধ মঞ্চে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করেন জুলাইযোদ্ধারা।

এদিকে, একদল তরুণ চট্টগ্রামে ভারতীয় সহকারী হাইকমিশন কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নেন। কার্যালয়ে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে কয়েকজন। চট্টগ্রামে সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের বাড়িতে হামলা হয়। রাজশাহীতে আওয়ামী লীগের কার্যালয় বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। 

ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-খুলনা মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করা হয়। এই দুই রুটে যান চলাচল অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। অবশ্য কয়েক ঘণ্টা পর আবার স্বাভাবিক হয়। 

এক নজরে শরিফ ওসমান হাদি শরিফ ওসমান হাদি ১৯৯৩ সালে ঝালকাঠি জেলার নলছিটি উপজেলায় এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা একজন মাদ্রাসা শিক্ষক, যার আদর্শ ও নৈতিক শিক্ষা হাদির জীবন গঠনে গভীর প্রভাব ফেলেছে। তিন ভাই ও তিন বোনের মধ্যে তিনি কনিষ্ঠতম।

ওসমান হাদির শিক্ষা জীবনের ভিত্তি গড়ে ওঠে ঝালকাঠির বিখ্যাত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঝালকাঠি এন এস কামিল মাদ্রাসায়। সেখান থেকে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা কৃতিত্বের সঙ্গে সম্পন্ন করে তিনি উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্যে পাড়ি জমান ঢাকায়। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১০-১১ শিক্ষাবর্ষে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন। এই প্রতিষ্ঠান থেকে তিনি রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনার্স মাস্টার্স করেন।

ছাত্রজীবন শেষ করার পর হাদি শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নেন। কর্মজীবনের শুরুতে তিনি একটি কোচিং সেন্টারে শিক্ষকতা করেন। এরপর তিনি একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন।

ডেইলি স্টার পত্রিকার অফিসের ছাদে আটকেপড়াদের ক্রেনে নামিয়ে আনা হয়। রাত ২টার দৃশ্য। ছবি: রাইজিংবিডি।

জুলাই অভ্যুত্থানের পর ইনকিলাব মঞ্চ গঠন করে আলোচনায় আসেন হাদি। ইনকিলাব মঞ্চ প্রতিষ্ঠার পর জুলাই অভ্যুত্থানের স্মৃতি সংরক্ষণ, শহীদ ও আহতদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি এবং জুলাই ঘোষণাপত্র ঘোষণার দাবিতে শাহবাগে ধারাবাহিক সমাবেশ আয়োজন করেন হাদি।

বিভিন্ন টেলিভিশনের টক শোতেও নিয়মিত আমন্ত্রণ পেতে থাকেন। প্রথমে ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র হলেও পরে আহ্বায়কের দায়িত্ব নেন।